ঐতিহ্যবাহী পাটখাত এখন ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছেঃ সরকার কী করছে?

কসময় পাট ছিল এ দেশের গর্ব। তখন দেশের অর্থনীতির তেজিভাব বজায় রাখার নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছিল এই পাট। তাই একে আদর করে বলা হতো সোনালি আঁশ। সেই সোনালি আঁশ রফতানি আয়ই ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। এখানকার পাটকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে পাটশিল্পের বিকাশে তদানীন্তন সরকার নিয়েছিল বিশেষ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা। সব ধরনের সহযোগিতা পেয়ে বেশ দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল পাটশিল্প।

বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজী ছিল আমাদের অহঙ্কার। ধারণা করা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে পাটশিল্প বাধাহীনভাবে বিকশিত হবে। দেশ-জাতি ও জনগণের উন্নতিও নির্বিঘ্ন হবে; কিন্তু দুঃখজনক সত্য, বাস্তবে কিছুই হয়নি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার পাটশিল্পসহ বড় শিল্প-কারখানাগুলো জাতীয়করণের নামে এমন এক ব্যবস্থা চালু করে, যা লুটপাট আর দুর্নীতির পথ অবাধ করে তোলে। পরবর্তী কোনো সরকারই সে অবস্থা থেকে পাটশিল্পকে বের করে আনতে পারেনি। অবিশ্বাস্য লোকসানের বদনাম নিয়ে একের পর এক বন্ব্দ হতে থাকে পাটকলগুলো। পাটের এ মরণদশা কিছুটা হলেও ঠেকিয়েছিল বেসরকারি পাটকলগুলো। সেগুলো লাভজনকভাবে বিদেশে পাটজাতদ্রব্য রফতানি করার পথ করে নিয়েছিল; কিন্তু এখন সেখানেও নেমে এসেছে অন্ব্দকার। এই অন্ব্দকার দূর করার জন্য এখন পর্যন্ত সরকার কোনো কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে বলা যাবে না। গতকাল আমার দেশ-এ প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ সেখানে টিকতে পারছে না। এদেশের কাঁচা পাট নিয়ে ভারত ও চীন উন্নতমানের পাটজাত পণ্য তৈরি করে বিশ্ববাজার দখল করে নিচ্ছে। কাঁচা পাট রফতানির সুযোগে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী কাগজপত্রে নিম্নমানের দেখিয়ে উন্নতমানের পাট ভারত ও চীনে রফতানি করছে। ফলে সরকার শুধু রাজস্ব আয় থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, দেশের পাটকলগুলোও উন্নতমানের পাট সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের প্রতিযোগিতায় পাটের দেশ বাংলাদেশ মার খাচ্ছে ভারত ও চীনের কাছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের অনিয়ম, চুক্তি অনুযায়ী পণ্য রফতানি না করা, উন্নতমানের নমুনা দেখিয়ে নিম্নমানের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করা প্রভৃতি কারণেও বিদেশে দীর্ঘদিনের বাজার হারাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এজন্য প্রয়োজনীয় নজরদারি, পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাট রফতানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেলেও সরকারি প্রতিনিধিদল দেন-দরবার করে তাদের পক্ষে কাজ করা ছাড়া বেশি কিছু করেনি। দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী প্রমাণিত অসত্ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা এখনও জানা যায়নি। ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার ক্রমাগতভাবে কমে আসায় পাটজাত পণ্যের ব্যবহার যখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের পাটশিল্পের উল্টো যাত্রা দুঃখজনক বলা মোটেই যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর পাশাপাশি দেশেও একের পর এক পাটকল বন্ব্দ হয়ে গেছে। বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও চাহিদামত সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে দেশের ১৭৪টি পাটকলের মধ্যে ৩৩টি এরই মধ্যে বন্ব্দ হয়ে গেছে। অন্য ৪০টিও এখন বন্ব্দের পথে। আরেকটি সমস্যা হলো, পাটশিল্পে আমরা এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছি। আগের মতো পাটের দড়ি, চট বা বস্তা তৈরির বেশি তেমন কিছু করতে পারছি না আমরা। অথচ বিশ্বজুড়ে নিত্যনতুন নানা ধরনের পাটজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সে সব উত্পাদনের জন্য যে ধরনের উদ্যোগ, আয়োজন অপরিহার্য তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আমাদের পাটমন্ত্রী বা পাট মন্ত্রণালয় গতানুগতিক কাজ ও আমলাতান্ত্রিক জটাজাল ছিন্ন করে সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে আগ্রহী না হলে কে আর এগিয়ে আসবে? এক্ষেত্রে পাটকল মালিকদের সংগঠনও চোখে পড়ার মতো কিছু করতে পারছে না। এ অবস্থায় পাট উত্পাদন ও পাটশিল্পের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত কয়েক কোটি মানুষ কার ওপর ভরসা রাখবে? বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ডিজিটাল ব্যবস্থা ঘোষণা আর পদক্ষেপের যে পরিণতি দেখা যাচ্ছে, তাতে পাটশিল্পের ডিজিটাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দূরের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

No comments

Powered by Blogger.