অর্জন-বাংলাদেশের তিন নায়ক by সোহরাব হাসান
খ্রিষ্টীয় ২০১০ সালের প্রথম দিন সহযোগী ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর প্রধান সংবাদ শিরোনামটি দেখে কিছুটা চমকে উঠলাম। বন্ধু ইনাম আহমেদ তাঁর তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্লেষণী প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছেন Salute to three drivers (বাংলা করলে দাঁড়ায়, তিন চালককে অভিবাদন)।
কারা এই চালক? কোনো নামীদামি ব্যক্তি, কিংবা জনপ্রিয় দল নয়। এই তিন চালক হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তর শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি গোষ্ঠী—কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী।
আমরা রাষ্ট্রের চালক বলতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী-উপদেষ্টাদেরই বুঝি। তার পেছনে যে শক্তি আছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ইত্যাদিকেও রাষ্ট্রের চালক হিসেবে ধরা হয়। ইনাম আহমেদ তাঁদের কাউকে আমলে না এনে বেছে নিয়েছেন প্রকৃতপক্ষে যাঁরা দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমুন্নত রাখতে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন, তাঁদের। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
এখন দেখা যাক, কীভাবে এই তিন জনগোষ্ঠী ২০০৯ সালের চালক হলো। গত বছরটি বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। এ সময়ে ঘটেছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো দেশ-কাঁপানো ঘটনা। ঘটেছে আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বব্যাপী চলেছে অর্থনৈতিক মন্দা। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, শক্তিধর আমেরিকার অর্থনীতি যখন মন্দার ধাক্কায় প্রায় ভঙ্গুর তখন বাংলাদেশের জন্যও অপেক্ষা করছে মহাবিপর্যয়। তাদের আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যাঁরা সচল ও সজীব রেখেছেন তাঁরা হলেন কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী।
কীভাবে এটি সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এ কারণে, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ কখনো হতোদ্যম হন না; বিশেষ করে, কৃষক সম্প্রদায় বরাবরই আশাবাদী। খরায় শস্য পুড়ে যায়, বৃষ্টিতে পচে যায়, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। লোনা পানিতে চারা বাড়ে না—তার পরও কৃষক নব-উদ্যমে চাষ করেন সামনের মৌসুমে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। অনেক সময় ঘরবাড়ি, বউয়ের গয়না বিক্রি করে হলেও আবাদ করেন। জমি তাঁর কাছে সন্তানের চেয়েও প্রিয়। এর আগে আমরা কৃষককে সার নিতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছি, বিদ্যুতের লাইন পেতে সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে তাঁরা সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু চাষাবাদ বন্ধ হতে দেননি।
ভাগ্য ভালো, গত বছর কৃষককে সার, বীজ বা সেচের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়নি। আমরা এমন একজন কৃষিমন্ত্রী পেয়েছি, যিনি কৃষকের কষ্ট বোঝেন, তাঁদের ত্যাগ ও শ্রমের মূল্য দেন। এ কারণেই শহুরে মানুষের গাল খেয়েও বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্য গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখা হয়েছে। কৃষি খাতে সরকার তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। টিএসপি সারের দাম টনপ্রতি ৬৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ২০ হাজার এবং ডিএসপি সারের দাম ৮৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ২৮ হাজার করা হয়েছে। আমাদের কৃষকেরা সরকারের কাছে সাহায্য চান না, অনুদান চান না; তাঁরা সময়মতো সার পেতে চান, বীজ পেতে চান, সেচসুবিধা চান। সরকার যখন এসব সুবিধা কৃষককে দিতে পেরেছে তখন তাঁরা বাম্পার ফলন ফলিয়েছেন। না হলে দুই বছর আগেও যেখানে দেশে ব্যাপক খাদ্যশস্য-ঘাটতি ছিল, সেখানে এ বছর ১৩ লাখ টন চাল গুদামে মজুদ থাকে কীভাবে? এর সিংহভাগ অবদান কৃষকের। নিজেরা আধপেটা খেয়ে ১৫ কোটি মানুষের আহার জোগান। আমরা শহুরে মানুষ চালের দাম কেজিপ্রতি দুই টাকা বাড়লে হইচই করি। কিন্তু কৃষক তাঁর উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল, বিশেষজ্ঞেরা অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
