বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হালচাল-শিক্ষা by মোঃ মর্তুজা আহমেদ
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়ালেখার স্থান নয়, এটি মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রও, এ ক্ষেত্রে সুপ্রশস্ত ক্যাম্পাস, আধুনিক লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম, মেডিকেল সেন্টার, সুইমিং পুল, স্টেডিয়াম, লেকচার থিয়েটার, ডিজিটাল ল্যাব একান্ত প্রয়োজন। এগুলো শিক্ষার সহায়ক। এগুলোকে বাদ দিয়ে একজন শিক্ষার্থী মননশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারে না এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দশ শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৮ জন। পাস করেছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার
২৬১ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৪ হাজার ৩৮৫ জন। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের প্রথম পছন্দ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। কারণ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যার চেয়ে এইচএসসিতে পাসের সংখ্যা অনেক বেশি। গত ৫ বছরে বাংলাদেশে মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এক বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৫%। এ রকম একটি অবস্থায় ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এ আইনের আওতায় দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই কম। পড়ালেখার খরচ বেশি হওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র অথচ মেধাবীরা পড়ার সুযোগ খুব কমই পায়।
দেশে প্রায় ১ হাজার ৭৫০টি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। কিন্তু কলেজগুলো সব জেলা-উপজেলা সদরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে ভর্তি হতে চায় না। দেশে ৩১টি সরকারি এবং ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বুয়েট, সরকারি মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, লেদার টেকনোলজি, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ হাজার আসন রয়েছে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না আসন সংখ্যার সংকটের কারণে।
যেসব শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না তাদের দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (বেবি), কিন্তু বেবির পড়ালেখার ব্যয় এত বেশি যে সবার পক্ষে তা মেটানো সম্ভব হয় না। ৫৪টি বেবিতে মোট আসন সংখ্যা ৫০ হাজার (বাংলাদেশ অর্থনীতিক সমীক্ষা, ২০০৬)। অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন বেবির উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়, সব বেবি ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই জমির অপ্রতুলতার কারণে নিচতলায় কাবাবের দোকান, দ্বিতীয়তলায় ভার্সিটি এবং তৃতীয়তলায় মার্কেট, এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা শহরে সবার চোখে পড়ে। ঢাকার বাইরে যতগুলো বেবি আছে তা আউটার ক্যাম্পাস নামে পরিচিত। সরকার ইতিমধ্যে এগুলো অবৈধ ঘোষণা করেছে। যেখানে ইউজিসি ঢাকার মধ্যে অবস্থিত বেবিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেখানে আউটার ক্যাম্পাসে পড়ালেখার মান কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? ক্রমেই আউটার ক্যাম্পাসগুলো কোচিংসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। মালিক পক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলাদলিতে বিভক্ত হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষার মানও এখন দুই ধরনের। বেবির পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খাতা মূল্যায়ন এবং প্রশ্ন প্রণয়ন সবসময় বহিঃশিক্ষক এবং অভ্যন্তরীণ শিক্ষক দিয়ে করিয়ে থাকে। অন্যদিকে বেবির সবকিছু কোর্স শিক্ষক করেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মেধার পরিচয় সৃজনশীলতার প্রতি নজর না দিয়ে, শিটসর্বস্ব পড়ালেখার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। শিক্ষকই যেহেতু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন করছে এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, ছাত্রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। বেবির ছাত্ররা বেশি সিজিপিএ নিয়ে কর্ম বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু সিজিপিএর মতো যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দ্বৈত মূল্যায়ন, প্রশ্ন প্রণয়নের জাঁতাকলে নামসবর্স্ব ভালো সিজিপিএ পাচ্ছে না। কিন্তু চাকরির বাজারে গিয়ে চরম হোঁচট খাচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনস্বীকার্য। কিন্তু দ্বৈতমান কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই কাঠামোতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়ালেখার স্থান নয়, এটি মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রও, এ ক্ষেত্রে সুপ্রশস্ত ক্যাম্পাস, আধুনিক লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম, মেডিকেল সেন্টার, সুইমিং পুল, স্টেডিয়াম, লেকচার থিয়েটার, ডিজিটাল ল্যাব একান্ত প্রয়োজন। এগুলো শিক্ষার সহায়ক। এগুলোকে বাদ দিয়ে একজন শিক্ষার্থী মননশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারে না। বেবি এ সংক্রান্ত সহায়ক বিষয় বরাবরই অবহেলা করে আসছে। এ কারণে বেবি প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পার হলেও তারা যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই হলো যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সংগঠন, সমাজ তথা দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব দান করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তি দেখাতে পারে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এত সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তাদের নাম নেই, এর বর্ণনা পরে করা যাবে। এখানেই বেবি সাফল্য রাখতে পারবে। বেবি যদি এসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বেবির দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারবে, যা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারেনি।
