প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এ দেশের বিজ্ঞান-শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যার ধারা এখনো চলছে। এর মূলে ছিল বুয়েটের পরীক্ষা পদ্ধতির স্বচ্ছতা, বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দূষিত ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতি এবং


সর্বোপরি এখানকার শিক্ষকদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতবাদের ঊর্ধ্বে উঠে ছাত্রদের বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। কিন্তু বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এত দিনের সুনাম আজ ধ্বংসের পথে। এ অবস্থায় বুয়েটের একজন সাধারণ অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী হিসেবে কিছু কথা তুলে ধরার জন্য এই লেখার অবতারণা।
উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ নিয়ে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকেরা ৭ এপ্রিল থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন। একই দাবি নিয়ে ২০১১-এর নভেম্বর মাসেও তাঁরা এক সপ্তাহের কর্মবিরতি পালন করেছিলেন। তাঁদের অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হচ্ছে—নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রশাসনে দলীয় নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি এবং বুয়েটের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে একজন ছাত্রনেতার পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন। এই প্রতিটি অভিযোগই স্বনামধন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনের সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই অবস্থায় বুয়েট প্রশাসন ও শিক্ষকদের অনমনীয় অবস্থানের মুখে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা অসহায় দর্শকের নীরব ভূমিকা পালন করছি।
শিক্ষকদের এই আন্দোলনের সময়টাতে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা চলমান পরিস্থিতির সংকট আরও বাড়িয়েছে। এর মধ্যে আছে, জানুয়ারি মাসে ’০৬ ব্যাচের একজন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করার দায়ে দোষীদের বহিষ্কারের দাবিতে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংঘটিত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সামনের সারির কয়েকজন শিক্ষার্থীর শেষ টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল আটক দেওয়া। ঘটনা ঘটার তিন মাস পর এপ্রিলের শুরুতে, ফলাফল প্রকাশের কয়েক দিন আগে একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, যার যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশের অপেক্ষা না করেই ফলাফল স্থগিত করা হয়। অথচ সেই আন্দোলনের ফলে আজীবন বহিষ্কৃত একজন দোষী ছাত্র গত টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আরও গুরুতর অভিযোগ হলো, শিক্ষার্থীরা না চাওয়া সত্ত্বেও দুই দফা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল, হাইকোর্টের রিট নিয়ে একজন বহিষ্কৃত ছাত্রকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সম্পর্কে কুত্সা রটানো হচ্ছে, যা তাঁদের কাছ থেকে দেখা শিক্ষার্থীদের মর্মাহত করেছে। শিক্ষকদের কনসালট্যান্সি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় জড়িত হওয়া নিয়েও অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে আমাদের কিছু বলার আছে। আমার প্রায় সাড়ে চার বছরের বুয়েটজীবনে আমি কোনো শিক্ষককে পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি করে ক্লাসে আসতে দেখিনি, তাও কদাচিত্। অধিকাংশ শিক্ষক ৫৫ মিনিটের ক্লাস ৬০ মিনিট বা পরের ক্লাস ফাঁকা থাকলে এর বেশি সময় ধরেও নেন। কোনো কারণে কোনো ক্লাস মিস হলে পরে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে তা পুষিয়ে দেন। কাজেই তাঁদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার কোনো সরাসরি প্রভাব আমাদের ওপর পড়ে না।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণা সহায়তা প্রদান করা বুয়েটের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। তাই নিয়ম মেনে শিক্ষকদের কনসালট্যান্সি করায় আমাদের আপত্তির কিছু নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি না করছে। আর শিক্ষকদের কনসালট্যান্সি থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা ভালো অংশ বুয়েটের তহবিলে জমা হয়।
বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি নিয়েও কিছু বলার আছে। ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে কি নেই, সে তর্কে যাব না; শুধু এটুকু বুঝতে পারি, যে ছাত্ররাজনীতি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস ডেকে আনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র জায়গায় তার প্রবেশাধিকার না থাকাই ভালো। বিশেষ করে বুয়েটে, যেখানে আমাদের বেশির ভাগ সময় পড়াশোনা ও নানা উদ্ভাবনী কাজে ব্যয় করতে হয়, সেখানে রাজনৈতিক ছায়ার বিস্তার শিক্ষার্থীদের মেধাকে ভালো কাজে লাগানোর পথ রুদ্ধ করে দেয়। এর আগে ২০০২ সালে তত্কালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের সংঘাতে সাবেকুন নাহার সনি আপু নিহত হয়েছিলেন। তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েট থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বুয়েটে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা বিশ্বাস করি, আপনার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আপনি আমাদের মতো তরুণদের নিয়েই দেখেছেন। আমরা প্রযুক্তিগত রেনেসাঁয় প্রকৌশলী হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চাই। আর এর জন্য সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ও সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছ, দলীয়করণমুক্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আমাদের চাওয়া।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অন্যায় বারবার চলতে থাকলে একসময় তা সিস্টেম হয়ে দাঁড়ায়, আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সাহস ও ধৈর্য অনেকেরই থাকে না। তাই সাম্প্রতিক সময়ে স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বুয়েটে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বুয়েটে যাঁরা শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পান, তাঁরাও প্রথম সুযোগেই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে চলে যান, আর কখনোই ফিরে আসেন না। আর যাঁরা এসেছেন, তাঁদেরও এখন শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ ছেড়ে আন্দোলনে নামতে হয়েছে।
তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান, একে রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.