কৃষির উত্পাদনব্যয় বাড়লে কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে, এটি অর্থনীতির সরল হিসাব। কিন্তু উত্পাদনব্যয় কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে সরকার খুব বেশি চিন্তাভাবনা করছে কি? এখনো আমাদের দেশে জমিতে প্রতিবছর যে পরিমাণ ধান উত্পন্ন হয়, জাপান বা ফিলিপাইনে তার চেয়ে অনেক বেশি ধান উত্পন্ন হয়। অথচ আমাদের মাটি অনেক বেশি উর্বর। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা, সহজলভ্য প্রযুক্তি ও কৃষি উপকরণ।
আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় নায়ক প্রবাসী জনশক্তি। বর্তমানে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই আছেন ২০ লক্ষাধিক। কী তাঁদের পরিচয়? তাঁরা বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক, প্রায় নিরক্ষর। স্বাগতিক দেশ যাঁদের মিসকিন বলে সম্বোধন করে। মুসলিম উম্মাহর শরিক হলেও মধ্যপ্রাচ্যের চাকরিদাতারা তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ছে। প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, স্বাধীনতার পর সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তাঁকে এক বাংলাদেশি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্যার, আপনার বেতন কত?’ জবাবে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ওখানে পড়ানোর জন্য আমার পাওনা পাঁচ হাজার রিয়াল। আর ওরা আমাকে যে অপমান করে, সে জন্য আরও ১০ হাজার রিয়াল দেয়।’ একজন ঘোরতর পাকিস্তানপন্থী অধ্যাপকের মনোভাব যদি এ-ই হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাঁরা রাস্তায় ঝাড়ু দেন, বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন, তাঁদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি এ ধরনের বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণ যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে হয় তা নয়, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতেও হচ্ছে। এত সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বিশ্বমন্দার মধ্যেও গত বছর তাঁরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। দেশের অর্থনৈতিক ভিত নির্মাণে তাঁদের অবদানকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিনিময়ে আমরা তাঁদের কী দিচ্ছি? প্রায়শ পত্রিকায় বিমানবন্দরে প্রবাসী শ্রমিক হয়রানির খবর ছাপা হয়। সরকার কি এ হয়রানি বন্ধ করতে পারে না?
প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ভোটাধিকার; নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীরা তাঁদের ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনের পর আবার ভুলে যান। অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা যদি দেশে ভোটার হতে পারেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনও কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করেছিল। এখন সবাই চুপচাপ। মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের আগে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে আর কথা হবে না। অথচ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রবাসীরা মন্ত্রী-সাংসদ হতে চান না; তাঁরা চান, রাষ্ট্র-পরিচালক নির্বাচনে তাঁদেরও ভূমিকা থাকুক।
বাংলাদেশি প্রবাসী নাগরিকদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। ব্রিটেনের শ্রমিক দলের এক এমপি প্রার্থী বাংলাদেশে এসে নির্বাচিত হলে প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। অতএব আমাদের রাষ্ট্র-পরিচালকদেরও প্রবাসীদের বিষয়ে নীরব থাকার সুযোগ নেই।
প্রবাসীদের আয়প্রবাহ যখন বাড়ছে তখন বেশ কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিকদের ফিরে আসার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অনেকে আদম ব্যাপারিদের পাল্লায় পড়ে দূর মরুভূমি কিংবা গভীর সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যান, অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফেরেন। এ ক্ষেত্রে কি সরকারের বা বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর কিছুই করার নেই?