সংস্টৃ্কতি, খেলাধুলা, ডিবেট এবং মুক্তচিন্তার চর্চার সমন্বয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা যদি বাণিজ্যের উপকরণ হয়, সে জাতির মেরুদণ্ডই ভেঙে যায়। বেবির বিজ্ঞাপনগুলো দেখে মনে হয় উচ্চশিক্ষা এখন পণ্য হয়ে গেছে এবং তারা প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে_ বলছে, ভাই আপনার এমবিএ, বিবিএ ও এমপিএইচ ডিগ্রি লাগবে কি-না, যদি লাগে তাহলে আপনাকে দিচ্ছি সবচেয়ে কমপিটেটিভ প্রাইজে ডিগ্রি, আজই ভর্তি হোন।
এবার আশা যাক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রসঙ্গে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নাম করবে, যখন একটা স্বচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করবে, যা উন্নত বিশ্বে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। বেশিরভাগ বেবিতে এ ধরনের কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না, সে কারণে অযোগ্য শিক্ষার্থীও ভর্তি হচ্ছে। এতে করে শিক্ষকদেরও অনেক বেগ পেতে হচ্ছে এবং তাদের ধারণা, টাকা দিয়ে পড়ছি, সার্টিফিকেট দিতেই হবে। আমরা দেশের সম্পদ তৈরি করতে গিয়ে দেশের বোঝা তৈরি করে যাচ্ছি। বেবির শিক্ষকরা পড়ছেন আরও বেকায়দায়। তাদের বহুজাতিক কোম্পানির এক্সিকিউটিভদের মতো শার্টর্-প্যান্ট-টাই পরতে হচ্ছে, অফিস করতে হচ্ছে ৯-৫টা, অনেক ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবীর মতোই। এ কারণে তারাও মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। প্রতিদিন ক্লাসের চাপ, খাতা দেখা, পরীক্ষার ডিউটি করা_ এত সব কাজের চাপে তারা নিজেরা গবেষণায় মনোযোগী হতে পারছেন না এবং গবেষণা থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। অলাভজনক সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও মালিক পক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে বেবির প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন অভ্যন্তরীণ দলাদলির মধ্যে। নিজেদের ব্যক্তিগত গবেষণা উন্নয়নের দিকে খেয়াল না রেখে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের প্রমোশন ও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত। প্রধান সড়ক যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অনেক গলি, উপগলির সৃষ্টি হয়। বেবির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। শিক্ষকদের কাজের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত উন্নয়নের পথ বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বেবিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক ক্লাস নিতে পারবেন, কোন কোন শিক্ষক পারবেন না তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। যেখানে কর্মের স্বাধীনতা নেই সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা যায় না এবং শিক্ষার্থীরাও চর্চা করতে পারে না।
মোঃ মর্তুজা আহমেদ : লেকচারার
ডিপার্টমেন্ট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট জেকেকেএনআইইউ, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
amm203@gmail.com
দেশে প্রায় ১ হাজার ৭৫০টি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। কিন্তু কলেজগুলো সব জেলা-উপজেলা সদরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে ভর্তি হতে চায় না। দেশে ৩১টি সরকারি এবং ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বুয়েট, সরকারি মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, লেদার টেকনোলজি, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ হাজার আসন রয়েছে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না আসন সংখ্যার সংকটের কারণে।
যেসব শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না তাদের দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (বেবি), কিন্তু বেবির পড়ালেখার ব্যয় এত বেশি যে সবার পক্ষে তা মেটানো সম্ভব হয় না। ৫৪টি বেবিতে মোট আসন সংখ্যা ৫০ হাজার (বাংলাদেশ অর্থনীতিক সমীক্ষা, ২০০৬)। অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন বেবির উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়, সব বেবি ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই জমির অপ্রতুলতার কারণে নিচতলায় কাবাবের দোকান, দ্বিতীয়তলায় ভার্সিটি এবং তৃতীয়তলায় মার্কেট, এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা শহরে সবার চোখে পড়ে। ঢাকার বাইরে যতগুলো বেবি আছে তা আউটার ক্যাম্পাস নামে পরিচিত। সরকার ইতিমধ্যে এগুলো অবৈধ ঘোষণা করেছে। যেখানে ইউজিসি ঢাকার মধ্যে অবস্থিত বেবিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেখানে আউটার ক্যাম্পাসে পড়ালেখার মান কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? ক্রমেই আউটার ক্যাম্পাসগুলো কোচিংসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। মালিক পক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলাদলিতে বিভক্ত হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষার মানও এখন দুই ধরনের। বেবির পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খাতা মূল্যায়ন এবং প্রশ্ন প্রণয়ন সবসময় বহিঃশিক্ষক এবং অভ্যন্তরীণ শিক্ষক দিয়ে করিয়ে থাকে। অন্যদিকে বেবির সবকিছু কোর্স শিক্ষক করেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মেধার পরিচয় সৃজনশীলতার প্রতি নজর না দিয়ে, শিটসর্বস্ব পড়ালেখার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। শিক্ষকই যেহেতু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন করছে এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, ছাত্রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। বেবির ছাত্ররা বেশি সিজিপিএ নিয়ে কর্ম বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু সিজিপিএর মতো যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দ্বৈত মূল্যায়ন, প্রশ্ন প্রণয়নের জাঁতাকলে নামসবর্স্ব ভালো সিজিপিএ পাচ্ছে না। কিন্তু চাকরির বাজারে গিয়ে চরম হোঁচট খাচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনস্বীকার্য। কিন্তু দ্বৈতমান কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই কাঠামোতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়ালেখার স্থান নয়, এটি মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রও, এ ক্ষেত্রে সুপ্রশস্ত ক্যাম্পাস, আধুনিক লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম, মেডিকেল সেন্টার, সুইমিং পুল, স্টেডিয়াম, লেকচার থিয়েটার, ডিজিটাল ল্যাব একান্ত প্রয়োজন। এগুলো শিক্ষার সহায়ক। এগুলোকে বাদ দিয়ে একজন শিক্ষার্থী মননশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারে না। বেবি এ সংক্রান্ত সহায়ক বিষয় বরাবরই অবহেলা করে আসছে। এ কারণে বেবি প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পার হলেও তারা যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই হলো যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সংগঠন, সমাজ তথা দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব দান করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তি দেখাতে পারে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এত সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তাদের নাম নেই, এর বর্ণনা পরে করা যাবে। এখানেই বেবি সাফল্য রাখতে পারবে। বেবি যদি এসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বেবির দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারবে, যা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারেনি।
সংস্টৃ্কতি, খেলাধুলা, ডিবেট এবং মুক্তচিন্তার চর্চার সমন্বয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা যদি বাণিজ্যের উপকরণ হয়, সে জাতির মেরুদণ্ডই ভেঙে যায়। বেবির বিজ্ঞাপনগুলো দেখে মনে হয় উচ্চশিক্ষা এখন পণ্য হয়ে গেছে এবং তারা প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে_ বলছে, ভাই আপনার এমবিএ, বিবিএ ও এমপিএইচ ডিগ্রি লাগবে কি-না, যদি লাগে তাহলে আপনাকে দিচ্ছি সবচেয়ে কমপিটেটিভ প্রাইজে ডিগ্রি, আজই ভর্তি হোন।
এবার আশা যাক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রসঙ্গে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নাম করবে, যখন একটা স্বচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করবে, যা উন্নত বিশ্বে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। বেশিরভাগ বেবিতে এ ধরনের কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না, সে কারণে অযোগ্য শিক্ষার্থীও ভর্তি হচ্ছে। এতে করে শিক্ষকদেরও অনেক বেগ পেতে হচ্ছে এবং তাদের ধারণা, টাকা দিয়ে পড়ছি, সার্টিফিকেট দিতেই হবে। আমরা দেশের সম্পদ তৈরি করতে গিয়ে দেশের বোঝা তৈরি করে যাচ্ছি। বেবির শিক্ষকরা পড়ছেন আরও বেকায়দায়। তাদের বহুজাতিক কোম্পানির এক্সিকিউটিভদের মতো শার্টর্-প্যান্ট-টাই পরতে হচ্ছে, অফিস করতে হচ্ছে ৯-৫টা, অনেক ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবীর মতোই। এ কারণে তারাও মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। প্রতিদিন ক্লাসের চাপ, খাতা দেখা, পরীক্ষার ডিউটি করা_ এত সব কাজের চাপে তারা নিজেরা গবেষণায় মনোযোগী হতে পারছেন না এবং গবেষণা থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। অলাভজনক সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও মালিক পক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে বেবির প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন অভ্যন্তরীণ দলাদলির মধ্যে। নিজেদের ব্যক্তিগত গবেষণা উন্নয়নের দিকে খেয়াল না রেখে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের প্রমোশন ও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত। প্রধান সড়ক যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অনেক গলি, উপগলির সৃষ্টি হয়। বেবির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। শিক্ষকদের কাজের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত উন্নয়নের পথ বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বেবিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক ক্লাস নিতে পারবেন, কোন কোন শিক্ষক পারবেন না তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। যেখানে কর্মের স্বাধীনতা নেই সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা যায় না এবং শিক্ষার্থীরাও চর্চা করতে পারে না।
মোঃ মর্তুজা আহমেদ : লেকচারার
ডিপার্টমেন্ট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট জেকেকেএনআইইউ, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
amm203@gmail.com
No comments