নারী নির্যাতন-আপনিই কি সেই পুরুষ? by আইরিন খান
স্ত্রীর ডান হাতের পাঁচটি আঙুল কেটে নিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম, কারণ স্ত্রী জুঁই তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলেজে পড়ালেখা চালাচ্ছিলেন। হাসান সাঈদ সুমন তাঁর স্ত্রী রুমানার চোখে আঙুল ঢুকিয়ে তাঁকে অন্ধ করে দেন। তাঁরও ইচ্ছা, পূর্ণবৃত্তিপ্রাপ্ত রুমানা কানাডায় পিএইচডি করতে ফিরে না যাক। রফিকুল ও সাঈদের আক্রোশ বিরল হলেও তাঁদের প্রতিক্রিয়ার ধরন কোনোভাবেই বিরল নয়। আমাদের সমাজে নারীদের শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়ার চল ব্যাপকভাবে
স্বীকৃত। এটা পুরুষের ‘অধিকার’ ও নারীর ন্যায্য পাওনা। এসিড আক্রমণ, উত্ত্যক্ত করা, ব্যাপকভাবে স্ত্রীদের প্রহার এবং গ্রামীণ সালিসে নারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার মতো ঘটনা পুরুষের এই ‘বিশেষাধিকারের’ সামাজিক সাক্ষ্য বহন করে।
আমাদের সংস্কৃতি ও রীতিতে—আইন ও ধর্মের দ্বারা জোরদার হয়ে—পুরুষকে ভাবা হয় রক্ষক, প্রতিপালক, জন্মদাতা ও হুকুমদাতা হিসেবে। আর নারীকে দেখা হয় অধীনস্ত ও ঘরকুনে সেবাদাত্রী। কিন্তু এসব সাবেকি ধ্যান-ধারণা দিনে দিনে বাস্তবতাবর্জিত হয়ে পড়ছে। যেমন, জুঁই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হলেও তাঁর স্বামী মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। রুমানা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিদেশে পূর্ণবৃত্তি পাওয়া বিদ্বান, তখন তাঁর স্বামী (তিনি সম্প্রতি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন) একজন বেকার প্রকৌশলী।
বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরজুড়েই নারী-পুরুষের অবস্থান বদলাচ্ছে—অনেক নারীর জন্যই তা খুবই ধীরে এবং কিছু পুরুষের জন্য খুবই দ্রুতগতিতে। নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে অথবা যে পিতৃতান্ত্রিক-ব্যবস্থায় তাঁরা সুবিধাভোগী সেই ব্যবস্থা রক্ষার জন্য, অথবা পুরুষপ্রাধ্যান্যের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অথবা তাঁদের আহত পৌরুষ উদ্ধারে এ ধরনের পুরুষেরা সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছেন, ঘরে বউ পেটাচ্ছেন অথবা বাইরে মেয়ে ও মহিলাদের উৎপীড়ন করছেন। জুঁই ও রুমানার ঘটনা দুটি এই প্রতিক্রিয়ারই নজির।
যেসব পুরুষ সহিংসতা ঘটান, তাঁদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। কিন্তু আইন, নীতিমালা বা শাস্তি এই সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট নয়।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হলো লিঙ্গ-বৈষম্যকে জোরদার ও অক্ষয় করার হাতিয়ার। কাঠামোগত পর্যায়ে পিতৃতন্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ যে ব্যবস্থা নারীকে পুরুষের অধীন ভাবে, তার দ্বারা এটা টিকে থাকে। এবং যে সামাজিক প্রত্যাশাগুলো ঠিক করে দেয় যে ছেলে বা পুরুষেরা কীভাবে আচরণ করবে, লিঙ্গ-অধ্যয়নে তাকেই বলা হয় পৌরুষ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা পুরুষের ভয়, অবদমিত আবেগ এবং অক্ষমতার বোধের সঙ্গে জড়িত। পুরুষেরা জন্মগতভাবে সহিংস নয়, তারা সহিংস এবং অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে পিততৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে।
বাংলাদেশের তরুণেরা যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে, সেই পরিবেশের গভীরে প্রোথিত রয়েছে পিততৃান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সহিংসতা, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যাটাগিরি। বাস-ট্রাকে আগুন ধরানো, দোকানপাটের কাচ ভাঙা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পেটানো; কোমর দোলানো ও গুলি ফোটানো বলিউড নায়কদের বন্দনার মধ্যে দিয়ে যার প্রকাশ ঘটে। যে সহিংসতা পুরুষেরা দেখে এবং তাদের অনেকে যে সহিংসতা জনজীবনে ছড়িয়ে দেয়, তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেও তার ছায়া পড়ে।
