জননিরাপত্তা-ইলিয়াস গুমের ঘটনায় রাষ্ট্রের দায় by শেখ হাফিজুর রহমান
কোনো দুর্ঘটনা যখন ঘটে, কোনো মানুষ যখন হারিয়ে যান, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কান্না আমাদের ব্যথিত করে। সম্প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখতে পাই হারিয়ে যাওয়া মানুষ বা দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিটির স্বজনদের আর্তনাদ, অশ্রু ও শূন্য দৃষ্টি।
ঘটে যাওয়া ঘটনার তুলনায় স্বজনদের আর্তনাদ ও কান্না কি কম মর্মান্তিক? কিছুদিন পর পর এ ধরনের মর্মান্তিকতা আমাদের চোখ ও হূদয়কে দলিত-মথিত করে। এমন এক দেশে আমরা বাস করি যে ঘটনার পর ঘটনা ঘটতেই থাকে, তার কোনো প্রতিকার হয় না। আরও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে আমাদের স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। তবু ঘটনার কোনো বিচার হয় না।
গত কয়েক দিন সম্প্রচার মাধ্যমে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সন্তানদের আর্তনাদ ও কান্না আমাকে ব্যথিত করেছে, যদিও আমি ইলিয়াস আলীকে পুরোপুরি রাজনীতিবিদ বলতে রাজি নই। কেননা, যে প্রক্রিয়ায় তিনি রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন এবং তিনি যে ধারার রাজনীতি করেন, তা অসুস্থ ও দুর্বৃত্তায়িত। তবে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এভাবে নিখোঁজ ও গুম হতে থাকলে নাগরিক নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকবে না। অসুস্থ ধারার রাজনীতি যাঁরা করছেন, তাদের সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কিন্তু নিখোঁজ ও গুমের সংস্কৃতি সুস্থ রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার শেকড় ধরে টান দিতে পারে। এমনিতেই আমাদের রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থা নানা সমস্যায় আক্রান্ত। এখানে অনেক অনেক চুরি, ডাকাতি ও খুনের কোনো বিচার হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কারণে-অকারণে মৃতের তালিকা বেড়েই চলেছে। তারপর যদি ‘গুম’ ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে, তাহলে সমাজে আতঙ্ক তৈরি হবে। মানুষ আতঙ্ক পছন্দ করে না। আতঙ্কিত সমাজে নানা বিকৃত অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয়।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সারা দেশে এক অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের ডাকে ইতিমধ্যে পাঁচ দিন হরতাল হয়ে গেছে। এতে মারা গেছে পাঁচজন, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অসংখ্য গাড়িতে। লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। অথচ এসব না করে বিরোধী দল যেমন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারত, সরকারের তরফ থেকেও বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে বিষয়টি তদন্ত হতে পারত। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নিখোঁজ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বাদ দিয়ে বিরোধী দল দিনের পর দিন হরতালের মাধ্যমে জাতীয় জীবন অচল করে রাখবে, তা-ও কাম্য হতে পারে না। বিশেষ করে যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে, তখন এ ধরনের লাগাতার হরতাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষতি করতে পারে।
সুস্থ ধারার রাজনীতির জন্য ইলিয়াস আলীরা কোনোভাবেই অনুকরণীয় হতে পারেন না। একটা নমুনা দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল রহুল কবীর রিজভীকে আর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল ইলিয়াস আলীকে। কমিটি গঠনের কিছুদিনের মধ্যে ইলিয়াস ও রতন গ্রুপের দ্বন্দ্ব মারাত্মক হয়ে ওঠে। এর সূত্র ধরে চারজন ছাত্র নিহত হলে ছাত্রদলের ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। সন্ত্রাসের দায়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় ইলিয়াস আলীকে। তখন ক্ষমতায় কিন্তু বিএনপি সরকার! আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইলিয়াস আলীরা কখনো কোনো গণসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সুস্থধারার রাজনীতির জন্য সম্পদ হতে পারেন না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা অসুস্থ রাজনীতির চিকিত্সা বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্যও সুস্থ রাজনীতির কাছেই ফিরে আসতে হবে। একমাত্র সুস্থ রাজনীতিই পারে রাষ্ট্র ও সমাজদেহের নানা ক্ষত সারাতে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তি দিতে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি সবাইকে আতঙ্কিত করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হচ্ছে, সরকারের একটি সংস্থা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। ওদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইলিয়াস আলী গ্রেপ্তার হলে পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকতেন, দুর্ঘটনার শিকার হলে তার চিহ্ন থাকত, কিন্তু রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটি তো গুরুতর। সরকারি কোনো বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাকে যদি ‘নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা’র সঙ্গে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়, তাহলে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় এর শিকার হতে পারে। বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। আর দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে কেউ বিশ্বাস করতে চান না যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আজকের ক্ষমতাসীনেরা যে অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারলেন না বা করলেন না, সেই অন্যায় হয়তো শত সহস্রগুণ হয়ে একদিন তাঁদেরকেই গ্রাস করবে। তখন তাঁরা প্রতিবাদ করবেন, প্রতিকার চাইবেন, কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা থাকবেন নির্বিকার।
পরিশেষে তিনটি প্রত্যাশা: এক. ইলিয়াস আলী সুস্থ অবস্থায় মা ও স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফিরে আসুন। দুই. আসার পর তিনি সুস্থধারার রাজনীতিতে শামিল হোন। তিন. সরকারি ও বিরোধী দল, আপনারা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আচরণ করুন।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গত কয়েক দিন সম্প্রচার মাধ্যমে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সন্তানদের আর্তনাদ ও কান্না আমাকে ব্যথিত করেছে, যদিও আমি ইলিয়াস আলীকে পুরোপুরি রাজনীতিবিদ বলতে রাজি নই। কেননা, যে প্রক্রিয়ায় তিনি রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন এবং তিনি যে ধারার রাজনীতি করেন, তা অসুস্থ ও দুর্বৃত্তায়িত। তবে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এভাবে নিখোঁজ ও গুম হতে থাকলে নাগরিক নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকবে না। অসুস্থ ধারার রাজনীতি যাঁরা করছেন, তাদের সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কিন্তু নিখোঁজ ও গুমের সংস্কৃতি সুস্থ রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার শেকড় ধরে টান দিতে পারে। এমনিতেই আমাদের রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থা নানা সমস্যায় আক্রান্ত। এখানে অনেক অনেক চুরি, ডাকাতি ও খুনের কোনো বিচার হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কারণে-অকারণে মৃতের তালিকা বেড়েই চলেছে। তারপর যদি ‘গুম’ ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে, তাহলে সমাজে আতঙ্ক তৈরি হবে। মানুষ আতঙ্ক পছন্দ করে না। আতঙ্কিত সমাজে নানা বিকৃত অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয়।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সারা দেশে এক অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের ডাকে ইতিমধ্যে পাঁচ দিন হরতাল হয়ে গেছে। এতে মারা গেছে পাঁচজন, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অসংখ্য গাড়িতে। লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। অথচ এসব না করে বিরোধী দল যেমন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারত, সরকারের তরফ থেকেও বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে বিষয়টি তদন্ত হতে পারত। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নিখোঁজ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বাদ দিয়ে বিরোধী দল দিনের পর দিন হরতালের মাধ্যমে জাতীয় জীবন অচল করে রাখবে, তা-ও কাম্য হতে পারে না। বিশেষ করে যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে, তখন এ ধরনের লাগাতার হরতাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষতি করতে পারে।
সুস্থ ধারার রাজনীতির জন্য ইলিয়াস আলীরা কোনোভাবেই অনুকরণীয় হতে পারেন না। একটা নমুনা দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল রহুল কবীর রিজভীকে আর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল ইলিয়াস আলীকে। কমিটি গঠনের কিছুদিনের মধ্যে ইলিয়াস ও রতন গ্রুপের দ্বন্দ্ব মারাত্মক হয়ে ওঠে। এর সূত্র ধরে চারজন ছাত্র নিহত হলে ছাত্রদলের ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। সন্ত্রাসের দায়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় ইলিয়াস আলীকে। তখন ক্ষমতায় কিন্তু বিএনপি সরকার! আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইলিয়াস আলীরা কখনো কোনো গণসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সুস্থধারার রাজনীতির জন্য সম্পদ হতে পারেন না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা অসুস্থ রাজনীতির চিকিত্সা বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্যও সুস্থ রাজনীতির কাছেই ফিরে আসতে হবে। একমাত্র সুস্থ রাজনীতিই পারে রাষ্ট্র ও সমাজদেহের নানা ক্ষত সারাতে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তি দিতে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি সবাইকে আতঙ্কিত করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হচ্ছে, সরকারের একটি সংস্থা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। ওদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইলিয়াস আলী গ্রেপ্তার হলে পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকতেন, দুর্ঘটনার শিকার হলে তার চিহ্ন থাকত, কিন্তু রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটি তো গুরুতর। সরকারি কোনো বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাকে যদি ‘নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা’র সঙ্গে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়, তাহলে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় এর শিকার হতে পারে। বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। আর দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে কেউ বিশ্বাস করতে চান না যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আজকের ক্ষমতাসীনেরা যে অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারলেন না বা করলেন না, সেই অন্যায় হয়তো শত সহস্রগুণ হয়ে একদিন তাঁদেরকেই গ্রাস করবে। তখন তাঁরা প্রতিবাদ করবেন, প্রতিকার চাইবেন, কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা থাকবেন নির্বিকার।
পরিশেষে তিনটি প্রত্যাশা: এক. ইলিয়াস আলী সুস্থ অবস্থায় মা ও স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফিরে আসুন। দুই. আসার পর তিনি সুস্থধারার রাজনীতিতে শামিল হোন। তিন. সরকারি ও বিরোধী দল, আপনারা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আচরণ করুন।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments