আন্তর্জাতিক-জেগে উঠছে মানুষ by হাসান ফেরদৌস
সাধুবাবা একদম দিনক্ষণ গুনে বলে দিয়েছিলেন, ১৯ মে ২০১১ তারিখে ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় পৃথিবীর শেষ ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে। এক প্রবল ভূমিকম্পে পৃথিবীর প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রাম, আমাদের চেনাজানা সব পরিচিত জনপদ নিশ্চিহ্ন হবে। একজন মানুষও বেঁচে থাকবে না। কোনো পশুপাখি, কোনো গাছ, কোনো ফুল—কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সেদিন হবে মহাপ্রলয়, রোজকেয়ামত। না, পৃথিবী ধ্বংস হয়নি। যদি কিছু ধ্বংস হয়ে থাকে, তা হলো ক্যালিফোর্নিয়ার ধর্মযাজক
হ্যারল্ড ক্যাম্পিংয়ের ইভানজেলিক্যাল রাজত্ব। এই ভদ্রলোকই তাঁর রেডিও নেটওয়ার্কে আমাদের মহাপ্রলয়ের জন্য তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেকে সে কথায় বিশ্বাস করে তাবৎ সঞ্চয় উড়িয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন, এই বুঝি মহাপ্রলয় আসে, এই বুঝি প্রবল ঝড়ে উড়ে উড়ে তারা পৌঁছে যাবেন স্বর্গে। ক্যাম্পিং সাহেব অবশ্য তাঁর ব্যাংকে সঞ্চিত কয়েক মিলিয়ন ডলারের এক পয়সাও খরচ করেননি। তা তিনি ভালোই করেছেন। কারণ, ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর রেডিও-সাম্রাজ্য লাটে উঠেছে। ভাগ্যিস, ব্যাংকের টাকাগুলো ধরা হয়নি!
শুধু ক্যাম্পিং সাহেব নন, ২০১১ সালে পৃথিবীর বারোটা বাজবে বলে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এমন জ্যোতিষীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের সবার মুখেই এখন পচা ডিম, আমার হিসাবে, ২০১১ সালটা অন্য আগের বছরগুলোর তুলনায় ভালোই গেছে। অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থা বেহাল ছিল, তা ঠিক। কিন্তু সে আর নতুন কথা কী। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চলে সাইকেলের চাকার মতো। একবার উঠে তো একবার নামে। এ বছর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে একাধিক; যেমন, জাপানের সুনামি। কিন্তু সুনামি সে দেশে এই প্রথম নয়—সম্ভবত তা শেষ ঘটনাও নয়। ছোটখাটো যুদ্ধও ঘটেছে, কিন্তু তার কোনোটাই দুনিয়াকাঁপানো কিছু হয়নি। ইরানে হামলা চালাবে বলে ইসরায়েল বারবার হুমকি দিয়েছে বটে, কিন্তু এক ‘সাইবার-আক্রমণ’ ছাড়া অন্য কোনো অঘটন ঘটেনি।
অথচ ২০১১ সালে দুনিয়াকাঁপানো ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। যাকে আমরা এখন ‘আরব বসন্ত’ বলছি, তা আরব বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আগের সব অঙ্ক উল্টে দিয়েছে। সারা পৃথিবী বদলাবে কিন্তু আরব বিশ্ব বদলাবে না, এমন ধারণা যাঁরা পোষণ করেন, গত এক বছরের ঘটনা তাঁদের সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছে। দু-চারজন আরব একনায়কের পতন হয়েছে বলে আরব বসন্তকে দুনিয়াকাঁপানো বলছি না। ব্যাপারটা আরও গভীর। আরব বিশ্বকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের তালুর নিচে রাখার কৌশল হিসেবে ওয়াশিংটন এত দিন তাদের পছন্দসই একনায়ক বেছে নিয়েছে। সে একনায়কের পেছনে ছাতা ধরে থেকেছে সেই দেশের সেনাবাহিনী। আর সেই সেনাবাহিনীকে পুতুলনাচের সুতো ধরে দূর থেকে নাচিয়েছে ওয়াশিংটন। টুঁ শব্দটি করার সাহস ছিল না সাধারণ মানুষের। যখনই কেউ কোথাও প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে, মিলেছে লাঠি, বন্দুক ও বোমা, কখনো কখনো বা সবুজ ডলারের উৎকোচ। ব্যাপারটা বদলে গেল দুটো কারণে।
এক. আরব বিশ্বে জনসংখ্যার গুণগত পরিবর্তন। মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়া, যেসব দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা গত এক বছরে প্রত্যক্ষ করেছি, তার প্রতিটিতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ৩০ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সের। কোনো কোনো আরব দেশে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ৩০ বছরের কম। সে তুলনায় সাতটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশে ৩০ বছরের কম এমন জনসংখ্যার পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ। প্রায় সব আরব দেশেই বেকারত্বের চড়া হার, ১২ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু যদি ৩০ বছরের কম মানুষের কথা ধরি, তাহলে বেকারত্বের হার ৪০-৪৫ শতাংশ। এসব দেশ—এক ইয়েমেন ছাড়া—খুব গরিব তা নয়, কিন্তু প্রতিটি দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভেতর আয়ের বৈষম্য আকাশ-পাতাল। গুটিকয়েক মানুষ যারা হয় শাসকগোষ্ঠীর গোত্রভুক্ত অথবা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী, তাদের হাতে সম্পদের পাহাড়। অন্যরা সমাজের নিচু তলায়। যেমন—মিসরের ৪০ শতাংশ মানুষের আয় দিনপ্রতি মোটে দুই ডলার।