২০০৯ সালে বাংলাদেশের তৃতীয় নায়ক শ্রমিক। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাকশিল্পের ২৫ লাখ শ্রমিক। তাঁদের ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে বিশ্বমন্দার মধ্যেও তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছে। গত এক বছরে এই শিল্পে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ছিল। বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও বকেয়া ছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে বিদেশি বাজার ধরে রাখতে পেরেছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শ্রমিকদের। তৈরি পোশাকশিল্পের ৯০ শতাংশের বেশি নারীশ্রমিক। একসময় ভাবা হতো, পুরুষশ্রমিকদের চেয়ে নারীশ্রমিকেরা কাজ কম করতে পারেন। কিন্তু এ ধারণা যে সত্য নয়, সেটাই প্রমাণ করছেন তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। মালিকেরা কম মজুরিতে বেশি কাজ পান বলেই নারীশ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে এটি নারীর ক্ষমতায়নও। এসব কারখানায় কাজ করেন স্বল্প শিক্ষিত, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তাঁদের কেউ আগে বাসাবাড়িতে কাজ করতেন, কেউ ঘরে বসে স্বামী বা অন্য কারও গঞ্জনা সহ্য করতেন। এই প্রথম তাঁরা মানুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শিখছেন, দাবি-দাওয়া জানাতে পারছেন। ছুটি-ছাটায় হলে গিয়ে ছবিও দেখছেন। আর্থিকভাবে নিজেরা স্বাবলম্বী বলেই সেটি সম্ভব হচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পের মেয়েরা প্রথাগত লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকলেও তাঁদের মধ্যে যে অসম্ভব সৃজনশক্তি ও শিল্পীসত্তা আছে, শ্রমিক দিবসের আয়োজনগুলো তারই প্রমাণ।
বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবি, সেটি পূরণ হলে তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন। সরকার তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বল্প মূল্যে চাল দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি প্রশংসনীয়। এখন মালিকেরা এসব মূঢ়-ম্লান মুখের প্রতি আরেকটু সংবেদনশীল হলে, বাজারদর বিবেচনা করে ন্যূনতম মজুরি দিলে তাঁরা বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাবেন।
সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার বছরওয়ারি হিসাবটা সরকার ও বিরোধী দলের জন্য জরুরি। সরকার সফল হলে পরবর্তী মেয়াদে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। আর সরকার ব্যর্থ হলে বিরোধী দল মসনদে বসার খোয়াব দেখতে থাকে। এই বাগিবতণ্ডার সঙ্গে দিনযাপনের গ্লানি বয়ে যাওয়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। কবির ভাষায়, ‘যারা অধিক রাতে ঘুমায় আর জাগে সকলের আগে’ তাঁরাই বাংলাদেশের প্রকৃত নায়ক।
২০১০ হোক তাঁদের অধিকার ফিরে পাওয়ার এবং জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন করার বছর।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
আমরা রাষ্ট্রের চালক বলতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী-উপদেষ্টাদেরই বুঝি। তার পেছনে যে শক্তি আছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ইত্যাদিকেও রাষ্ট্রের চালক হিসেবে ধরা হয়। ইনাম আহমেদ তাঁদের কাউকে আমলে না এনে বেছে নিয়েছেন প্রকৃতপক্ষে যাঁরা দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমুন্নত রাখতে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন, তাঁদের। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
এখন দেখা যাক, কীভাবে এই তিন জনগোষ্ঠী ২০০৯ সালের চালক হলো। গত বছরটি বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। এ সময়ে ঘটেছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো দেশ-কাঁপানো ঘটনা। ঘটেছে আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বব্যাপী চলেছে অর্থনৈতিক মন্দা। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, শক্তিধর আমেরিকার অর্থনীতি যখন মন্দার ধাক্কায় প্রায় ভঙ্গুর তখন বাংলাদেশের জন্যও অপেক্ষা করছে মহাবিপর্যয়। তাদের আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যাঁরা সচল ও সজীব রেখেছেন তাঁরা হলেন কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী।
