হাসিনা না চাইলে টিপাইমুখ নয়-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by অমিত বসু

ন্য রাজ্যের সঙ্গে মণিপুরের মৌলিক তফাত আছে। পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা রাজ্যটির নদীর রুট পরিবর্তনে কোনো শঙ্কা নেই। বাধা দিলেও নয়। অন্য জায়গায় সেই বিপদ থেকে যায়। ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশকে বিপদে ফেলেছে। গঙ্গা গতিপথ পাল্টেছে। বাংলাদেশে নদীর স্রোত শীর্ণ হয়েছে। পনের বছর আগে জ্যোতি বসুর উদ্যোগে গঙ্গা চুক্তিস্বাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশ অনেকটা রিলিফ পেয়েছে। তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সেচের জল
পেয়ে বাঁচবে পারিজাত জন্মায় জন্নাতে আর মণিপুরে। পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। চারা নিয়ে অন্যত্র চাষের চেষ্টায় সাফল্য আসেনি। অপূর্ব পুষ্পের গরবে সরব মণিপুরিরা। পারিজাত ফুলে গোলাপের মতো কাঁটা নেই। নিদ্বর্িধায় ছোঁয়া যায়। একটু দূরে টিপাইমুখে সংকটের শিকড়। বরাক নদী নিয়ে বিভ্রাট। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ই বোবি সিং বারবার ফোন করছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছেন একটা কথাই, দেখবেন কোনো কারণেই যেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে। বরাক যেমন আমাদের, তেমন বাংলাদেশেরও। ভ্রাতৃপ্রতিম ভাবনায় আমরা নদী ভাগ করে নেব। কোনো বিতর্কের কাঁটা যেন না থাকে।
মণিপুরের রাজ্যপাল গুরুবচন জগৎ দিলি্ল-ইম্ফলের মধ্যে শাটল ককের মতো ছোটাছুটি করছেন। পাঞ্জাবের মানুষ হয়েও দুর্ভাবনায় মণিপুরের সঙ্গে মিশে আছেন। মুশকিল আসানে সেই মনমোহন। তিনি বলছেন, চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ক্ষতি করে মণিপুরের লাভের ভাড়ার ভর্তি করার চেষ্টা হবে না কখনোই।
এই মণিপুরকে চিনতই না অবিভক্ত ভারত। ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেই চেনানোর দায়িত্ব নেন। মণিপুরি নাচকে বিশ্বের দরবারে হাজির করেন। মণিপুরি নৃত্যে পায়ের চেয়ে হাতের ব্যবহার বেশি। নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতায় প্রেম প্রকাশ পায়। শান্তিনিকেতনে এই নাচের প্রচলন হয় ধীরে ধীরে। মণিপুরের অর্থ রত্নের রাজ্য। রাজনীতিতে তাদের আগ্রহ কম। সংস্কৃতিতে আশ্চর্য ঐশ্বর্য, রাজনীতিতে দুর্বল। সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। অতীত নয়, ভবিষ্যৎ নয়, ঝোঁক শুধু বর্তমানে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরেও আরও ক্ষমতার দাবি ওঠে। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা নিয়ে কথা তুলতে চায়। সেই দাবি পূরণ হয় ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি। মণিপুরে প্রভাবশালী দল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের জায়গা হয়নি। মণিপুর মনে করে, নেগেটিভ রাজনীতিতে রাজ্যের আরও পিছিয়ে পড়া। বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা চুক্তিতে মমতা যখন আপত্তি করেছেন মন থেকে মানতে পারেনি মণিপুর। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এটা কী করে হয়। মমতার দ্বিধা থাকলে আগে বলতে পারতেন। মনমোহনের সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা মেটানো যেত। তা না করে শেষ মুহূর্তে বাদ সাধলেন। এতে মনমোহনের মুখ পুড়ল। ভারত লজ্জায় পড়ল। মমতা পাল্টা অভিযোগ ছুড়ে গা বাঁচাতে চাইলেন। তার বক্তব্য, তাকে চুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই যদি হবে, তিনি মনমোহনের সঙ্গে ঢাকায় যেতে রাজি হলেন কেন? আগেই বলতে পারতেন চুক্তিতে তার সম্মতি নেই। বিষণ্ন হৃদয়ে মনমোহন ঢাকা থেকে ফেরার পথে সাংবাদিকদের বলেছেন, মমতার সঙ্গে চুক্তির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তার সম্মতি নিয়েই চুক্তি করতে এগিয়েছি।
মনমোহনের অফিসিয়াল স্টেটমেন্টের পর মমতা চুপ। কী বলবেন তিনি। বলার থাকলই-বা কী? মমতা এই রকমই। তাকে বিশ্বাস করা দুঃসাধ্য।
নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থেই কি মমতা চুক্তি থেকে পিছিয়েছেন? প্রশ্নটা উঠেছে। উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলায় তৃণমূল দুর্বল। যেখানে শিকড় গাড়তে সংবেদনশীল বার্তা দিতে চেয়েছেন। তিস্তার ভাগ যাতে বাংলাদেশকে দিতে না হয় সে জন্যই সিদ্ধান্ত বদল। উদ্দেশ্য উত্তরবঙ্গের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় তার সচেতনতা তুলে ধরা।
পরে যখন বুঝলেন এই বার্তায় কাজ হয়নি তখন ভাবনার গতিপথ পাল্টালেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে মহাকরণে বৈঠকে তিস্তা চুক্তির স্বপক্ষে রায় দিলেন। এত কিছুর দরকার ছিল না যদি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা থাকত। বাংলাদেশের তিস্তার দাবি বাস্তবসম্মত। জোর করে তিস্তা আটকে রাখাটা আন্তর্জাতিক অপরাধ।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কটা অত্যন্ত সংবেদনশীল। কোনোভাবেই যাতে দু'দেশের মধ্যে আস্থা বা বিশ্বাস না টলে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। মমতা সে কথা বিবেচনার মধ্যে না রেখে সমস্যার ফানুস ওড়ালেন। আবার সেই ফানুস টেনে নামানোর চেষ্টা করলেন। তারই নির্দেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। হাসিনাকে সম্মানিত করা হবে। মমতার আগেই কিন্তু ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিস্তা চুক্তি অনিবার্য জেনেই মমতার রাস্তা বদল। কিন্তু তিস্তা চুক্তি স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মনে যে চরম আঘাত, তার খেসারত কে দেবে?
মণিপুর মমতার কাণ্ডকারখানা দেখে হতভম্ব। তারা ভাবতেই পারেনি মমতা এমনটা করতে পারেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা রাজনীতি-কূটনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। তার চেয়ে বেশি। বন্ধুত্বের নিগড়ে বাঁধা। মণিপুরের মানুষ শান্তিপ্রিয়। ঝুট-ঝামেলা একেবারেই পছন্দ নয়। সেখানে উপজাতিদের আধিপত্য। তারা সরল মনের মানুষ। মহিলা প্রাধান্যও চোখে পড়ার মতো। ভারতের অন্য সব রাজ্যের থাকলে সেটা দৃষ্টান্ত। রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মেইথেই উপজাতির। তাদের সমাজে মহিলারা উচ্চ মর্যাদা পান। সব বিষয়ে মেয়েদের কথাই শেষ কথা। পুরুষরা শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মমতার আচরণ মণিপুরি মেয়েদের বিচলিত করেছে। তারা ভাবতেই পারেন না কোনো নেত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারেন।
মণিপুরে ৯টি জেলা, ২ হাজার ১৯৯টি গ্রাম। শহর ৩৩। রাজধানী ইম্ফল ছাড়া চুরাচাদপুর, তামেংলং যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ শহর। গ্রামে-শহরে বর্তমানে সব থেকে সমস্যা বিদ্যুৎ। ভরসা বরাক নদী। খরস্রোতা এই নদীর তেজে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে অনায়াসে। সেই লক্ষ্যেই টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। মণিপুরে জল অনেক। আলো কম। বাংলাদেশকে জল না দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বরং বর্ষায় বরাকের জলে বাংলাদেশ যাতে প্লাবিত না হয় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
অন্য রাজ্যের সঙ্গে মণিপুরের মৌলিক তফাত আছে। পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা রাজ্যটির নদীর রুট পরিবর্তনে কোনো শঙ্কা নেই। বাধা দিলেও নয়। অন্য জায়গায় সেই বিপদ থেকে যায়। ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশকে বিপদে ফেলেছে। গঙ্গা গতিপথ পাল্টেছে। বাংলাদেশে নদীর স্রোত শীর্ণ হয়েছে। পনের বছর আগে জ্যোতি বসুর উদ্যোগে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশ অনেকটা রিলিফ পেয়েছে। তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সেচের জল পেয়ে বাঁচবে। তিস্তা চুক্তি বিলম্বিত হলেও চুক্তি যে হচ্ছেই মনমোহন সিং সে কথা ঘোষণা করেছেন। সে সঙ্গে এ কথাও জানিয়েছেন, বরাক নিয়ে বিপদের কারণ নেই। বরং টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশও লাভবান হবে। প্রকল্পে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে তার বড় অংশ বাংলাদেশকে দেওয়া হবে। গ্রিড তৈরি করে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যাতে দ্রুত কাজটা শেষ হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। টিপাইমুখ থেকে বিদ্যুৎ পেলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকটা মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া টিপাইমুখ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মনমোহনকে চিঠি দিয়েছিলেন। মনমোহন তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছেন। জরুরি চিঠিতে বলেছেন, টিপাইমুখ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করার প্রশ্ন নেই।
শেখ হাসিনার দুই উপদেষ্টা মসিউর রহমান, গওহর রিজভী মনমোহনের সঙ্গে দেখা করে টিপাইমুখ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কথায় কথায় সব প্রশ্নের নিরসন হয়েছে। মনমোহন তবু বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞদের টিপাইমুখ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মনমোহনের মন্তব্য, তারা সব দেখেশুনে গ্রিন সিগন্যাল দিলেই প্রকল্পের কাজ এগোবে। যেহেতু বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় তাই দু'দেশ সহমত না হলে চলে না।
মনমোহনের সব থেকে বড় ভরসা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ই বোবি সিং। তিনি কংগ্রেস নেতা। পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্যা সেটা মণিপুরে হবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল সভানেত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের শরিক মাত্র। তাকে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ মনমোহনের নেই। ওকরাম জানিয়েছেন, মনমোহন যা বলবেন সেটাই তার কাছে চূড়ান্ত। মনমোহন বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের মতামতই শেষ কথা। এ নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতার কোনো অবকাশ নেই। পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটি দুঃখজনক। মণিপুর কখনোই দুর্ভাবনার কারণ হবে না।
আপাতত টিপাইমুখ বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরতি। বাংলাদেশ সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত ভারত থমকে থাকবে। সিগন্যাল দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের। তারা সবুজ আলো দেখালে প্রকল্পের কাজ ফের চলতে শুরু করবে।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.