তাদের অভিভাবকেরা এই বৈষম্যকে নিয়তি বলে মানলেও নতুন প্রজন্ম আর তা মানতে প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন থাকতেও তারা আর সম্মত নয়। মিসরে বা তিউনিসিয়ায় যারা খালি হাতে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই একই কথা বলেছে, মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মান ফিরে পেতে দরকার রাজনৈতিক পরিবর্তন, দরকার ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টে দেওয়া। বছরের পর বছর একই মানুষ ও তার তাঁবেদারেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে, পাতানো নির্বাচনে মানুষকে বোকা বানাবে, এ অবস্থা চলতে পারে না। বিক্ষোভকারীদের মুখে যে দাবি সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে তা হলো ‘কারোমা’, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিগনিটি—আত্মমর্যাদা।
দ্বিতীয় কারণ, নতুন যোগাযোগপ্রযুক্তি। ১০-১৫ বছর আগে এসব সরকার চাইলে সব তথ্যমাধ্যমের গলা টিপে রাখতে পারত। ইন্টারনেট, সেলফোন, স্মার্টফোনের এই জমানায় সে চেষ্টা অচল।
তিউনিসিয়ায় ‘আত্মমর্যাদার’ জন্য যে লড়াই শুরু এক বছর আগে, বছর গড়াতে না-গড়াতে ঠিক সেই দাবি শোনা গেল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট—যা ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অকুপাই এভরিথিং’—সেখানেও মূল কথা অর্থনৈতিক বৈষম্য। কাগজে-কলমে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, অথচ সত্যি কথা হলো, এ দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ দেশের সব আর্থিক সম্পদের ৪২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। মাত্র ৪০০ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ১৪০ মিলিয়ন মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ। যে দেশে বৈষম্য এমন পর্বতসমান, সে আর যা-ই হোক, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র নয়।
ফলে আজকে আমেরিকায় ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে শুরু হয়েছে ডিগনিটির জন্য আন্দোলন। নিউইয়র্কের জুকোটি পার্ক আর কায়রোর তাহরির স্কয়ার এখন একাকার। অধিকারহীন মানুষ, তা মিসরেই হোক অথবা মিসৌরিতে, কায়রোয় হোক অথবা নিউইয়র্কে—সর্বত্র একই আওয়াজ তুলেছে, আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দাও। এমনকি তুষার মোড়ানো মস্কোতেও শুনছি আত্মমর্যাদার দাবি। সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম উত্তর ও দক্ষিণের মানুষ একই সময় একই দাবিতে আওয়াজ তুলেছে। সে আওয়াজ এখনো হয়তো গর্জনে পরিণত হয়নি, কিন্তু হবে, সেই আশার জন্ম দিয়েছে ২০১১।
মানবসভ্যতা বরাবরই দুই বিপরীত শক্তির লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। একদিকে আরামকেদায়ায় বসে একদল লোক অস্ত্রবলে-অর্থবলে চেষ্টা করেছে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ আগলে রাখতে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়া কর্মজীবী, শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত—হয় বেয়নেটের গুঁতোয়, নয়তো আইনশৃঙ্খলার আফিম খেয়ে কাবু হয়ে থেকেছে। কিন্তু কখনো কখনো এমন আশ্চর্য ঘটনাও ঘটে যে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে মানুষ। কেদারায় বসা মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখে, যারা এত দিন পদানত ছিল, তারাই ফুঁসে উঠেছে। কিছু
লোককে বেয়নেটে কাবু করা যায়, কিন্তু রাজপথে দাঁড়ানো লাখ লাখ মানুষকে কাবু করবে, এত বেয়নেট কোথায়?
তিউনিসিয়ার কবি আবু কাসিম আল-শাব্বির, যাঁর কবিতা আরব বিশ্বের মুক্তির স্তবগান হয়ে উঠেছে, পৃথিবীর সব একনায়কের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন এভাবে:
নিষ্ঠুর একনায়কেরা, শোনো
আঁধার ভালোবাসো যারা, শোনো
ঘাতক যারা, শোনো
নিরীহ মানুষের ক্ষতকে তোমরা উপহাস করো
তোমাদের হাতের তালু ভেজা মানুষের রক্তে
তোমরা
পায়ের নিচে মাড়াও মানুষের স্বপ্ন
ভূমিতে ছড়াও বেদনার বীজকণা
শোনো,
বসন্তের নির্মেঘ আকাশ ও সোনা ঝলমলে আলো দেখে
খুশি হয়ো না
ঈশান কোণে কালো মেঘ, বজ্রপাত ও প্রবল পবন
ধেয়ে আসছে তোমাদের দিকেই
মনে রেখো,
ছাই কণার নিচেই থাকে অঙ্গার।
যারা মাটিতে বিছায় কাঁটা
রেহাই নেই তাদের ক্ষত থেকে।
তোমরা
যারা শিরশ্ছেদ করো মানুষের
উপড়ে ফেলো ফুল
শুষ্ক বালুতে ছড়াও রক্ত ও মানুষের চোখের জল
মনে রেখো, তোমাদের
প্লাবিত করবে রক্তের নদী
উড়িয়ে নেবে ঝড়ের তাণ্ডব।
২০১১ সালের শেষ প্রহরে আভাস মিলছে সেই ঝোড়ো হাওয়ার। জেগে উঠছে মানুষ। ভোর হচ্ছে। প্রিয় বাংলাদেশ, এই জাগরণের সংবাদ তোমার জানা আছে তো?
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, জাতিসংঘে কর্মরত।
শুধু ক্যাম্পিং সাহেব নন, ২০১১ সালে পৃথিবীর বারোটা বাজবে বলে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এমন জ্যোতিষীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের সবার মুখেই এখন পচা ডিম, আমার হিসাবে, ২০১১ সালটা অন্য আগের বছরগুলোর তুলনায় ভালোই গেছে। অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থা বেহাল ছিল, তা ঠিক। কিন্তু সে আর নতুন কথা কী। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চলে সাইকেলের চাকার মতো। একবার উঠে তো একবার নামে। এ বছর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে একাধিক; যেমন, জাপানের সুনামি। কিন্তু সুনামি সে দেশে এই প্রথম নয়—সম্ভবত তা শেষ ঘটনাও নয়। ছোটখাটো যুদ্ধও ঘটেছে, কিন্তু তার কোনোটাই দুনিয়াকাঁপানো কিছু হয়নি। ইরানে হামলা চালাবে বলে ইসরায়েল বারবার হুমকি দিয়েছে বটে, কিন্তু এক ‘সাইবার-আক্রমণ’ ছাড়া অন্য কোনো অঘটন ঘটেনি।
অথচ ২০১১ সালে দুনিয়াকাঁপানো ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। যাকে আমরা এখন ‘আরব বসন্ত’ বলছি, তা আরব বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আগের সব অঙ্ক উল্টে দিয়েছে। সারা পৃথিবী বদলাবে কিন্তু আরব বিশ্ব বদলাবে না, এমন ধারণা যাঁরা পোষণ করেন, গত এক বছরের ঘটনা তাঁদের সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছে। দু-চারজন আরব একনায়কের পতন হয়েছে বলে আরব বসন্তকে দুনিয়াকাঁপানো বলছি না। ব্যাপারটা আরও গভীর। আরব বিশ্বকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের তালুর নিচে রাখার কৌশল হিসেবে ওয়াশিংটন এত দিন তাদের পছন্দসই একনায়ক বেছে নিয়েছে। সে একনায়কের পেছনে ছাতা ধরে থেকেছে সেই দেশের সেনাবাহিনী। আর সেই সেনাবাহিনীকে পুতুলনাচের সুতো ধরে দূর থেকে নাচিয়েছে ওয়াশিংটন। টুঁ শব্দটি করার সাহস ছিল না সাধারণ মানুষের। যখনই কেউ কোথাও প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে, মিলেছে লাঠি, বন্দুক ও বোমা, কখনো কখনো বা সবুজ ডলারের উৎকোচ। ব্যাপারটা বদলে গেল দুটো কারণে।
এক. আরব বিশ্বে জনসংখ্যার গুণগত পরিবর্তন। মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়া, যেসব দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা গত এক বছরে প্রত্যক্ষ করেছি, তার প্রতিটিতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ৩০ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সের। কোনো কোনো আরব দেশে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ৩০ বছরের কম। সে তুলনায় সাতটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশে ৩০ বছরের কম এমন জনসংখ্যার পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ। প্রায় সব আরব দেশেই বেকারত্বের চড়া হার, ১২ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু যদি ৩০ বছরের কম মানুষের কথা ধরি, তাহলে বেকারত্বের হার ৪০-৪৫ শতাংশ। এসব দেশ—এক ইয়েমেন ছাড়া—খুব গরিব তা নয়, কিন্তু প্রতিটি দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভেতর আয়ের বৈষম্য আকাশ-পাতাল। গুটিকয়েক মানুষ যারা হয় শাসকগোষ্ঠীর গোত্রভুক্ত অথবা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী, তাদের হাতে সম্পদের পাহাড়। অন্যরা সমাজের নিচু তলায়। যেমন—মিসরের ৪০ শতাংশ মানুষের আয় দিনপ্রতি মোটে দুই ডলার।
তাদের অভিভাবকেরা এই বৈষম্যকে নিয়তি বলে মানলেও নতুন প্রজন্ম আর তা মানতে প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন থাকতেও তারা আর সম্মত নয়। মিসরে বা তিউনিসিয়ায় যারা খালি হাতে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই একই কথা বলেছে, মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মান ফিরে পেতে দরকার রাজনৈতিক পরিবর্তন, দরকার ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টে দেওয়া। বছরের পর বছর একই মানুষ ও তার তাঁবেদারেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে, পাতানো নির্বাচনে মানুষকে বোকা বানাবে, এ অবস্থা চলতে পারে না। বিক্ষোভকারীদের মুখে যে দাবি সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে তা হলো ‘কারোমা’, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিগনিটি—আত্মমর্যাদা।
দ্বিতীয় কারণ, নতুন যোগাযোগপ্রযুক্তি। ১০-১৫ বছর আগে এসব সরকার চাইলে সব তথ্যমাধ্যমের গলা টিপে রাখতে পারত। ইন্টারনেট, সেলফোন, স্মার্টফোনের এই জমানায় সে চেষ্টা অচল।
তিউনিসিয়ায় ‘আত্মমর্যাদার’ জন্য যে লড়াই শুরু এক বছর আগে, বছর গড়াতে না-গড়াতে ঠিক সেই দাবি শোনা গেল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট—যা ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অকুপাই এভরিথিং’—সেখানেও মূল কথা অর্থনৈতিক বৈষম্য। কাগজে-কলমে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, অথচ সত্যি কথা হলো, এ দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ দেশের সব আর্থিক সম্পদের ৪২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। মাত্র ৪০০ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ১৪০ মিলিয়ন মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ। যে দেশে বৈষম্য এমন পর্বতসমান, সে আর যা-ই হোক, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র নয়।
ফলে আজকে আমেরিকায় ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে শুরু হয়েছে ডিগনিটির জন্য আন্দোলন। নিউইয়র্কের জুকোটি পার্ক আর কায়রোর তাহরির স্কয়ার এখন একাকার। অধিকারহীন মানুষ, তা মিসরেই হোক অথবা মিসৌরিতে, কায়রোয় হোক অথবা নিউইয়র্কে—সর্বত্র একই আওয়াজ তুলেছে, আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দাও। এমনকি তুষার মোড়ানো মস্কোতেও শুনছি আত্মমর্যাদার দাবি। সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম উত্তর ও দক্ষিণের মানুষ একই সময় একই দাবিতে আওয়াজ তুলেছে। সে আওয়াজ এখনো হয়তো গর্জনে পরিণত হয়নি, কিন্তু হবে, সেই আশার জন্ম দিয়েছে ২০১১।
মানবসভ্যতা বরাবরই দুই বিপরীত শক্তির লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। একদিকে আরামকেদায়ায় বসে একদল লোক অস্ত্রবলে-অর্থবলে চেষ্টা করেছে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ আগলে রাখতে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়া কর্মজীবী, শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত—হয় বেয়নেটের গুঁতোয়, নয়তো আইনশৃঙ্খলার আফিম খেয়ে কাবু হয়ে থেকেছে। কিন্তু কখনো কখনো এমন আশ্চর্য ঘটনাও ঘটে যে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে মানুষ। কেদারায় বসা মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখে, যারা এত দিন পদানত ছিল, তারাই ফুঁসে উঠেছে। কিছু
লোককে বেয়নেটে কাবু করা যায়, কিন্তু রাজপথে দাঁড়ানো লাখ লাখ মানুষকে কাবু করবে, এত বেয়নেট কোথায়?
তিউনিসিয়ার কবি আবু কাসিম আল-শাব্বির, যাঁর কবিতা আরব বিশ্বের মুক্তির স্তবগান হয়ে উঠেছে, পৃথিবীর সব একনায়কের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন এভাবে:
নিষ্ঠুর একনায়কেরা, শোনো
আঁধার ভালোবাসো যারা, শোনো
ঘাতক যারা, শোনো
নিরীহ মানুষের ক্ষতকে তোমরা উপহাস করো
তোমাদের হাতের তালু ভেজা মানুষের রক্তে
তোমরা
পায়ের নিচে মাড়াও মানুষের স্বপ্ন
ভূমিতে ছড়াও বেদনার বীজকণা
শোনো,
বসন্তের নির্মেঘ আকাশ ও সোনা ঝলমলে আলো দেখে
খুশি হয়ো না
ঈশান কোণে কালো মেঘ, বজ্রপাত ও প্রবল পবন
ধেয়ে আসছে তোমাদের দিকেই
মনে রেখো,
ছাই কণার নিচেই থাকে অঙ্গার।
যারা মাটিতে বিছায় কাঁটা
রেহাই নেই তাদের ক্ষত থেকে।
তোমরা
যারা শিরশ্ছেদ করো মানুষের
উপড়ে ফেলো ফুল
শুষ্ক বালুতে ছড়াও রক্ত ও মানুষের চোখের জল
মনে রেখো, তোমাদের
প্লাবিত করবে রক্তের নদী
উড়িয়ে নেবে ঝড়ের তাণ্ডব।
২০১১ সালের শেষ প্রহরে আভাস মিলছে সেই ঝোড়ো হাওয়ার। জেগে উঠছে মানুষ। ভোর হচ্ছে। প্রিয় বাংলাদেশ, এই জাগরণের সংবাদ তোমার জানা আছে তো?
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, জাতিসংঘে কর্মরত।
No comments