অর্থনীতি-বছরটা ভুলে যেতে পারলে ভালো হতো by শওকত হোসেন

০১১ সালকে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থমন্ত্রীরাই ভুলে যেতে চাইবেন। বিদায়ী বছরটি অর্থনীতির জন্য ভালো ছিল না। পুরোটা সময় কেটেছে মন্দার আশঙ্কার মধ্যে। বিশেষ করে, ইউরোপের জন্য বছরটি ছিল ভুলে যাওয়ার।শেষ সময়ে এসে সামান্য হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত, চীন ও ব্রাজিলের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতিও কিছুটা ভালো। তবে পুরো বিশ্বকে টেনে তোলার মতো আশাবাদী হতে পারছেন না কেউই। মন্দা কাটছে, এ কথা বলা


যাচ্ছে না। সারা বিশ্বে মন্দা, তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিও চাপের মুখে—এমনটি বলার অবকাশ অবশ্য আমাদের অর্থমন্ত্রীর নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাপ এসেছে ভেতর থেকে। বিশ্বমন্দা সেই চাপকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করছে। বাংলাদেশের জন্য ২০১১ সাল মূলত নীতির দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতার বছর।
বছরটি যে ভালো যাবে না, তার পরিষ্কার ইঙ্গিত আগের বছরেই ছিল। শেয়ারবাজারের বিরাট ধস আর মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়েই শুরু হয় ২০১১। শেয়ারবাজারের দ্বিতীয় দফা ধসও নামে বছরটিতে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পুরো বছর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। বছরের শেষ সময়ে এসে বাজার খানিকটা স্থিতিশীল হওয়ার আশ্বাস দিলেও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে শেয়ারবাজারে এবার ধস নামেনি। এর জন্য নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রকদের অদক্ষতা এবং কিছু মানুষের লোভই দায়ী। অদক্ষ ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেনি সরকার। বলা যায়, কিছু শক্তিশালী মানুষের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বাহবা কুড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশে দেরি করে নিন্দাও কুড়ান। এই সুযোগ নিয়ে কারসাজিকারীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠলে বাজারে দ্বিতীয় দফা ধস নামে।
২০১১ সাল সাধারণ মানুষকে কোনো স্বস্তিই দিতে পারেনি। শেয়ারবাজার লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে রাস্তায় নামিয়েছে। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে কঠিন করে রেখেছে। বিদায়ী সালটি ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতির বছর। ১২ মাসের ১০ মাসেই ছিল ১০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি। টানা ১০ মাস ধরে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি থাকাটা একটি নতুন রেকর্ড। এই মূল্যস্ফীতি সামগ্রিক অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিকে যে সংকটে ফেলে দিয়েছে, বছরের শেষে এসে তা স্বীকার করেও নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
২০১১ সালে সরকার বড় সংকটে পড়ে পদ্মা সেতু নিয়ে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে ঋণ দেওয়া স্থগিত করে দেয় বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতারা। এতে আটকে যায় ২৩০ কোটি ডলার। এই অর্থ পাওয়া শুরু হলে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা মুক্ত থাকতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমতে শুরু করেছিল। ইউরোপ-আমেরিকার মন্দা বাংলাদেশের রপ্তানি কমিয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট প্রবাসী-আয়ের প্রবৃদ্ধিও হ্রাস করে। তাই ভরসা ছিল বৈদেশিক সাহায্য।
বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো থেকে ডলার পায়নি আমদানিকারকেরা। চাহিদা ও জোগানের এই অসামঞ্জস্যের কারণে এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি। ৬৯ টাকার ডলার হয়ে গেছে ৮১ টাকা। এতে চাপ পড়ে মূল্যস্ফীতিতে।
এর মধ্যে আবার সরকার ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিতে শুরু করে। ভর্তুকি সব লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কেবলই বেড়েছে। ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতও ঋণ পেয়েছে কম।
২০১১ সালে অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। অথচ জুনে বাজেট পেশ ও পাসের সময়েও পরিস্থিতি এতটা খারাপ মনে হয়নি। তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরকার সংকটের কথা স্বীকারই করেনি। ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আসেনি কোনো পরিবর্তন। এতে সংকট আরও প্রকট হয়েছে। শেষ সময়ে এসে অবশ্য অর্থনীতির সংকট স্বীকার করে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। স্বীকার করে নেওয়া একটি ধাপ। এখন এ থেকে নীতিনির্ধারকেরা কী ব্যবস্থা নেন, তার ওপরই নির্ভর করছে নতুন বছরের অর্থনীতি।
২০১২ সালের জন্য প্রত্যাশা অনেক। শেয়ারবাজার স্বাভাবিক বাজারে পরিণত হবে, মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, বাড়বে বিনিয়োগ, শুরু হবে পদ্মা সেতুর কাজ, আসবে বৈদেশিক সাহায্য, প্রবাসীরা আরও টাকা পাঠাবেন। প্রশ্ন হলো, এমনটি কি ঘটবে? অর্থমন্ত্রী কি পারবেন?
