গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত : ফটোসেশন সর্বস্ব ত্রাণ
উজানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বইছে বিপদসীমার ওপরে। ভারতের গজলডোবা বাঁধের সব গেট খুলে দেয়ায় উত্তরাঞ্চলের রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। ফলে রাস্তাঘাট, ক্ষেতের ফসল, পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। নদীভাঙনে নির্ঘুম কাটছে দিনরাত। কিছু এলাকায় পানি কমলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না। বাঁধ বা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের তীব্র খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। গো-খাদ্য সংকটে কৃষক দিশেহারা। ত্রাণ দেয়া হলেও তা অপ্রতুল। আবার কিছু এলাকায় এখনও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। ত্রাণবঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুর্গত এলাকার মানুষ। সরকারিভাবে দেয়া ত্রাণসামগ্রীতে বানভাসি মানুষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কতিপয় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ বন্যার্তদের সহায়তার পরিবর্তে ফেসবুক-নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তারা বন্যার্ত লোকজনকে নিয়ে শুধু ফটোসেশনই করছেন। আর বন্যাদুর্গতদের নিয়ে তোলা সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী ও ডিমলা : মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে করে নদীর তীরবর্তী নীলফামারীর দুটি উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রামের ১০ সহস াধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সূত্র জানায়, উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সোমবার সকাল ৬টায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মঙ্গলবার সকালে পানি কমে বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার এবং বিকালে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইয়ে চলেছে নদীর পানি। ডিমলা উপজেলার পানিবন্দি মানুষ চুলা জ্বালাতে না পেরে দু’দিন ধরে শুকনা খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পূর্ব বাবইশপুকুর ও পশ্চিম বাইশপুর গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। মঙ্গলবার বন্যার পানি নেমে গেলেও নলকূপ পানিতে ডুবে থাকার কারণে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা : ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও আবাদি ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফুলছড়ির তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ সময় ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া তিস্তা, যমুনা ও করতোয়া নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বিকাল ৩টা পর্যন্ত ওইসব নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর : রায়গঞ্জে পানিতে ডুবে আদিল হোসেন (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সরাইহাজিপুর গ্রামের আল-আমিন হোসেনের ছেলে। আদিল ওই গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। সোমবার সন্ধ্যায় পাশের একটি ছোট সেতুর নিচে ডোবার পানি থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫ উপজেলার ৪৮টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এছাড়া নদী তীরবর্তীসহ চরাঞ্চলের নিচু এলাকায় উঠতি ফসল ডুবে গেছে। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্য সংকট। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এদিকে এখন পর্যন্ত সরকারি ত্রাণ তৎপরতা শুরু না হওয়ায় এসব এলাকার বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শাহজাদপুরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের ২ শতাধিক ঘরবাড়ি, অর্ধশতাধিক গাছপালা, ৩০০ বিঘা ফসলি জমি যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম, উলিপুর, নাগেশ্বরী, রৌমারী ও চিলমারী : কুড়িগ্রাম জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। হু-হু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, জ্বালানি, খাদ্য সংকট। কৃষক গবাদি পশু নিয়েও পড়েছেন চরম সংকটে। কারণ গো-খাদ্যের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। সরকার যে ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার বরাদ্দ যা পাওয়া যাচ্ছে, তা মাঠ পর্যায়ে বিতরণ হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। ফলে বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে।
লালমনিরহাট : তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে ধরলার পানি। এতে করে লালমনিরহাট সদর উপজেলায় নতুন করে আরও ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার আদিতমারী উপজেলায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত একটি বালুর বাঁধ ভেঙে প্রায় ৬ হাজার পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে স্থানীয়দের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বন্যার কারণে জেলার চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে প্রায় অর্ধশত বিদ্যালয়।
বগুড়া : সরিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি আরও বেড়েছে। মঙ্গলবার সকালে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বাঙালি নদীতে পানি বাড়লেও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার অন্তত ৭৫ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। মঙ্গলবার সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়নের চকরতিনাথ ও করমজাপাড়া গ্রামের ১৩৩টি পরিবারের বাড়িঘর স্থানান্তর করতে হয়েছে। এছাড়া ১২টি বাড়িঘর, টাকাসহ সব মালামাল নদীতে ভেসে গেছে।
রংপুর : রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৫০ গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তিস্তাপারের মানুষ। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই দিনে নোহালী ইউনিয়নের ১০টি বাড়ি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানান নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটু।
