জীবনের অর্ধসত্য রূপ by আতাউর রহমান
ভারতের সাবেক বৈদেশিক ও অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ একটি বই লেখার অপরাধে তার দল জনতা পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন, বিষয়টি আমাদেরকে জগৎ, জীবন, মানুষের বৃত্তি, প্রবৃত্তি সম্পর্কে নতুন করে ভাবায় বৈকি! যশোবন্ত সিংহ কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অথবা সাদামাটা কথায় পর্নোগ্রাফি জাতীয় বই লিখলে না হয় একটা কথা ছিল খুশবন্ত সিংহ বই লেখার ব্যাপারে বেশ খোলামেলা মনোভাব ব্যক্ত করেন।
তার আত্মজৈবনিক লেখা 'লাভ ট্রুথ এন্ড লিটল মেলিস'-এর বিরুদ্ধে মানেকা গান্ধী কোর্টে মামলা ঠুকে দিলেন, ফলে বিচারাধীন অবস্থায় বইটি ৪ বছরের জন্য বাজারের চেহারা দেখেনি। খুশবন্ত সিংহ এই ৪ বছর তো বসে থাকতে পারেন না, কারণ তিনি একজন লেখক। এই অনিচ্ছাকৃত বেকার সময়ের অবকাশে তার নিজের জবানিতে তিনি ২টা পর্নোগ্রাফি লিখে ফেললেন। এ ধরনের এডাল্ট বই লেখা তার কাছে সহজ মনে হয়েছে। একটি বই আমি পড়েছি, শিরোনাম -'কম্পেনি অব উইম্যান'। বইটি আগাগোড়া পর্নো নয়, আধাপর্নো বলা যায়। তবে বইটিতে একটি সামাজিক বক্তব্যও ছিল। বইটি শেষ করে আমার মনে হয়েছিল, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি সুফল বয়ে আনে না, অন্তত এ বিষয়ে পুনরায় সজাগ হয়েছিলাম। লাগাম ছেড়ে দিয়েও পরিশেষে মানুষকে সংযত হয়ে নিজেকে সংহত করতে হয়। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রে বিপদ অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে। আরও ৩টি প্রকাশনা নিয়ে ঝুট-ঝামেলার কথা আমরা জানি। তার মধ্যে প্রধান হলো ডিএইচ লরেন্সের 'লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার'। এই বইটি আমি ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমার বাবার বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা বাংলা অনুবাদ 'লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিকা' চুরি করে পড়ে শেষ করেছিলাম। উনি অফিসে গেলে পড়তাম, অফিস থেকে ফেরার আগেই বালিশের নিচে গুঁজে রেখে দিতাম। তখন বুঝেছিলাম, বইটি সত্যিকার অর্থেই বড়দের বই। পরিণত বয়সে ইংরেজিতে অর্থাৎ লরেন্সের নিজস্ব ভাষায় বইটি পড়ে বিমোহিত হয়েছি। এমন অসাধারণ ইংরেজি গদ্য রচনা আগে পড়েছি বলে আমার মনে হয়নি। মাত্র একটি বাক্যে লেডি চ্যাটার্লির বোন সম্পর্কে লেখক সব বুঝিয়ে দিয়েছেন-'শি ইজ ভেরি প্রভেন্সিয়াল', অর্থাৎ খারাপ বাংলায় আমরা যাকে 'ক্ষ্যাত' বলি। আর বিষয়বস্তুও অনন্য সাধারণ মনে হয়েছে। যৌনতার ভিতর দিয়ে বিংশ শতাব্ধীর প্রত্যূষকালে নপুংশক ব্রিটিশ সমাজকে লরেন্স প্রতীকের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। বইটি বেশ কিছুকাল ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় অশ্লীলতার অপরাধে পরিত্যাজ্য ছিল। এর পরে কোর্ট কেইসে জয়ী হয়ে বইটি পাঠক সমাজে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। লরেন্স বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আজ একটি বিসময়কর নাম। একইভাবে বুদ্ধদেব বসুর 'রাত ভর বৃষ্টি' ও সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি' অশ্লীলতার অপরাধে নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে কোর্টের বিচারে দুটো বই-ই বাজারজাত করার ছাড়পত্র লাভ করে। যশোবন্ত সিংহের বইটি অশ্লীলতার দোষে নিষিদ্ধ হয়নি, রাজনৈতিক কারণে বইটির প্রচার ও প্রসার বিঘ্নিত