যে সংস্কৃতি পুরুষের এমন ভূমিকা ও পরিচয় গঠন করে, সেই সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং বদলানো প্রয়োজন। কিন্তু এসব পরিবর্তন ঘটানোর মতো পুরুষ-নেতা কোথায়? নারীর ওপর সহিংসতা বন্ধের কাজ করেন মূলত নারীরাই এবং এর লক্ষ্যও থাকে নারীরা। লিঙ্গ-সমতাকেও ভাবা হয় ‘নারী ইস্যু’ হিসেবে, অথচ নারী-পুরুষ উভয়কেই এতে জড়ানো দরকার।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের কৌশলে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর কর্মসংস্থানকে। কেন তা করা হয় তা যেমন বোধগম্য, তেমনি এটা প্রয়োজনীয়ও; কেননা নারীরাই লিঙ্গ-বৈষম্যের শিকার হয়। একই সঙ্গে পুরুষদের দায়িত্বও নিতে হবে। তাদেরও এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতায় সব পুরুষই জড়িত হয়ে যায়—একদল কাজটা করে অন্যরা, নীরবতা দিয়ে এতে সম্মতি জানায় অথবা এসব বন্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয় না। পুরুষ হলো এই সমস্যার অংশ; তাদের অবশ্যই এর সমাধানের অংশীদার হতে হবে।
সব পুরুষই সহিংস নয় এবং পুরুষত্বের বিকল্প চেহারাও রয়েছে। এর অনেকটা আমরা জানি, আবার অনেকটাই কম জানা। বেগম সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামাল তাঁর আত্মজীবনীতে স্মরণ করেছেন, ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবাকে বহুভাবে তাঁর মাকে সহযোগিতা করতে দেখেছেন। এমনকি তিনি তাঁর মায়ের ভেজা শাড়ি শুকাতেও দিতেন। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে এসব খুবই ‘মেয়েলি’ কাজ। স্ত্রীর সমান অংশীদার হিসেবে আগের প্রজন্মের এই মানুষটি গেরস্থালি কাজে হাত লাগিয়ে লৈঙ্গিক সমতার ব্যাপারে যে আলোকিত অবস্থান দেখিয়েছেন, তা আজকের অনেক পুরুষ ও কর্মজীবী নারীর মধ্যেও দেখা যায় না। আমাদের গণমাধ্যমেরও উচিত এ ধরনের আদর্শ ব্যক্তিদের তুলে ধরায় অনেক কিছু করা।
লিঙ্গ-বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশের পুরুষদের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনটা আজ জ্বলন্ত। মসজিদ, গ্রামীণ সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রকর্মীরাই হলেন বাংলাদেশের পুরুষদের প্রধান প্রধান নেটওয়ার্ক। কিন্তু যে সমাজ ও মূল্যবোধ থেকে তাঁরা তাঁদের বর্তমান সুবিধা ও শক্তি পেয়ে থাকেন, তাকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ জানাবেন বা বিপদাপন্ন করবেন, তাঁদের কাছে এমন কিছু আশা করা খুবই অনাড়িপনা হবে। কিছু এনজিও ইমাম ও গ্রামীণ মুরব্বিদের এ বিষয়ে সজাগ করার কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু নারীদের প্রতি অবিচার দূর করায় পুরুষদের মধ্যে যে ব্যাপক আন্দোলন প্রয়োজন, এগুলো তার ধারে-কাছেও নেই।
১৫ বছর আগে ভারতের এক পুরুষ সাংবাদিক পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনটা ছিল এ রকম: ‘সন্ধান চাই: এমন পুরুষ, যিনি বিশ্বাস করেন স্ত্রীরা পেটানোর জন্য নয়’। এতে যাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল মুম্বাইভিত্তিক ‘সহিংসতা ও আগ্রাসনবিরোধী পুরুষ সংঘ’ (এমএভিএ)। এই সংগঠনের নেতারা সবাই পুরুষ। তাঁরা সনাতন পুরুষপ্রধান মনোভাবের বদল এবং নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করার লক্ষ্যে পুরুষদের মধ্যে কাজ করেন। ক্রমেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের সংগঠনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও আমাদের প্রয়োজন এমন সুবিধা ও পরিসর তৈরি করা, যেখানে পুরুষ ও বালকেরা যেসব সমস্যা থেকে সহিংস হয়ে ওঠে, সেসব নিয়ে তারা আলোচনা করবে এবং এগুলোর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজবে। পুরুষদের অবশ্যই পরিবর্তনের কারিকাশক্তি হয়ে উঠতে হবে।
যেমন নারীর ক্ষমতায়নে নারী আন্দোলন রয়েছে, তেমনি পুরুষের ‘মুক্তির’ জন্য চাই পুরুষদের আন্দোলন। যে আন্দোলন পুরুষদের অন্যভাবে ভাবতে ও কাজ করতে সাহায্য করবে, পৌরুষ সম্পর্কে তাদের নতুন করে ভাবাবে এবং নারী ও বালিকাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে নতুন করে গড়ার পথ দেখাবে।
যে পুরুষেরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে কি কেউ আছেন, যিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সেসব পুরুষকে খুঁজবেন, যাঁরা তাঁদের স্ত্রীদের পেটান না। এ ধরনের একটি আন্দোলন শুরু করার জন্য তিনি কি ওই সব পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করবেন? পাঠক, আপনিই কি সেই পুরুষ?