সিলেট, বালাগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ : সিলেটে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অতীতে এত দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকেনি সিলেটে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার বন্যার আচরণ অস্বাভাবিক। সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। বিয়ানীবাজারের বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিএনপি নেতা ফয়সল আহমদ চৌধুরীর অর্থায়নে উপজেলার কুড়ার বাজার মুড়িয়া ইউনিয়নে প্রায় ৪শ’ পরিবারের মাঝে চাল বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন সিলেট অঞ্চলের উদ্যোগে ওসমানীনগরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। গোলাপগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কাজ নেই, ঘরে চালও নেই- এমন দুর্বিষহ অবস্থায় দিনযাপন করছেন তারা। এসব কর্মহীন লোকজন কোথাও ত্রাণ বিতরণের সংবাদ শুনলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। বালাগঞ্জে সিলেট-২ আসনের এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ফটোসেশন এবং সেলফিবাজি না করে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বন্যার্ত অসহায় লোকজনকে সহায়তায় এগিয়ে আসুন।
সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর : সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের পক্ষ থেকে হাওরে আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার কৃষক পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা সদরের আবদুস সামাদ আজাদ অডিটোরিয়ামে প্রত্যেক পরিবারের হাতে ১০ কেজি চাল, এক কেজি ডাল ও এক লিটার ভোজ্যতেল তুলে দেয়া হয়।
গুরুদাসপুর (নাটোর) : বৃষ্টি হলেই বিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে উঠে পানিতে হয় টইটম্বুর। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে শ্রেণিকক্ষে। তখন নিয়মিত পাঠদান যেমন ব্যাহত হয় তেমনি বন্ধ হয়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলি ও খেলাধুলা। প্রবল বর্ষণে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে বিদ্যালয়টিতে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার রানীগ্রাম-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি।
চরফ্যাশন ও মনপুরা : মেঘনার হাত থেকে উপকূলীয় জনপথ চরফ্যাশন ও মনপুরাকে রক্ষার জন্য প্রায় ২শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ থাকলেও দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই দুই উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীপাড়ের প্রায় ৫ লাখ মানুষ। এরই মধ্য জোয়ারের পানির চাপে দুই উপজেলায় ভেঙে গেছে ২২ কিলোমিটার বাঁধ।
দিনাজপুর : বীরগঞ্জে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে দুটি স্কুলের প্রাঙ্গণ। ফলে হাঁটুপানি পেরিয়ে স্কুল ভবনে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এমনকি অনেক শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকে যাওয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
জামালপুর ও ইসলামপুর : জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় ব্যাপক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার ৬টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। জেলার ইসলামপুর-গুঠাইল, ইসলামপুর-উলিয়া, গুঠাইল-মলমগঞ্জ ও মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে।
নীলফামারী ও ডিমলা : মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে করে নদীর তীরবর্তী নীলফামারীর দুটি উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রামের ১০ সহস াধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সূত্র জানায়, উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সোমবার সকাল ৬টায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মঙ্গলবার সকালে পানি কমে বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার এবং বিকালে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইয়ে চলেছে নদীর পানি। ডিমলা উপজেলার পানিবন্দি মানুষ চুলা জ্বালাতে না পেরে দু’দিন ধরে শুকনা খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পূর্ব বাবইশপুকুর ও পশ্চিম বাইশপুর গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। মঙ্গলবার বন্যার পানি নেমে গেলেও নলকূপ পানিতে ডুবে থাকার কারণে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা : ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও আবাদি ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফুলছড়ির তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ সময় ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া তিস্তা, যমুনা ও করতোয়া নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বিকাল ৩টা পর্যন্ত ওইসব নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর : রায়গঞ্জে পানিতে ডুবে আদিল হোসেন (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সরাইহাজিপুর গ্রামের আল-আমিন হোসেনের ছেলে। আদিল ওই গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। সোমবার সন্ধ্যায় পাশের একটি ছোট সেতুর নিচে ডোবার পানি থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫ উপজেলার ৪৮টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এছাড়া নদী তীরবর্তীসহ চরাঞ্চলের নিচু এলাকায় উঠতি ফসল ডুবে গেছে। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্য সংকট। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এদিকে এখন পর্যন্ত সরকারি ত্রাণ তৎপরতা শুরু না হওয়ায় এসব এলাকার বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শাহজাদপুরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের ২ শতাধিক ঘরবাড়ি, অর্ধশতাধিক গাছপালা, ৩০০ বিঘা ফসলি জমি যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম, উলিপুর, নাগেশ্বরী, রৌমারী ও চিলমারী : কুড়িগ্রাম জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। হু-হু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, জ্বালানি, খাদ্য সংকট। কৃষক গবাদি পশু নিয়েও পড়েছেন চরম সংকটে। কারণ গো-খাদ্যের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। সরকার যে ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার বরাদ্দ যা পাওয়া যাচ্ছে, তা মাঠ পর্যায়ে বিতরণ হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। ফলে বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে।