করা হয়েছে। বইটির শিরোনাম 'জিন্নাহ : ইন্ডিয়া-পার্টিশন-ইন্ডিপেনডেন্স'। বইটির বক্তব্যের সঙ্গে আমি কিছুটা ঐকমত্য পোষণ করি, যদিও যশোবন্তের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বইটির বিষয়বস্তু গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রকৃত অর্থে বইটিতে ধর্মনিরপেক্ষভাবে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্র জীবনী লেখার প্রয়াস নেয়া হয়েছে, যদিও বইটি আমার এখনও পড়া হয়নি। বইটির বিশেষ বক্তব্য সম্পর্কে জানতে পারলাম যে, জিন্নাহ মনে করতেন ভারতীয় উপমহাদেশ হচ্ছে এক বহুজাতিক রাষ্ট্র অর্থাৎ মাল্টিন্যাশনাল ষ্টেট এবং দেশ বিভাগের পরিবর্তে তিনি চেয়েছিলেন, বহু ভাষা ও সংস্কৃতি-সমন্বিত রাজ্যসমূহের একত্রীকরণ। বিজেপি নেতৃবৃন্দ এ ধরনের একটি ধারণা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। কারণ বিজেপি ভারতকে পরিপূর্ণ একটি হিন্দু রাষ্ট্র ভাবতেই অভ্যস্ত। কারণ দেশটি হিন্দু জনসংখ্যা প্রধান একটি দেশ। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত একটি ইতিবাচক ধারণা আছে। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে যে জিন্নাহ্কে আমরা জেনেছি সে জিন্নাহ্ই পরের দিকে অনেক পরিবর্তিত হয়েছিলেন। বিলেতি সাহেবদের চেয়ে বড় সাহেব, পাশ্চাত্য আবহে ও মানসিকতায় বর্ধিত কেতাদুরস্ত একজন মানুষ, যার ধর্মলগ্নতাও শিথিল ছিল, তিনিই পাকিস্তান নামে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জনক হলেন এবং এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সর্বজনমান্য পৌরহিত্যের দায়িত্ব তারই ওপর বর্তাল। তার স্যুট-প্যান্ট, ইংলিশ নটের টাই ও কম্বিনেশান জুতোর জায়গায় তার পোশাকে দখল করল চুড়িদার পায়জামা, শেরওয়ানী ও পশমী জিন্নাহ টুপি। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা পরিবর্তিত জিন্নাহর মুসলিম লীগের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠাটা আমার কাছে ইতিহাসের অদ্ভুত খেলার অভূতপূর্ব প্রহসন বলে মনে হয়। পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ্ সম্পর্কে এসব কথা আমি জেনেছি তার একটি বিশ্বাসযোগ্য জীবনী পড়ে। লেখক আমেরিকান, নাম ওলপার্ট, বইয়ের শিরোনাম 'মুহম্মদ আলী জিন্নাহ অব পাকিস্তান'। প্রথম জীবনের রাজনীতিতে জিন্নাহ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক, উদার মনোভাবসম্পন্ন কংগ্রেসের নেতা, যিনি রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর অগ্রগামী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে যদি ভারত ভাগ না হতো, তাহলে অখন্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার 'হিন্দু-মুসলমান মিলনের দূত' জিন্নাহ হতে পারতেন। রাজনীতির নানা প্যাঁচে খেলাটা উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হলো। ইতিহাসের এটাই প্রহসন। আমরা যা জানি তা বেশিরভাগ সময় অর্ধসত্য। আমার শেষ কথা হলো অখন্ড ভারত বর্ষ ভাগ হয়ে ভালোই হয়েছে। ফলে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলো এবং পরিশেষে আমরা বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে 'বাংলাদেশ' নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করলাম। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিবাচক ভূমিকা হলো- দেশটির সৃষ্টি না হলে 'আমি' 'আমি' হতাম না তথা 'আমরা' 'আমরা' হতাম না। লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments