উত্তরাধিকার by সুভাষ সাহা

কোনো পরিবারের প্রধান মৃত্যুবরণ করলে তার সম্পত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তান-সন্ততির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরাধিকারী যদি চালাক-চতুর বা সম্পত্তি রক্ষার মতো উপযুক্ত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন না হলে কালক্রমে সে করুণ রসের লোককাহিনীতে পরিণত হতে পারে। কোম্পানির শেয়ারের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বেসরকারি সামাজিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতো একইভাবে নির্ণীত হওয়ার কথা


নয়। তারপরও অনেক দেশের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ধারাটা শক্তিশালী। আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। এখানে জাতীয় স্তরে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন এবং সরকার ও প্রধান দুটি দলের নেতৃত্ব মেনে নিতে দেশবাসী ও দলের নেতাকর্মীদের কোনো দ্বিধা হয়নি। তারা দু'জনই স্বৈরাচার আমলে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনের ধারায় ক্ষমতা ও দলের শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসেন। সে কারণে সবাই তাদের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার অংশরূপেই গ্রহণ করেছে। আর তখন রাজনীতিবিদদের ডিগবাজি ও অনেকক্ষেত্রে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে চলার নীতি মানুষ পছন্দ করেনি। তাই উত্তরাধিকার হিসেবে রাজনীতিতে এলেও হাসিনা-খালেদার আপেক্ষিক নেতৃত্বগুণ তাদের জাতীয় নেতার স্তরে উন্নীত করেছিল। সেই থেকে তারা সরকার ও দলের নেতৃত্বের দণ্ড এক হাতে সামলাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আর দীর্ঘকাল প্রধান ব্যক্তির আসনটিতে সমাসীন থাকার কারণে তাদের ঘিরে কিছু তল্পিবাহকেরও জন্ম হয়েছে। এখন তো খালেদা জিয়ার পর তারেক এবং হাসিনার পর জয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, এটা অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন। মানুষ হাসিনা-খালেদাকে যেভাবে দল ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব পদে বরণ করে নিয়েছিল, তারেক বা জয়কে কি একইভাবে তাদের ভবিষ্যৎ নেতার পদে বরণ করে নেবে কিনা সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
রাজনীতিতে এই ধারাকে অনেকে পরিবারতন্ত্র, উত্তরাধিকারের রাজনীতি, ইত্যাকার তকমাবন্দি করতে চান। প্রশ্ন হলো, তারেক (যদি দণ্ডিত না হন) বা জয় বা তারেকের স্ত্রী রাজনীতি করলে দেশ কি রসাতলে যাবে? ভারতে একই তরিকায় উত্তরাধিকারের রাজনীতি সুদীর্ঘকাল ধরেই ঘাঁটি গেড়ে আছে। জওয়াহেরলাল নেহরুর পর সামান্য বিরতি দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী, তার নিহত হওয়ার পর রাজীব গান্ধী এবং এরপর বেশ কিছুদিন বিরতি দিয়ে সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস ও জোটনেত্রীর পদ অলঙ্কৃত করা এবং বর্তমানে রাহুলকে দলের ও সরকারের শীর্ষে নিয়ে আসার মহড়া লক্ষণীয়। বিভিন্ন রাজ্যের রাজা-মহারাজার পরিবার, রাজনৈতিক স্টলওয়ার্ডদের পুত্র-কন্যা-পরিজন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও রাজ্য সরকার এমনকি স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদে বরণীয় হচ্ছেন।
আমাদের এখানে অবশ্য উত্তরাধিকার বা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিকেই তোপ দাগতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে এক বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশে নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তনের পক্ষে বলার সময় আপন দুই ভাইকে দুই পাশে বসিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে দেখা গেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তো পারিবারিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বলতে বলতে এক সময় হয়রান হয়েছেন। কিন্তু দেখা গেল তিনিও পরিবারকেই সার করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বেলায়ও একই দৃশ্য নজরে আসবে।
এটা ঠিক যে, উত্তরাধিকারের রাজনীতি দীর্ঘকাল বজায় থাকলে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে নতুন নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগটা সীমিত হয়ে পড়ে। সে কারণেই হয়তো ইউরোপ ও আমেরিকায় রাজনীতিতে উত্তরাধিকারকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরুৎসাহিত করা হয়। তাই বলে কেনেডি পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের দৃষ্টান্ত বা বুশ পরিবারের কথা ভুলে থাকা যায় না। এমনকি ক্লিনটন পরিবারও-বা কম যায় কিসে! কর্তার কোনো দোষ ধরতে নেই, যত দোষ নন্দ ঘোষের!

No comments

Powered by Blogger.