এই দিনে-জননায়কের প্রত্যাবর্তন

স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত রাজধানীর উন্মুক্ত আকাশে বার কয়েক চক্কর দেয় সাদা কমেট বিমানটি। ভারতীয় ওই বিমানটিতে রয়েছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনমানুষের প্রিয় নেতা। শত্রুদেশে যিনি বেঁচে আছেন, নাকি নিহত হয়েছেন, সেই আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশের জনতা। তাই স্বস্তিতে রাজপথে নেমে এসেছে তারা। সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশ বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রানিং কমেন্ট্রিটি কি বঙ্গবন্ধু


শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিবরণ প্রচারের মধ্য দিয়ে হয়েছিল? আজ যেখানে কর্মকমিশন অফিস, তার সবচেয়ে ওপরের তলায় ছিল বাংলাদেশ বেতারের অস্থায়ী সম্প্রচারকক্ষ। বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন সেশন ডিরেক্টর কামাল লোহানী, তাঁর সঙ্গে আশফাকুর রহমান। সেখানে আরও আছেন ভারতের অল ইন্ডিয়া রেডিওর তিনজন কর্মী, যাঁদের একজন হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেদিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক কামাল লোহানী। বলছিলেন, ‘লাখো বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। বিমানের দরজা খুলতেই হাত নেড়ে জনতার অভিবাদন ও ভালোবাসার জবাব দিলেন শেখ মুজিব। বিমানের সিঁড়ি-লাগোয়া হুইল চেয়ারে তাঁর জনক শেখ লুৎফর রহমান। ক্রন্দনরত পিতা-পুত্রের আলিঙ্গন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ফুপিয়ে কাঁদছেন তাঁর প্রিয় মুজিব ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে। জনতা তাঁকে একনজর দেখার জন্য ব্যগ্র। বেতারের অস্থায়ী সম্প্রচারকক্ষ থেকে বাংলাদেশ বেতার ছাড়াও অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও ধারাবর্ণনা দেওয়া হচ্ছিল।’
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মোট চারটি অস্থায়ী সম্প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। বাকি তিনটি হচ্ছে ফার্মগেট, শাহবাগ ও রেসকোর্স ময়দান। কামাল লোহানী জানান, পরিকল্পনা ছিল তেজগাঁও সম্প্রচারকেন্দ্রের ঘোষকেরা সেখানকার ঘোষণা পর্ব শেষ করে রেসকোর্সের ঘোষণাকেন্দ্রে যাবেন, কিন্তু জনসমুদ্রের স্রোত ঠেলে তা আর সম্ভব হয়নি। ‘কোনোমতে শেখ মুজিবুর রহমানকে খোলা ট্রাকে করে রেসকোর্সমুখী হয় সবাই। কিন্তু হলে কী হবে? জনসমুদ্র এড়িয়ে চলতে পারে না সেই ট্রাক। খোলা সেই ট্রাকের প্রায় নিশ্চল চলমানতা হয়ে ওঠে যেন জলের ভেতরে নৌকার প্রতিচ্ছবি।’ বলছিলেন কামাল লোহানী।
এমনটা হবে না-ই বা কেন? আগস্টের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর পক্ষে কৌঁসুলি নিয়োগের সুযোগ পাবেন এবং তিনি হবেন পাকিস্তানের নাগরিক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে চিঠি লিখে এই বিচার বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন। যুক্তরাষ্ট্রও সংক্ষিপ্ত বিচার অনুষ্ঠানের বিরোধী। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই বিচার কী অভিঘাত সৃষ্টি করে, তা নিয়ে জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।
এরপর ১০ আগস্ট বিচার শুরু হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এ কে ইব্রাহীম ও তাঁর তিন সহযোগীকে বঙ্গবন্ধুর কৌঁসুলি নিয়োগ দেওয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর করাচির ডেটলাইনে প্রচারিত এএফপির খবরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ব্রিটিশ মান অনুযায়ী বিচারকাজ চলছে। প্রহসনের বিচার শেষ হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জানতেন না তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে একদিকে প্রবাসী সরকার চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক যুদ্ধ, অন্যদিকে বাঙালিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে রয়েছে যুদ্ধের মাঠে। তিনি জানতেন না গণহত্যা কিংবা ভারতে লাখ লাখ শরণার্থীর বিষয়ে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি আর সোভিয়েত রাশিয়ার পাল্টা জবাব—তা-ও জানতেন না তিনি। শুধু জানতেন মৃত্যুর রায় হয়ে গেছে। কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসির সব রকম ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল, যাতে ওই আদেশ-সংবলিত বিশেষ টেলিগ্রামটি পৌঁছানো মাত্রই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই টেলিগ্রাম পৌঁছানোর আগেই বাংলার রুখে দাঁড়ানো সংগ্রামী জনতা পর্যুদস্ত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এবং রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানি জেনারেল এ কে নিয়াজী। কারাগার থেকে সামরিক প্রহরায় শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরের এক বাংলোয় আটকে রাখা হয়। ২৭ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ২১ দিন পর ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাহাত্তর সালের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যাবেলা শেখ মুজিবকে বলা হলো ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে বিমান অপেক্ষা করছে। তবে বাংলাদেশে সরাসরি নয়, কৌশলগত কারণে মুজিবকে বহনকারী বিমান প্রথমে লন্ডনে যায়। পরদিন স্থানীয় সময় সাড়ে ছয়টার দিকে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছায় বিশেষ বিমানটি। ব্রিটেনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।’
বিশ্বনেতাদের কাছে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। এরপর ১০ জানুয়ারি দিনের প্রথমভাগে নয়াদিল্লিতে পৌঁছান তিনি। যুদ্ধে সহায়তাদানকারী ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারত সরকারের প্রায় সব সদস্য এবং উৎফুল্ল ভারতবাসীর সামনে তিনি ভাষণ দেন দিল্লি এয়ারপোর্টে নির্মিত মঞ্চে। তিনি বলেন, ‘এই অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির দিকে।’ (সূত্র: রবার্ট পেইন; ম্যাসাকার, নিউইয়র্ক ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪১)।
শেখ মুজিবকে নিয়ে ভারতের কমেট বিমানটি বেলা একটা ৪৫ মিনিটের দিকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বাংলার মাটি ফিরে পায় তার আপন সন্তানকে।
এম এম খালেকুজ্জমান

No comments

Powered by Blogger.