২০১২ সালে বিশ্ব-অর্থনীতির মন্দা কতটা দীর্ঘ হবে, এটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। ক্ষমতা পাওয়ার পর ২০০৯ সালে মন্দা থেকে উপকার পেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। মূল্যস্ফীতি কমে আসছিল বলে সে সময়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হয়। কিন্তু এবার তেমনটি হচ্ছে না। কারণ, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। ফলে কৌশল পাল্টাতে হবে নীতিনির্ধারকদের।
২০১২ সালের জন্য অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে তিন বছর বয়সী সরকারের জন্য। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই এর মধ্যে প্রধান। টানা ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি হয়ে আছে। মূল্যস্ফীতি এখন গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতির যে সূচকটি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। একটি সরকারের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি মূল্যস্ফীতি। নতুন বছর রাজনীতির দিক থেকে খানিকটা টালমাটাল থাকবে বলা যায়। নতুন বছর সরকারের জন্য চতুর্থ বছর। এ সময় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা সরকারের নিজের জন্যও প্রয়োজন। এ জন্য অর্থনীতিতে যে যমজ ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। তা হলো, বাজেট ঘাটতি ও লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি। মূল্যস্ফীতির চাপ অসহনীয় হয়ে ওঠার মূল কারণই এই যমজ ঘাটতি।
সামনে পথ দুটি। প্রথমটি হলো, সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। কথাটি বলা সহজ, বাস্তবায়ন করা কঠিন। বিশেষ করে, অর্থনীতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে ব্যয় সংকোচন খুব সহজ কাজ নয়। কারণ, ব্যয় সংকোচন মানেই এখন ভর্তুকি কমানো। ভর্তুকির ব্যয় কমাতে সরকারের পক্ষে এখন আর জ্বালানি তেল কেনা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়তো হবে না। তাতে বিদ্যুতের সংকট প্রকট হবে। পথ তাহলে বিদ্যুতের দাম ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো। সরকার এই সহজ পথেই এখন হাঁটছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। সুতরাং, ২০১২ সাল নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কম।
অর্থমন্ত্রীর সামনে আরেকটি পথ হচ্ছে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড় করানোর ব্যবস্থা করা। সরকারি বিনিয়োগ এখন নাজুক অবস্থায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির বাস্তবায়ন গত অর্থবছরের তুলনায় অনেকটাই খারাপ। প্রকল্প সাহায্য আনতে না পারাই এর বড় কারণ। ব্যবহার করতে না পারায় পাইপলাইনে এখন প্রায় ৬০০ কোটি ডলার আটকে আছে। আর এই সাহায্য আনতে হলে পদ্মা সেতুর একটি সুরাহা করতে হবে। দাতাদের প্রভাব কমানোর দাবি প্রায় সব মহল থেকেই থাকে। দাতাদের অযৌক্তিক শর্তে রুখে দাঁড়াবে সরকার, এমনটা প্রত্যাশা অনেকেরই। কিন্তু এবার সরকার যুদ্ধে নেমেছে একটি নাজুক বিষয়কে কেন্দ্র করে। সেটি হচ্ছে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি। এই যুদ্ধে লাভ নেই, পুরোটাই ক্ষতি।
সংকট নিরসনে সবচেয়ে সহজ পথটাই হয়তো এবার বেছে নেবে সরকার। আর তা হলো আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া। ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই অর্থ লেনদেনের ভারসাম্যে কিছু প্রলেপ হয়তো দেবে, তবে এ জন্য অনেকগুলো শর্ত মানতে হবে সরকারকে। আইএমএফের শর্ত মানেই তো বাজারে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। তাদের শর্ত মানলে বিনিয়োগ কমবে, প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে। তাতে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমলেও অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়বে। আইএমএফের অর্থ নিলে অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা হয়তো ফিরবে ২০১২ সালে, কিন্তু তাতে মানুষের জীবনযাত্রায় বড় কোনো উত্তরণ ঘটবে না।
পাকিস্তান কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। তাও প্রাসঙ্গিক হবে বলে লোভ সামলানো গেল না। ২০০৪-০৫ অর্থবছরের বাজেট-বক্তৃতায় সে সময়ের অর্থমন্ত্রী শওকত আজিজ বলেছিলেন, ‘আইএমএফকে “গুডবাই” জানানোর মধ্য দিয়ে বাজেটে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’ কারণ, আইএমএফের একটি ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ তখনই শেষ হয়েছিল। বাংলাদেশ আবার আইএমএফের সঙ্গে নতুন ঋণ কর্মসূচিতে যাচ্ছে। এতে নতুন বছরে নীতির সার্বভৌমত্ব কতটুকু থাকবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
শেয়ারবাজার বাদ দিলে ২০১১ সালের শুরুটা ভালোই ছিল। শেষটা ভালো হয়নি। অনেক সমস্যা নিয়ে শুরু হচ্ছে ২০১২। সঠিক নীতি ও দক্ষ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখা ছাড়া আমাদের কীই-বা আর করার আছে।
লেখক: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.