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আইরিন খান: মানবাধিকারকর্মী; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব।
আমাদের সংস্কৃতি ও রীতিতে—আইন ও ধর্মের দ্বারা জোরদার হয়ে—পুরুষকে ভাবা হয় রক্ষক, প্রতিপালক, জন্মদাতা ও হুকুমদাতা হিসেবে। আর নারীকে দেখা হয় অধীনস্ত ও ঘরকুনে সেবাদাত্রী। কিন্তু এসব সাবেকি ধ্যান-ধারণা দিনে দিনে বাস্তবতাবর্জিত হয়ে পড়ছে। যেমন, জুঁই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হলেও তাঁর স্বামী মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। রুমানা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিদেশে পূর্ণবৃত্তি পাওয়া বিদ্বান, তখন তাঁর স্বামী (তিনি সম্প্রতি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন) একজন বেকার প্রকৌশলী।
বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরজুড়েই নারী-পুরুষের অবস্থান বদলাচ্ছে—অনেক নারীর জন্যই তা খুবই ধীরে এবং কিছু পুরুষের জন্য খুবই দ্রুতগতিতে। নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে অথবা যে পিতৃতান্ত্রিক-ব্যবস্থায় তাঁরা সুবিধাভোগী সেই ব্যবস্থা রক্ষার জন্য, অথবা পুরুষপ্রাধ্যান্যের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অথবা তাঁদের আহত পৌরুষ উদ্ধারে এ ধরনের পুরুষেরা সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছেন, ঘরে বউ পেটাচ্ছেন অথবা বাইরে মেয়ে ও মহিলাদের উৎপীড়ন করছেন। জুঁই ও রুমানার ঘটনা দুটি এই প্রতিক্রিয়ারই নজির।
যেসব পুরুষ সহিংসতা ঘটান, তাঁদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। কিন্তু আইন, নীতিমালা বা শাস্তি এই সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট নয়।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হলো লিঙ্গ-বৈষম্যকে জোরদার ও অক্ষয় করার হাতিয়ার। কাঠামোগত পর্যায়ে পিতৃতন্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ যে ব্যবস্থা নারীকে পুরুষের অধীন ভাবে, তার দ্বারা এটা টিকে থাকে। এবং যে সামাজিক প্রত্যাশাগুলো ঠিক করে দেয় যে ছেলে বা পুরুষেরা কীভাবে আচরণ করবে, লিঙ্গ-অধ্যয়নে তাকেই বলা হয় পৌরুষ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা পুরুষের ভয়, অবদমিত আবেগ এবং অক্ষমতার বোধের সঙ্গে জড়িত। পুরুষেরা জন্মগতভাবে সহিংস নয়, তারা সহিংস এবং অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে পিততৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে।
বাংলাদেশের তরুণেরা যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে, সেই পরিবেশের গভীরে প্রোথিত রয়েছে পিততৃান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সহিংসতা, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যাটাগিরি। বাস-ট্রাকে আগুন ধরানো, দোকানপাটের কাচ ভাঙা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পেটানো; কোমর দোলানো ও গুলি ফোটানো বলিউড নায়কদের বন্দনার মধ্যে দিয়ে যার প্রকাশ ঘটে। যে সহিংসতা পুরুষেরা দেখে এবং তাদের অনেকে যে সহিংসতা জনজীবনে ছড়িয়ে দেয়, তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেও তার ছায়া পড়ে।
যে সংস্কৃতি পুরুষের এমন ভূমিকা ও পরিচয় গঠন করে, সেই সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং বদলানো প্রয়োজন। কিন্তু এসব পরিবর্তন ঘটানোর মতো পুরুষ-নেতা কোথায়? নারীর ওপর সহিংসতা বন্ধের কাজ করেন মূলত নারীরাই এবং এর লক্ষ্যও থাকে নারীরা। লিঙ্গ-সমতাকেও ভাবা হয় ‘নারী ইস্যু’ হিসেবে, অথচ নারী-পুরুষ উভয়কেই এতে জড়ানো দরকার।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের কৌশলে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর কর্মসংস্থানকে। কেন তা করা হয় তা যেমন বোধগম্য, তেমনি এটা প্রয়োজনীয়ও; কেননা নারীরাই লিঙ্গ-বৈষম্যের শিকার হয়। একই সঙ্গে পুরুষদের দায়িত্বও নিতে হবে। তাদেরও এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতায় সব পুরুষই জড়িত হয়ে যায়—একদল কাজটা করে অন্যরা, নীরবতা দিয়ে এতে সম্মতি জানায় অথবা এসব বন্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয় না। পুরুষ হলো এই সমস্যার অংশ; তাদের অবশ্যই এর সমাধানের অংশীদার হতে হবে।
সব পুরুষই সহিংস নয় এবং পুরুষত্বের বিকল্প চেহারাও রয়েছে। এর অনেকটা আমরা জানি, আবার অনেকটাই কম জানা। বেগম সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামাল তাঁর আত্মজীবনীতে স্মরণ করেছেন, ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবাকে বহুভাবে তাঁর মাকে সহযোগিতা করতে দেখেছেন। এমনকি তিনি তাঁর মায়ের ভেজা শাড়ি শুকাতেও দিতেন। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে এসব খুবই ‘মেয়েলি’ কাজ। স্ত্রীর সমান অংশীদার হিসেবে আগের প্রজন্মের এই মানুষটি গেরস্থালি কাজে হাত লাগিয়ে লৈঙ্গিক সমতার ব্যাপারে যে আলোকিত অবস্থান দেখিয়েছেন, তা আজকের অনেক পুরুষ ও কর্মজীবী নারীর মধ্যেও দেখা যায় না। আমাদের গণমাধ্যমেরও উচিত এ ধরনের আদর্শ ব্যক্তিদের তুলে ধরায় অনেক কিছু করা।
লিঙ্গ-বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশের পুরুষদের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনটা আজ জ্বলন্ত। মসজিদ, গ্রামীণ সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রকর্মীরাই হলেন বাংলাদেশের পুরুষদের প্রধান প্রধান নেটওয়ার্ক। কিন্তু যে সমাজ ও মূল্যবোধ থেকে তাঁরা তাঁদের বর্তমান সুবিধা ও শক্তি পেয়ে থাকেন, তাকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ জানাবেন বা বিপদাপন্ন করবেন, তাঁদের কাছে এমন কিছু আশা করা খুবই অনাড়িপনা হবে। কিছু এনজিও ইমাম ও গ্রামীণ মুরব্বিদের এ বিষয়ে সজাগ করার কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু নারীদের প্রতি অবিচার দূর করায় পুরুষদের মধ্যে যে ব্যাপক আন্দোলন প্রয়োজন, এগুলো তার ধারে-কাছেও নেই।
১৫ বছর আগে ভারতের এক পুরুষ সাংবাদিক পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনটা ছিল এ রকম: ‘সন্ধান চাই: এমন পুরুষ, যিনি বিশ্বাস করেন স্ত্রীরা পেটানোর জন্য নয়’। এতে যাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল মুম্বাইভিত্তিক ‘সহিংসতা ও আগ্রাসনবিরোধী পুরুষ সংঘ’ (এমএভিএ)। এই সংগঠনের নেতারা সবাই পুরুষ। তাঁরা সনাতন পুরুষপ্রধান মনোভাবের বদল এবং নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করার লক্ষ্যে পুরুষদের মধ্যে কাজ করেন। ক্রমেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের সংগঠনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও আমাদের প্রয়োজন এমন সুবিধা ও পরিসর তৈরি করা, যেখানে পুরুষ ও বালকেরা যেসব সমস্যা থেকে সহিংস হয়ে ওঠে, সেসব নিয়ে তারা আলোচনা করবে এবং এগুলোর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজবে। পুরুষদের অবশ্যই পরিবর্তনের কারিকাশক্তি হয়ে উঠতে হবে।
যেমন নারীর ক্ষমতায়নে নারী আন্দোলন রয়েছে, তেমনি পুরুষের ‘মুক্তির’ জন্য চাই পুরুষদের আন্দোলন। যে আন্দোলন পুরুষদের অন্যভাবে ভাবতে ও কাজ করতে সাহায্য করবে, পৌরুষ সম্পর্কে তাদের নতুন করে ভাবাবে এবং নারী ও বালিকাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে নতুন করে গড়ার পথ দেখাবে।
যে পুরুষেরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে কি কেউ আছেন, যিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সেসব পুরুষকে খুঁজবেন, যাঁরা তাঁদের স্ত্রীদের পেটান না। এ ধরনের একটি আন্দোলন শুরু করার জন্য তিনি কি ওই সব পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করবেন? পাঠক, আপনিই কি সেই পুরুষ?
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আইরিন খান: মানবাধিকারকর্মী; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব।
No comments