গদ্যকার্টুন-যদি উটপাখি কিনতে পাওয়া যেত! by আনিসুল হক
আমাদের সহকর্মী পলা আজিজের ছেলে আরশান। বয়স চার বছর। আরশান তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, আমাকে একটা অমুক কোম্পানির পাম্প কিনে দাও না!’ ‘তুমি পাম্প নিয়ে কী করবে?’ ‘টিভিতে বলেছে, এটা টেকসই।’
আরশান যন্ত্রপাতি ভালোবাসে। গাড়ি ভেঙে ভেতরের মোটরটা বের করে নিয়ে খেলে। এবার তার নতুন যন্ত্র দরকার। একটা পানির পাম্প। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের প্রভাব দর্শকদের ওপরে থাকেই। আরশান টেলিভিশনে প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন
আরশান যন্ত্রপাতি ভালোবাসে। গাড়ি ভেঙে ভেতরের মোটরটা বের করে নিয়ে খেলে। এবার তার নতুন যন্ত্র দরকার। একটা পানির পাম্প। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের প্রভাব দর্শকদের ওপরে থাকেই। আরশান টেলিভিশনে প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন
দেখেছে। এক রাতে সে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি গলায় বলল, ‘মা, আমি আর উটপাখির জীবন চাই না। আমি মানুষের জীবন চাই। আমাকে মানুষের জীবন কিনে দাও।’
টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয়, তার বেশির ভাগই কিনতে পাওয়া যায়। আরশানের ধারণা হয়েছে, উটপাখি নয়, মানুষের জীবনও কিনতে পাওয়া যায়।
যখন মরুঝড় আসে, তখন উটপাখি বালিতে মাথা গুঁজে থাকে, যেন কোথাও কোনো ঝড় হচ্ছে না, এমন একটা ভাব করে—এ রকম একটা প্রবাদ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। যদিও আসলে উটপাখি মরুঝড়ের সময় মাথা গুঁজে থাকে বলে জানা যায় না।
তাতে অবশ্য প্রবাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। যেমন, আমরা বলি, আঙুল ফুলে কলাগাছ, বা তার বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। বাস্তবে আঙুল ফুলে কখনো কলাগাছ হয় না, চাঁদের হাট কারও বাড়িতে তো বসেই না, আকাশেও বসে না। তবু প্রবাদ তার বলার কথাটি বলে ফেলতে পারে, সার্থকভাবে।
উটপাখির জীবন উটপাখিরও নয়, কিন্তু আমরা মানুষেরা উটপাখির জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
কত কিছু চারপাশে ঘটছে, আর আমরা বালিতে মুখ গুঁজে থাকার ভান করছি এবং ভাবছি, এভাবেই তো ভালো আছি।
সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে সরকার ও বিরোধী দলের তিন বছরের কার্যক্রম নিয়ে জনমত জরিপের ফল। তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে। এর আগের দুই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে।
পাগলও নাকি নিজের ভালো বোঝে। সরকারের লোকজন নিজের ভালো বুঝবেন কি না জানি না। আমার নিজের প্রত্যাশা হলো, সরকার এই জনমত জরিপটাকে ‘ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক’ হিসেবে নেবে এবং তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামার কারণগুলো অনুসন্ধান করবে। তারপর ঘুরে দাঁড়াবে। আগামী দুই বছর সুশাসন দিয়ে, ভালো কাজ করে দেশবাসীর চিত্ত জয় করবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, সরকার উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকবে। তারা এমন ভাব করবে যেন কোনো খারাপ কিছু ঘটেনি। দেশ আসলে খুব ভালো চলছে। শুধু ষড়যন্ত্র করে তাদের জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখানো হচ্ছে। তারা এই জনমত জরিপকে পাত্তা দেবে না। এবং তাদের জনপ্রিয়তা শুধু কমবে তাই নয়, তারা জন-অপ্রিয় হবে।
ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, রাজনীতি কী?’
বাবা বললেন, ‘ধরো, আমি আয় করি। আমি হলাম পুঁজিবাদ। তোমার মা সংসারটা চালান। তিনি আয় করেন না বটে, তবে তোমাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তো তাঁরই। তিনি হলেন সরকার। আর তুমি হলে এই দেশের জনগণ। আর তোমার ছোট ভাইটা হলো এই দেশের ভবিষ্যৎ। আর ওই যে জরিনা, কাজের মেয়ে, ও হলো শ্রমজীবী মানুষ।’
একদিন ছেলে দেখল, ছোটভাই তার প্যান্ট ভিজিয়েছে। মেঝে ভেসে যাচ্ছে। সে মাকে ডাকতে গেল। মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর বাবা ভীষণ রেগে গেছেন। কাজের মেয়ে চায়ের কাপ ভেঙেছে বলে তিনি তাকে কান ধরে ওঠ-বস করাচ্ছেন। ছেলে তখন বলল, পুঁজিবাদ শ্রমজীবীকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করছে। দেশের ভবিষ্যৎ ভেসে যাচ্ছে। সরকার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর জনগণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
জনগণ আর কত দিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে? সরকার আর কত দিন ঘুমাবে? ছাত্রলীগের জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীকে ডেকে এনে অনুষ্ঠানের পর রাতের বেলা নৈশভোজের জন্য এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন তাঁরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা একজন সহপাঠীকে পিটিয়ে খুন করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা যায় পড়তে, আদর্শ মানুষ হতে, উচ্চতর জীবনবোধ ও শ্রেয়বোধ অর্জন করতে। সেখানে একজন ছাত্র আরেকজন ছাত্রের গায়ে হাত তোলে কী করে? শুধু সে অন্য একটা উপদলের বলে? খবরের কাগজে বেরিয়েছে, সরকার টাকা ছাপিয়ে অর্থসংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কী সর্বনেশে কথা! এসব ঘটনা ঘটতে থাকবে, আর সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে?