কীভাবে এটি সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এ কারণে, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ কখনো হতোদ্যম হন না; বিশেষ করে, কৃষক সম্প্রদায় বরাবরই আশাবাদী। খরায় শস্য পুড়ে যায়, বৃষ্টিতে পচে যায়, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। লোনা পানিতে চারা বাড়ে না—তার পরও কৃষক নব-উদ্যমে চাষ করেন সামনের মৌসুমে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। অনেক সময় ঘরবাড়ি, বউয়ের গয়না বিক্রি করে হলেও আবাদ করেন। জমি তাঁর কাছে সন্তানের চেয়েও প্রিয়। এর আগে আমরা কৃষককে সার নিতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছি, বিদ্যুতের লাইন পেতে সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে তাঁরা সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু চাষাবাদ বন্ধ হতে দেননি।
ভাগ্য ভালো, গত বছর কৃষককে সার, বীজ বা সেচের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়নি। আমরা এমন একজন কৃষিমন্ত্রী পেয়েছি, যিনি কৃষকের কষ্ট বোঝেন, তাঁদের ত্যাগ ও শ্রমের মূল্য দেন। এ কারণেই শহুরে মানুষের গাল খেয়েও বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্য গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখা হয়েছে। কৃষি খাতে সরকার তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। টিএসপি সারের দাম টনপ্রতি ৬৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ২০ হাজার এবং ডিএসপি সারের দাম ৮৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ২৮ হাজার করা হয়েছে। আমাদের কৃষকেরা সরকারের কাছে সাহায্য চান না, অনুদান চান না; তাঁরা সময়মতো সার পেতে চান, বীজ পেতে চান, সেচসুবিধা চান। সরকার যখন এসব সুবিধা কৃষককে দিতে পেরেছে তখন তাঁরা বাম্পার ফলন ফলিয়েছেন। না হলে দুই বছর আগেও যেখানে দেশে ব্যাপক খাদ্যশস্য-ঘাটতি ছিল, সেখানে এ বছর ১৩ লাখ টন চাল গুদামে মজুদ থাকে কীভাবে? এর সিংহভাগ অবদান কৃষকের। নিজেরা আধপেটা খেয়ে ১৫ কোটি মানুষের আহার জোগান। আমরা শহুরে মানুষ চালের দাম কেজিপ্রতি দুই টাকা বাড়লে হইচই করি। কিন্তু কৃষক তাঁর উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল, বিশেষজ্ঞেরা অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
কৃষির উত্পাদনব্যয় বাড়লে কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে, এটি অর্থনীতির সরল হিসাব। কিন্তু উত্পাদনব্যয় কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে সরকার খুব বেশি চিন্তাভাবনা করছে কি? এখনো আমাদের দেশে জমিতে প্রতিবছর যে পরিমাণ ধান উত্পন্ন হয়, জাপান বা ফিলিপাইনে তার চেয়ে অনেক বেশি ধান উত্পন্ন হয়। অথচ আমাদের মাটি অনেক বেশি উর্বর। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা, সহজলভ্য প্রযুক্তি ও কৃষি উপকরণ।
আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় নায়ক প্রবাসী জনশক্তি। বর্তমানে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই আছেন ২০ লক্ষাধিক। কী তাঁদের পরিচয়? তাঁরা বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক, প্রায় নিরক্ষর। স্বাগতিক দেশ যাঁদের মিসকিন বলে সম্বোধন করে। মুসলিম উম্মাহর শরিক হলেও মধ্যপ্রাচ্যের চাকরিদাতারা তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ছে। প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, স্বাধীনতার পর সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তাঁকে এক বাংলাদেশি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্যার, আপনার বেতন কত?’ জবাবে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ওখানে পড়ানোর জন্য আমার পাওনা পাঁচ হাজার রিয়াল। আর ওরা আমাকে যে অপমান করে, সে জন্য আরও ১০ হাজার রিয়াল দেয়।’ একজন ঘোরতর পাকিস্তানপন্থী অধ্যাপকের মনোভাব যদি এ-ই হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাঁরা রাস্তায় ঝাড়ু দেন, বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন, তাঁদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি এ ধরনের বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণ যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে হয় তা নয়, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতেও হচ্ছে। এত সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বিশ্বমন্দার মধ্যেও গত বছর তাঁরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। দেশের অর্থনৈতিক ভিত নির্মাণে তাঁদের অবদানকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিনিময়ে আমরা তাঁদের কী দিচ্ছি? প্রায়শ পত্রিকায় বিমানবন্দরে প্রবাসী শ্রমিক হয়রানির খবর ছাপা হয়। সরকার কি এ হয়রানি বন্ধ করতে পারে না?
প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ভোটাধিকার; নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীরা তাঁদের ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনের পর আবার ভুলে যান। অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা যদি দেশে ভোটার হতে পারেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনও কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করেছিল। এখন সবাই চুপচাপ। মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের আগে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে আর কথা হবে না। অথচ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রবাসীরা মন্ত্রী-সাংসদ হতে চান না; তাঁরা চান, রাষ্ট্র-পরিচালক নির্বাচনে তাঁদেরও ভূমিকা থাকুক।
বাংলাদেশি প্রবাসী নাগরিকদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। ব্রিটেনের শ্রমিক দলের এক এমপি প্রার্থী বাংলাদেশে এসে নির্বাচিত হলে প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। অতএব আমাদের রাষ্ট্র-পরিচালকদেরও প্রবাসীদের বিষয়ে নীরব থাকার সুযোগ নেই।
প্রবাসীদের আয়প্রবাহ যখন বাড়ছে তখন বেশ কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিকদের ফিরে আসার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অনেকে আদম ব্যাপারিদের পাল্লায় পড়ে দূর মরুভূমি কিংবা গভীর সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যান, অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফেরেন। এ ক্ষেত্রে কি সরকারের বা বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর কিছুই করার নেই?
২০০৯ সালে বাংলাদেশের তৃতীয় নায়ক শ্রমিক। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাকশিল্পের ২৫ লাখ শ্রমিক। তাঁদের ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে বিশ্বমন্দার মধ্যেও তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছে। গত এক বছরে এই শিল্পে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ছিল। বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও বকেয়া ছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে বিদেশি বাজার ধরে রাখতে পেরেছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শ্রমিকদের। তৈরি পোশাকশিল্পের ৯০ শতাংশের বেশি নারীশ্রমিক। একসময় ভাবা হতো, পুরুষশ্রমিকদের চেয়ে নারীশ্রমিকেরা কাজ কম করতে পারেন। কিন্তু এ ধারণা যে সত্য নয়, সেটাই প্রমাণ করছেন তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। মালিকেরা কম মজুরিতে বেশি কাজ পান বলেই নারীশ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে এটি নারীর ক্ষমতায়নও। এসব কারখানায় কাজ করেন স্বল্প শিক্ষিত, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তাঁদের কেউ আগে বাসাবাড়িতে কাজ করতেন, কেউ ঘরে বসে স্বামী বা অন্য কারও গঞ্জনা সহ্য করতেন। এই প্রথম তাঁরা মানুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শিখছেন, দাবি-দাওয়া জানাতে পারছেন। ছুটি-ছাটায় হলে গিয়ে ছবিও দেখছেন। আর্থিকভাবে নিজেরা স্বাবলম্বী বলেই সেটি সম্ভব হচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পের মেয়েরা প্রথাগত লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকলেও তাঁদের মধ্যে যে অসম্ভব সৃজনশক্তি ও শিল্পীসত্তা আছে, শ্রমিক দিবসের আয়োজনগুলো তারই প্রমাণ।
বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবি, সেটি পূরণ হলে তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন। সরকার তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বল্প মূল্যে চাল দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি প্রশংসনীয়। এখন মালিকেরা এসব মূঢ়-ম্লান মুখের প্রতি আরেকটু সংবেদনশীল হলে, বাজারদর বিবেচনা করে ন্যূনতম মজুরি দিলে তাঁরা বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাবেন।
সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার বছরওয়ারি হিসাবটা সরকার ও বিরোধী দলের জন্য জরুরি। সরকার সফল হলে পরবর্তী মেয়াদে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। আর সরকার ব্যর্থ হলে বিরোধী দল মসনদে বসার খোয়াব দেখতে থাকে। এই বাগিবতণ্ডার সঙ্গে দিনযাপনের গ্লানি বয়ে যাওয়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। কবির ভাষায়, ‘যারা অধিক রাতে ঘুমায় আর জাগে সকলের আগে’ তাঁরাই বাংলাদেশের প্রকৃত নায়ক।
২০১০ হোক তাঁদের অধিকার ফিরে পাওয়ার এবং জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন করার বছর।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments