বিপন্ন ক্যাম্পাস-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার জট ও বিবেকের বৈকল্য
খোলা মন নিয়ে যদি ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতি আসলে কী প্রত্যাশা করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা হবেন সমাজের সবচেয়ে প্রাগ্রসর জ্ঞান ও চেতনাসম্পন্ন মানুষ, কিন্তু বাস্তবতা বলে, জাতির সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমাদের প্রতীতি, এর মৌল কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিচর্চায় আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ জ্ঞান সৃজন, জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সংরক্ষণ; কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকদের চিন্তা ও চেতনায় যেহেতু কাজ করছে বন্দিত্ব, তাই মুক্তচিন্তাকে পাশে ঠেলে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের বৃত্তাবদ্ধ মতাদর্শেই নিজেদের আটকে ফেলতেই তাঁরা বেশি স্বস্তি বোধ করছেন; আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ তার মৌল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎহয়ে পড়ছে। ফলে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পীঠ যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে চিন্তার জট চলছে, বিবেকের বৈকল্য শুরু হয়েছে। প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনায় আমাদের মধ্যে উপরিউক্ত প্রতিক্রিয়াই তৈরি করেছে। কয়েক বছর ধরে দু-তিনটি ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অশান্ত থাকছে। এত দিন এ কাজে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন; হালে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু শিক্ষকের ব্যক্তিস্বার্থ, পদ আঁকড়ে থাকার লক্ষ্য বা কাঙ্ক্ষিত পদ পেতে ছাত্রদের ব্যবহার করে শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করার প্রবণতা। দেখা যাচ্ছে, কিছু শিক্ষক নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা, বুদ্ধি-বিবেচনাকে কোরবানি দিয়েছেন; বিবেক বৈকল্যের শিকার এসব শিক্ষক নিজ স্বার্থে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ‘প্রমোশন’ পেয়ে রীতিমতো এখন ভিসিপন্থী রেগুলার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে; তারা এমনকি শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা করছে, হুমকি জারি রেখেছে। হামলার আগে বাতি নিভিয়ে দিচ্ছে, মুখে কাপড় বাঁধছে, পুলিশকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পাঠক জানেন, বুয়েটে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, শিক্ষকেরা ব্যস্ত আন্দোলনে। ছাত্ররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাধ্য হয়ে মিছিল করছে, রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পাঠাচ্ছে, তারা ক্লাসে ফিরতে চায়। শাহজালাল, রাজশাহী, কুয়েট, রুয়েট ও চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যািলয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু সংবাদ ছাপা হচ্ছে, তবে রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে সবার দৃষ্টি কাড়েনি।
এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ, উদ্বেগজনক আর যারপরনাই নিন্দনীয়। পত্রিকায় দেখেছি, সেখানকার উপাচার্য ক্ষমতাসীন দলের কিছু ছাত্রকর্মী দিয়ে নিজ স্বার্থে গড়ে তোলা উপদলকে এখন ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত করেছেন। আন্দোলন দমনে তিনি এই বাহিনীকে ব্যবহার করছেন। ২৯ এপ্রিল পত্রিকায় খবর এসেছে, ভিসির সেই বাহিনী যখন ছাত্রদের ওপর হামলা করছিল এবং আক্রান্ত ছাত্ররা প্রশাসনের সহায়তা চাচ্ছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দূরে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের দক্ষতা দেখছিলেন। ন্যক্কারজনক এই ঘটনার সঙ্গে বিএনপির আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশি অভিযানের মিল পাই, সেদিনও প্রশাসন আক্রমণকারী পুলিশকে সহায়তা করেছিল। আগের শাসকদের মতো বর্তমান শাসকদলের ছাত্রসংগঠন নানা অকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। জমি দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা—সবকিছুতে তারা আছে। অপকর্ম করে ধরা পড়লেই তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ওই ক্যাম্পাসে আমাদের শাখা নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অপরাধীরা পুলিশ প্রটেকশন পাচ্ছে, জয় বাংলা বলে হামলা চালাচ্ছে, হামলার পর মিছিল-মিটিং করছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার না করে আদাব-সালাম দিচ্ছে। সামলানোর বদলে দলীয় সাইনবোর্ডওয়ালা এই অপরাধীদের সঙ্গে তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা সাপ-লুডু খেলছেন; ফলে সারা দেশের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ বেপরোয়া আচরণ করছে। এর আগে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা ওই ক্যাম্পাসে ১০০টি ধর্ষণ করে উত্সব করেছে। তখনো তাদের শাস্তি হয়নি। জমি দখলের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ২০১০ সালে নিজ দলের কর্মীদের পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে তারা আবার আলোচনায় আসে। এ বছরের ১০ জানুয়ারি তারা নিজ দলের কর্মী জুবায়েরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জুবায়ের খুন হওয়ার পর সেখানে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষার পরিবেশ আর নিজ জীবনের নিরাপত্তার যে আন্দোলন শুরু করেছিল, উপাচার্য সে আন্দোলনের বিপক্ষে নিজে শুধু দাঁড়াননি, বরং খুনিদের রক্ষায় ও আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতে সব পথ-পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় বিবেচনায় ৩২ জন শিক্ষক নিয়োগ দিলে শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করেন। তাঁরা জুবায়ের হত্যার বিচার, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ, শিক্ষক সমিতির সভাপতির লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার, সব মতের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সহাবস্থান, গণনিয়োগ বন্ধসহ ৮ দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। উল্লেখ্য, শিক্ষকেরা শুরুতে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলেননি। দুই মাস ধারাবাহিক আন্দোলনের পরেও দাবি না মানায় তাঁরা উপাচার্যের পতনের আন্দোলনে নেমেছেন। সেই আন্দোলন দমনে নানা ফন্দি-ফিকির করছেন উপাচার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য নিজের পদ ধরে রাখতে নিত্যনতুন যে সব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তা কি সরকার বুঝতে পারছে না? প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ আসতে পারে না বা যেতেও পারে না। কর্তৃপক্ষের ডাকে ক্যাম্পাসে আসা পুলিশ ২৮ এপ্রিল সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলার আগে কেন ভিসির বাড়ির সামনে থেকে চলে গেল? কার ইশারায় সব বাতি নিভে গেল? আর তখন জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগ নামধারীরা হামলে পড়ল? হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সাভার থানা কেন মামলা নিল না?
আমরা বিশ্বাস করি, এদের পেছনে উপাচার্য রয়েছেন, সরকারের কেউ কেউ রয়েছেন। যে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না, আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এই সিরিজ অপকর্মগুলো করানো হচ্ছে। এর দায় সেই উপাচার্যের, যিনি সুবচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শক্তি, দম্ভ, কূটকৌশল আর ভাড়াটিয়া মাস্তান দিয়ে নিজ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছেন। রুচি-নীতি-দায়িত্ববোধ থেকে তিনি যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। ভাবতে অবাক লাগে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য কী করে ভাড়াটিয়া বাহিনী পাঠান তাঁর সহকর্মীদের পেটাতে? একজন অভিভাবক তাঁর সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিত হন—ভাবেন, শিক্ষক তাঁর সন্তানকে বিপদে আগলে রাখবেন, পাশে দাঁড়াবেন।
এর বাইরে বুয়েটের অচলাবস্থা নিয়ে ২১ দিনে মাত্র দুটি সভা করে সরকার কিছু সুপরামর্শ দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী হরতালের কারণে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎনিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কিছুই বলছেন না। পরিস্থিতি এতটাই ভীতিকর যে একজন শিক্ষক বুয়েটের পরিস্থিতি নিয়ে ২৯ এপ্রিল প্রথম আলোতে নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু ভয়ে নিজের পরিচয় প্রকাশ করনেনি। আমরা মনে করি, এখন সরকারের বসে থাকার সময় নেই, যেভাবে হোক বুয়েট খুলে দিতে হবে। এক-দুজন বা ১০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার গোঁয়ার্তুমির কাছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন জিম্মি থাকতে পারে না। শিক্ষক নিয়োগ বা ফল প্রকাশে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। এর চেয়েও যে গভীর উপলব্ধি তা হলো—জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক যে ধর্মঘট চলছে, তা হয়তো ভেঙে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই, কিন্তু মুক্তচিন্তায় যে জট লেগেছে, জ্ঞানচর্চায় যে স্থায়ী ধর্মঘট চলছে, তা ভাঙবে কবে?
লেখকেরা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, প্রকৌশলী ও আইনজীবী।
No comments