না, দেশ খুব ভালো চলছে। আমরা সবাই উটপাখিই হতে চাই। উটপাখি না হলে এই দেশে আমরা বাঁচব কী করে?
আরশান, যদি কিনতে পাওয়া যেত, আমি একটা উটপাখিরই জীবন কিনতাম। এই দেশে মানুষের জীবন পাওয়া খুবই গ্লানিকর।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয়, তার বেশির ভাগই কিনতে পাওয়া যায়। আরশানের ধারণা হয়েছে, উটপাখি নয়, মানুষের জীবনও কিনতে পাওয়া যায়।
যখন মরুঝড় আসে, তখন উটপাখি বালিতে মাথা গুঁজে থাকে, যেন কোথাও কোনো ঝড় হচ্ছে না, এমন একটা ভাব করে—এ রকম একটা প্রবাদ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। যদিও আসলে উটপাখি মরুঝড়ের সময় মাথা গুঁজে থাকে বলে জানা যায় না।
তাতে অবশ্য প্রবাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। যেমন, আমরা বলি, আঙুল ফুলে কলাগাছ, বা তার বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। বাস্তবে আঙুল ফুলে কখনো কলাগাছ হয় না, চাঁদের হাট কারও বাড়িতে তো বসেই না, আকাশেও বসে না। তবু প্রবাদ তার বলার কথাটি বলে ফেলতে পারে, সার্থকভাবে।
উটপাখির জীবন উটপাখিরও নয়, কিন্তু আমরা মানুষেরা উটপাখির জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
কত কিছু চারপাশে ঘটছে, আর আমরা বালিতে মুখ গুঁজে থাকার ভান করছি এবং ভাবছি, এভাবেই তো ভালো আছি।
সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে সরকার ও বিরোধী দলের তিন বছরের কার্যক্রম নিয়ে জনমত জরিপের ফল। তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে। এর আগের দুই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে।
পাগলও নাকি নিজের ভালো বোঝে। সরকারের লোকজন নিজের ভালো বুঝবেন কি না জানি না। আমার নিজের প্রত্যাশা হলো, সরকার এই জনমত জরিপটাকে ‘ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক’ হিসেবে নেবে এবং তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামার কারণগুলো অনুসন্ধান করবে। তারপর ঘুরে দাঁড়াবে। আগামী দুই বছর সুশাসন দিয়ে, ভালো কাজ করে দেশবাসীর চিত্ত জয় করবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, সরকার উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকবে। তারা এমন ভাব করবে যেন কোনো খারাপ কিছু ঘটেনি। দেশ আসলে খুব ভালো চলছে। শুধু ষড়যন্ত্র করে তাদের জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখানো হচ্ছে। তারা এই জনমত জরিপকে পাত্তা দেবে না। এবং তাদের জনপ্রিয়তা শুধু কমবে তাই নয়, তারা জন-অপ্রিয় হবে।
ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, রাজনীতি কী?’
বাবা বললেন, ‘ধরো, আমি আয় করি। আমি হলাম পুঁজিবাদ। তোমার মা সংসারটা চালান। তিনি আয় করেন না বটে, তবে তোমাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তো তাঁরই। তিনি হলেন সরকার। আর তুমি হলে এই দেশের জনগণ। আর তোমার ছোট ভাইটা হলো এই দেশের ভবিষ্যৎ। আর ওই যে জরিনা, কাজের মেয়ে, ও হলো শ্রমজীবী মানুষ।’
একদিন ছেলে দেখল, ছোটভাই তার প্যান্ট ভিজিয়েছে। মেঝে ভেসে যাচ্ছে। সে মাকে ডাকতে গেল। মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর বাবা ভীষণ রেগে গেছেন। কাজের মেয়ে চায়ের কাপ ভেঙেছে বলে তিনি তাকে কান ধরে ওঠ-বস করাচ্ছেন। ছেলে তখন বলল, পুঁজিবাদ শ্রমজীবীকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করছে। দেশের ভবিষ্যৎ ভেসে যাচ্ছে। সরকার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর জনগণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
জনগণ আর কত দিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে? সরকার আর কত দিন ঘুমাবে? ছাত্রলীগের জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীকে ডেকে এনে অনুষ্ঠানের পর রাতের বেলা নৈশভোজের জন্য এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন তাঁরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা একজন সহপাঠীকে পিটিয়ে খুন করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা যায় পড়তে, আদর্শ মানুষ হতে, উচ্চতর জীবনবোধ ও শ্রেয়বোধ অর্জন করতে। সেখানে একজন ছাত্র আরেকজন ছাত্রের গায়ে হাত তোলে কী করে? শুধু সে অন্য একটা উপদলের বলে? খবরের কাগজে বেরিয়েছে, সরকার টাকা ছাপিয়ে অর্থসংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কী সর্বনেশে কথা! এসব ঘটনা ঘটতে থাকবে, আর সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে?
না, দেশ খুব ভালো চলছে। আমরা সবাই উটপাখিই হতে চাই। উটপাখি না হলে এই দেশে আমরা বাঁচব কী করে?
আরশান, যদি কিনতে পাওয়া যেত, আমি একটা উটপাখিরই জীবন কিনতাম। এই দেশে মানুষের জীবন পাওয়া খুবই গ্লানিকর।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments