বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৭৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মঞ্জুর আহমেদ, বীর প্রতীক বিপদেও বিচলিত হননি তিনি মধ্যরাতে মঞ্জুর আহমেদ শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান নিতে থাকলেন। রাত ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালাল। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও মঞ্জুর আহমেদের প্রচেষ্টায় দ্রুত


সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দুপুরের পর পাকিস্তানি আক্রমণের প্রচণ্ডতা আরও বেড়ে গেল। মঞ্জুর আহমেদ এতে বিচলিত হলেন না। বীরত্বের সঙ্গে তিনি তাঁর দলের নেতৃত্ব দিতে থাকলেন। তাঁর সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরও বেড়ে গেল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। ২৪ অক্টোবর, গোয়াইনঘাটে।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। সুরমা নদী গোয়াইনঘাট উপজেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ছাতক অপারেশনের পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গোয়াইনঘাট আক্রমণের জন্য সমবেত হয় ৫ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে (ভোলাগঞ্জ)। লেংগুরা গ্রামের দক্ষিণে ব্রিজহেড তৈরির মাধ্যমে নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বপাড়ের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বে থাকে আলফা কোম্পানি। ওই কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মঞ্জুর আহমেদ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা ২৩ অক্টোবর রাতে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। কিন্তু স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতির খবর পেয়ে যায়। ২৪ অক্টোবর ভোর আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার দিকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালায়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা এতে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় মঞ্জুর আহমেদ সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় সংগঠিত করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। দুপুরের পর হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নতুন দল এসে শক্তি বৃদ্ধি করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। পুরো গোয়াইনঘাট এলাকা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয়। কোনো কোনো স্থানে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ার পাওয়ার এতই বেশি ছিল যে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো একটি অবস্থানেও টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তার পরও তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মঞ্জুর আহমেদ ১৯৭০-৭১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। মে মাসে মুহুরী নদীর এক সেতু ধ্বংসে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে যান। জুন মাসে তাঁকে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে ছাতক, রাধানগর, গোয়াইনঘাট আক্রমণে অংশ নেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই এম নূরন্নবী খান (বীর বিক্রম) তাঁর অপারেশন রাধানগর বইয়ে লিখেছেন: ‘লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। অভিজ্ঞতা যে দেশপ্রেমের কাছে কিছুই না, তা তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রেই প্রমাণ করেছেন। ২৪ অক্টোবর সাহসিকতার সঙ্গে তিনি শত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন। এ সময় তিনি শত্রুর সঙ্গে রীতিমতো হাতাহাতি যুদ্ধেও অবতীর্ণ হন। ২৬ নভেম্বর মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর আক্রমণকালে বিপর্যস্ত গুর্খাদের উইথড্রয়াল কাজেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মনজুর আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩২।
মনজুর আহমেদের পৈতৃক বাড়ি ঢাকার টিকাটুলির ৬ অভয় দাস লেনে। বর্তমানে বাস করেন পুরাতন ডিওএইচএস, বনানীতে। তাঁর বাবার নাম আবদুস সুলতান মল্লিক, মা মনিরুননেসা বেগম, স্ত্রী গুলশান মঞ্জুর। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বিগ্রেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.