লালমনিরহাট : তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে ধরলার পানি। এতে করে লালমনিরহাট সদর উপজেলায় নতুন করে আরও ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার আদিতমারী উপজেলায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত একটি বালুর বাঁধ ভেঙে প্রায় ৬ হাজার পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে স্থানীয়দের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বন্যার কারণে জেলার চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে প্রায় অর্ধশত বিদ্যালয়।
বগুড়া : সরিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি আরও বেড়েছে। মঙ্গলবার সকালে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বাঙালি নদীতে পানি বাড়লেও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার অন্তত ৭৫ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। মঙ্গলবার সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়নের চকরতিনাথ ও করমজাপাড়া গ্রামের ১৩৩টি পরিবারের বাড়িঘর স্থানান্তর করতে হয়েছে। এছাড়া ১২টি বাড়িঘর, টাকাসহ সব মালামাল নদীতে ভেসে গেছে।
রংপুর : রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৫০ গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তিস্তাপারের মানুষ। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই দিনে নোহালী ইউনিয়নের ১০টি বাড়ি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানান নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটু।
সিলেট, বালাগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ : সিলেটে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অতীতে এত দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকেনি সিলেটে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার বন্যার আচরণ অস্বাভাবিক। সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। বিয়ানীবাজারের বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিএনপি নেতা ফয়সল আহমদ চৌধুরীর অর্থায়নে উপজেলার কুড়ার বাজার মুড়িয়া ইউনিয়নে প্রায় ৪শ’ পরিবারের মাঝে চাল বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন সিলেট অঞ্চলের উদ্যোগে ওসমানীনগরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। গোলাপগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কাজ নেই, ঘরে চালও নেই- এমন দুর্বিষহ অবস্থায় দিনযাপন করছেন তারা। এসব কর্মহীন লোকজন কোথাও ত্রাণ বিতরণের সংবাদ শুনলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। বালাগঞ্জে সিলেট-২ আসনের এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ফটোসেশন এবং সেলফিবাজি না করে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বন্যার্ত অসহায় লোকজনকে সহায়তায় এগিয়ে আসুন।
সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর : সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের পক্ষ থেকে হাওরে আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার কৃষক পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা সদরের আবদুস সামাদ আজাদ অডিটোরিয়ামে প্রত্যেক পরিবারের হাতে ১০ কেজি চাল, এক কেজি ডাল ও এক লিটার ভোজ্যতেল তুলে দেয়া হয়।
গুরুদাসপুর (নাটোর) : বৃষ্টি হলেই বিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে উঠে পানিতে হয় টইটম্বুর। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে শ্রেণিকক্ষে। তখন নিয়মিত পাঠদান যেমন ব্যাহত হয় তেমনি বন্ধ হয়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলি ও খেলাধুলা। প্রবল বর্ষণে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে বিদ্যালয়টিতে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার রানীগ্রাম-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি।
চরফ্যাশন ও মনপুরা : মেঘনার হাত থেকে উপকূলীয় জনপথ চরফ্যাশন ও মনপুরাকে রক্ষার জন্য প্রায় ২শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ থাকলেও দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই দুই উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীপাড়ের প্রায় ৫ লাখ মানুষ। এরই মধ্য জোয়ারের পানির চাপে দুই উপজেলায় ভেঙে গেছে ২২ কিলোমিটার বাঁধ।
দিনাজপুর : বীরগঞ্জে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে দুটি স্কুলের প্রাঙ্গণ। ফলে হাঁটুপানি পেরিয়ে স্কুল ভবনে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এমনকি অনেক শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকে যাওয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
জামালপুর ও ইসলামপুর : জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় ব্যাপক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার ৬টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। জেলার ইসলামপুর-গুঠাইল, ইসলামপুর-উলিয়া, গুঠাইল-মলমগঞ্জ ও মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে।
No comments