আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮৮)-বাংলার বাতাসে সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারা by আলী যাকের
১৬ তারিখ রাতে যশোর রোডের ধারে একটা দোকানে বসে আমার রাজনৈতিক ধারাভাষ্য রেকর্ড করলাম। ইংরেজি ভাষায় সারা বিশ্বকে জানালাম আমরা স্বাধীন। তারপর সেই টেপটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে ওই ধারাভাষ্য প্রচারিত হলো।
এরপর যশোর হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস এবং পরশ নিয়ে সারা দেহ-মনে ফিরে এলাম কলকাতায়। তখনো শরণার্থীদের ঘরমুখী যাত্রা শুরু হয়নি। সাধারণ মানুষ তখনো বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে? ভারত কিংবা বাংলাদেশ সরকার তখনো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি এ ব্যাপারে। বাংলাদেশের সর্বত্র পরিস্থিতি তখনো সম্পূর্ণ স্থিতাবস্থায় পৌঁছেনি। কিছু কিছু স্থানে, যেমন ঢাকার মিরপুর, রংপুরের সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, খুলনার খালিশপুর- এসব এলাকায় যেখানে অবাঙালিদের সংখ্যাধিক্য ছিল সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের পরও অস্থিরতা বিরাজ করছিল। বাংলাদেশের অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বাঙালিদের হত্যা কিংবা নির্যাতন করেছিল, তারা তখনো মুক্ত বাংলাদেশের অনিবার্যতাকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছিল না। সে কারণে বাংলাদেশের সর্বত্র নিরাপদে যাওয়া-আসা করায় একধরনের সমস্যা ছিল বৈকি। স্মর্তব্য যে আমাদের বিজয়ের কিছুদিনের মধ্যে জানুয়ারির ৩০ তারিখে জহির রায়হান ঢাকার মিরপুরে পুলিশ পাহারায় প্রবেশ করেছিলেন তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে। তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারও ছিলেন; কিন্তু নানা রকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙালি কিছু বাংলাদেশবিরোধী এবং তাদের সঙ্গে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের গুলিতে তাঁরা সবাই শহীদ হন। বস্তুতপক্ষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা নিজেদের বাসভূমির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে আরো অনেক পরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং বাংলাদেশ সরকারের গুছিয়ে বসে কার্যক্রম শুরু করার পর।
মনে পড়ে, ডিসেম্বরের ২২ কি ২৩ তারিখে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ইংরেজিতে একটি রাজনৈতিক ধারাভাষ্য লিখি, যার শিরোনাম ছিল, 'তুমি আজ কোথায়, পিতা?' অত্যন্ত ভাবাবেগ আক্রান্ত এই ধারাভাষ্যে আমি লিখেছিলাম যে 'যখন বাংলার আকাশ-বাতাস, বনভূমি এবং জলা বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা, তখনো কোন অদৃশ্য শঙ্কায় আমাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। কেননা তুমি এখনো আমাদের মাঝে নেই, পিতা!' ক্রমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ ক্ষীণ হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল। তত দিনে বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত বেতার কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার কাজ শেষ। আমি কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই; কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় নেই। কেননা আমার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব তখনো শেষ হয়নি। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছিল না আর। ঢাকা শহর দেখার জন্য মন আকুল হয়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে জানুয়ারি মাস চলে এলো। আমার বিদায়ের দিনও এলো ঘনিয়ে। ৮ জানুয়ারি আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আমরা বেশ কয়েকজন সহকর্মী মিলে একটি বাস ভাড়া করলাম, যা আমাদের পদ্মারপারে গোয়ালন্দে পৌঁছে দেবে। তারপর সেখান থেকে আমরা নৌকা ভাড়া করে নদীর ওপারে গিয়ে আরিচা থেকে যেভাবে পারি ঢাকায় পৌঁছাব। আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে অংশগ্রহণকারী বেশ কিছু নানা বয়সী নারীও ছিলেন।
৯ জানুয়ারি আমরা ঢাকার উদ্দেশে কলকাতা ত্যাগ করলাম। যাত্রা শুরু করেছি ভোর ৬টায়। কলকাতা থেকে বনগাঁ হয়ে যশোর রোড ধরে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা হয়ে দর্শনা পৌঁছাতে আমাদের সারা দিন পেরিয়ে গেল। গোয়ালন্দে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। গোয়ালন্দে নদীর অদূরেই একটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ডাকবাংলোয় রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। যুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এখন পরিত্যক্ত। আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম তখনো জায়গাটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই ছিল। পথে আসতে আসতে আমাদের সঙ্গীরা ঐকতানে একের পর এক গান করছিল। নানা রকম গান। আমাদের জাতীয় সংগীত দিয়ে আরম্ভ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা', নজরুলের 'এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' হয়ে হেমন্তের গাওয়া 'মা গো ভাবনা কেন', এসব গান। জীবনে কখনো বাংলাদেশের এত দূর আসতে পারব কল্পনাও করিনি। জীবনে এই প্রথম দেখছি, এমন মানসিকতা নিয়ে সব দৃশ্য চেখে চেখে দেখছিলাম। কী আনন্দ, কী আনন্দ! আমার দেশের ক্ষেত-খামার, বৃক্ষরাজি, ছোট ছোট গ্রামীণ ঘরবাড়ি, বাচ্চাদের খেলে বেড়ানোর কলকাকলি, পুকুরঘাটে বঙ্গ ললনার কলসি কাঁখে পানি নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য- সব কিছুই নতুন বলে মনে হচ্ছিল। কিছু যখন ফিরে পাওয়ার আশা থাকে না, তখন অকস্মাৎ তা পেলে মানুষ সত্যিই আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। আমারও হয়েছিল সেই দশা। তবে একটা জিনিস লক্ষ করেছি এবং তাতে কোনো অত্যুক্তি করার কিছু নেই। মনে হচ্ছিল দীর্ঘদিন পরে এক ভীত, শঙ্কিত মানবগোষ্ঠী যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে আবার। বাধা-বেদনার অর্গল ভেঙে গেছে। তাই অবলীলায় তারা হাসছে, খেলছে, কাজ করে চলেছে। পথে আরো লক্ষ করছিলাম যে বিভিন্ন গ্রামে সব মানুষ হাত লাগিয়েছে ভেঙে যাওয়া পায়ে চলার পথকে পুনর্নির্মাণ করতে। কোথাও বিধ্বস্ত সাঁকো নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে। দ্বিধাহীনভাবে মাথায় মাটি বয়ে নিয়ে আসছে কিংবা বাঁশ আর দড়ি নিয়ে কাজে ব্যস্ত। আমরা গান গাইতে গাইতে বাসের জানালা দিয়ে তাদের প্রতি হাত নাড়ালে তারাও সহাস্যে হাত নেড়ে আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে কী সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারছি এই বাংলার বাতাসে। যে বাতাস এখন অবাধে বিচরণ করছে সারা দেশে। পারছি হাসতে, গাইতে। ভাবতে ভাবতেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে।
(চলবে...)
মনে পড়ে, ডিসেম্বরের ২২ কি ২৩ তারিখে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ইংরেজিতে একটি রাজনৈতিক ধারাভাষ্য লিখি, যার শিরোনাম ছিল, 'তুমি আজ কোথায়, পিতা?' অত্যন্ত ভাবাবেগ আক্রান্ত এই ধারাভাষ্যে আমি লিখেছিলাম যে 'যখন বাংলার আকাশ-বাতাস, বনভূমি এবং জলা বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা, তখনো কোন অদৃশ্য শঙ্কায় আমাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। কেননা তুমি এখনো আমাদের মাঝে নেই, পিতা!' ক্রমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ ক্ষীণ হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল। তত দিনে বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত বেতার কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার কাজ শেষ। আমি কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই; কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় নেই। কেননা আমার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব তখনো শেষ হয়নি। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছিল না আর। ঢাকা শহর দেখার জন্য মন আকুল হয়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে জানুয়ারি মাস চলে এলো। আমার বিদায়ের দিনও এলো ঘনিয়ে। ৮ জানুয়ারি আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আমরা বেশ কয়েকজন সহকর্মী মিলে একটি বাস ভাড়া করলাম, যা আমাদের পদ্মারপারে গোয়ালন্দে পৌঁছে দেবে। তারপর সেখান থেকে আমরা নৌকা ভাড়া করে নদীর ওপারে গিয়ে আরিচা থেকে যেভাবে পারি ঢাকায় পৌঁছাব। আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে অংশগ্রহণকারী বেশ কিছু নানা বয়সী নারীও ছিলেন।
৯ জানুয়ারি আমরা ঢাকার উদ্দেশে কলকাতা ত্যাগ করলাম। যাত্রা শুরু করেছি ভোর ৬টায়। কলকাতা থেকে বনগাঁ হয়ে যশোর রোড ধরে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা হয়ে দর্শনা পৌঁছাতে আমাদের সারা দিন পেরিয়ে গেল। গোয়ালন্দে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। গোয়ালন্দে নদীর অদূরেই একটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ডাকবাংলোয় রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। যুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এখন পরিত্যক্ত। আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম তখনো জায়গাটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই ছিল। পথে আসতে আসতে আমাদের সঙ্গীরা ঐকতানে একের পর এক গান করছিল। নানা রকম গান। আমাদের জাতীয় সংগীত দিয়ে আরম্ভ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা', নজরুলের 'এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' হয়ে হেমন্তের গাওয়া 'মা গো ভাবনা কেন', এসব গান। জীবনে কখনো বাংলাদেশের এত দূর আসতে পারব কল্পনাও করিনি। জীবনে এই প্রথম দেখছি, এমন মানসিকতা নিয়ে সব দৃশ্য চেখে চেখে দেখছিলাম। কী আনন্দ, কী আনন্দ! আমার দেশের ক্ষেত-খামার, বৃক্ষরাজি, ছোট ছোট গ্রামীণ ঘরবাড়ি, বাচ্চাদের খেলে বেড়ানোর কলকাকলি, পুকুরঘাটে বঙ্গ ললনার কলসি কাঁখে পানি নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য- সব কিছুই নতুন বলে মনে হচ্ছিল। কিছু যখন ফিরে পাওয়ার আশা থাকে না, তখন অকস্মাৎ তা পেলে মানুষ সত্যিই আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। আমারও হয়েছিল সেই দশা। তবে একটা জিনিস লক্ষ করেছি এবং তাতে কোনো অত্যুক্তি করার কিছু নেই। মনে হচ্ছিল দীর্ঘদিন পরে এক ভীত, শঙ্কিত মানবগোষ্ঠী যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে আবার। বাধা-বেদনার অর্গল ভেঙে গেছে। তাই অবলীলায় তারা হাসছে, খেলছে, কাজ করে চলেছে। পথে আরো লক্ষ করছিলাম যে বিভিন্ন গ্রামে সব মানুষ হাত লাগিয়েছে ভেঙে যাওয়া পায়ে চলার পথকে পুনর্নির্মাণ করতে। কোথাও বিধ্বস্ত সাঁকো নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে। দ্বিধাহীনভাবে মাথায় মাটি বয়ে নিয়ে আসছে কিংবা বাঁশ আর দড়ি নিয়ে কাজে ব্যস্ত। আমরা গান গাইতে গাইতে বাসের জানালা দিয়ে তাদের প্রতি হাত নাড়ালে তারাও সহাস্যে হাত নেড়ে আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে কী সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারছি এই বাংলার বাতাসে। যে বাতাস এখন অবাধে বিচরণ করছে সারা দেশে। পারছি হাসতে, গাইতে। ভাবতে ভাবতেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে।
(চলবে...)
No comments