এই নগরীর দিনরাত্রি by রেজোয়ান সিদ্দিকী
সবকিছু
সুনসান এই নগরীতে এখন সবকিছু সুনসান। যানবাহনের ভিড় নেই, ট্রাকের হর্ন
নেই, জনতার কোলাহল নেই, ট্রাফিক জ্যামের জন্য কারও অভিযোগ নেই। কারণ নগরীতে
যারা ট্রাফিক জট সৃষ্টি করেন তারা সবাই এখন ঢাকার বাইরে। তারা ঈদে কেউ
গেছেন স্বজনের সঙ্গে মিলে ঈদ উদযাপন করতে, কেউ গেছেন কোথাও বেড়াতে।
কক্সবাজার, কুয়াকাটা, জাফলং সর্বত্রই সুনসান পরিবেশ। কুয়াকাটা, কক্সবাজার
কিংবা অন্যসব ট্যুরিষ্ট সপটে ভিড় আর ভিড়। এখন বাংলাদেশে একটা মধ্যবিত্ত
শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, যারা ঈদ, পূজা-পার্বণে বেড়াতে বের হয়। তাদের কোনো
গ্রাম নেই। কোনো স্বজন-পরিবেষ্টিত পরিবেশ নেই। এক-দুই জেনারেশন আগে তারা
পল্লীগ্রামে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন। কোনো একদিন পল্লীতে তাদের ঠিকানা ছিল।
কোনো একদিন তাদের পূর্বপুরুষেরা পল্লীগ্রামে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল,
কোনো একদিন তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তারা দল বেঁধে
পল্লীগ্রামের দিকে ধাবমান হতেন। তাদের পিতা-মাতা গত হয়েছেন। তাদের
চাচা-চাচি গত হয়েছেন। তারা পল্লীগ্রামের স্মৃতি ভুলে গেছেন। এখন তাদের
ফেরার পথ নেই। তাদের গ্রামের ভিটিতে দূর্বাঘাস গজিয়েছে। সে ঘাস কাটার বা
উপড়ানোর কেউ নেই। যদিও বা কখনও এই নাগরিক স্বগ্রামে প্রবিষ্ট হোন, তিনি এসব
ঘাস, আগাছা, পরগাছা উপড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। কখনও কখনও জীবনে
আগাছা-পরগাছাই সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। আগাছা উপড়ালে জীবন উপড়ে যায়। আমাদের
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন কোথাও কোথাও উপড়ে গেছে। এদের না আছে কোনো সামাজিক
ভিত্তি, না আছে পল্লীজীবনে ফিরে যাওয়ার কোনো সূত্র। ফলে ছুটিছাটা পেলে এরা
পল্লীগ্রামের বদলে ট্যুরিষ্ট সপটগুলোতে ভিড় জমায়। ফলে এক সময় যা অকল্পনীয়
ছিল, এখন তা কল্পনার সীমানায় ধরা দিয়েছে। এদের কেউ নেই, কিছু নেই। মানুষের
জীবনবেদ এভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কেউ বাসের ছাদে চড়ে পল্লীগ্রামে আপনজনের
সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য চলে যায়। কারও কোনো আপনজন নেই। সে নিজেই নিজের
আপনার জন। নগরী এক অদ্ভুত বৃত্ত তৈরি করেছে। সে বৃত্তের ভেতরে কাকে, কখন,
কোথায় ঠেলে দেয় কেউ বলতে পারে না। কিন্তু নাগরিক যখন দীর্ঘ ছুটি পায়, তখন
সে নগর বৃত্ত হতে কোথাও না কোথাও বের হতে চায়। কখনও পারে, কখনও বা পারে না।
তবুও সে নগরী পেছনে ফেলে দূরে কোথাও চলে যেতে চায়। সেভাবে সেও নগরীকে
ফাঁকা করে চলে যায়। এটাকে কি আমরা দোষ বলব? কিছুতেই না। সারা পৃথিবীর
নাগরিক মানুষ কর্মক্লান্ত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠে। সে নগরী থেকে সরে যেতে চায়।
বাণিজ্য পসারীরা এটাও টের পেয়েছে। ফলে তাদের উন্মুখ আয়োজন রয়েছে। যদি নগরীর
ক্লান্তি হতে মুক্তি চান তা হলে আমাদের চমৎকার আয়োজন আছে। কম খরচে
স্বর্গীয় তৃপ্তি। নাগরিক মধ্যবিত্ত এরই ধান্ধায় থাকে। কত কম খরচ অথচ কত
বেশি আনন্দ। নগর এভাবে অবিরাম ঘূর্ণায়মান হচ্ছে। নাগরিক যাচ্ছে না
পল্লীগ্রামে, নিজস্ব জীবন হতে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, সন্তান-সন্ততি, নিজস্ব
ইতিহাস ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে। ফলে এক পালক সংস্কৃতির জন্ম
হচ্ছে। এই নতুন সংস্কৃতির মানবেরা ইতিহাস ঐতিহ্যের খবর রাখে না। সে খবর
রাখার প্রয়োজনও তাদের নেই। কারণ তারা কোনোদিন পল্লীগ্রাম দেখেনি। তারা
দেখেনি বেত ফল কীভাবে বেড়ে ওঠে, তারা দেখেনি কীভাবে প্রতিদিন গন্ধরাজ ফোটে।
কারণ তারা দেখেনি কীভাবে একটি ডুমুর টুপ করে পানিতে পড়ে। যদিও বা তা দেখে
থাকে তবুও তারা জানে না এই একটি ডুমুর কীভাবে মাছের শরীরে
অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করেছে। তারা দেখেনি হিজলের ফুল কেন পুকুরের ধারে
ফোটে। তারা জানে না মধ্যরাতে ডাহুক ডেকে কী বলতে চায়। তারা জানে না টাকি
মাছ বড়শিতে গেঁথে জলের ধারে হাত পাতলে কীভাবে বিশাল ষোল মাছ বড়শিতে আটকে
যায়। পত্র-পল্লবহীন লোনা ফল কীভাবে একদিন একদিন করে পেকে ওঠে। এরা কোনো
নাগরিক নয়। এরা নগরীর প্রথম অনুষঙ্গ। এরা এ নগরীর নিকটাত্মীয়ও নয়। এরাও
বসন্তের পর পল্লবহীন বৃক্ষ শাখার সুস্বাদু ফল ছাড়া আর কিছু নয়। এরা আমাদের
ইতিহাস নয়, এরা আমাদের ঐতিহ্যের কথা জানার সুযোগ পায়নি। এরাই বাংলাদেশের
ভবিষ্যৎ নাগরিক হবে। হায়রে নগর, তুমি কেবলই জৌলুস চেন, বিত্ত-বৈভব চেন,
তুমি কি সত্যিই নাগরিক চিনেছো? নিহত নগরী এক আমি এক নগরী বেড়ে উঠতে
দেখেছিলাম। না, সে নগরী হল্যান্ডের স্কেভেনিং জেঙ্গ নয়। আমি হল্যান্ডে
পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রতিদিন দেখেছি ডাচ্রা সমুদ্র দখল করে নগর সম্প্রসারণ
করছে। সম্প্রসারণ করতে করতে আমাকে সমুদ্রের ঢেউ থেকে কেবলই দূরে ঠেলে
দিয়েছে। আমার আর সহ্য হয় না। আমি নগরীর একেবারে প্রান্তে থাকতে চাই। যেখানে
দিনভর সমুদ্রের গর্জন, ঢেউয়ের উত্তাল। যেখানে অবিরাম মাস্তুলের এগিয়ে আসা।
আমি তার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। তারা যত সমুদ্র দখল করে আমি তত সমুদ্রের
কাছে এগিয়ে যাই। কেবলই বাসা বদল করি। নগরী সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু আজ
আমি এক মৃত নগরীর দ্বারপ্রান্তের দাঁড়িয়ে আছি। তার নাম জাফলং। জাফলং কোনো
নগরী নয়। এখানে কেবলই পর্যটকের আনাগোনা। দেখার তেমন কী আছে? আমার বিবেচনায়
কিছু নেই। ডাউকী নদী আছে। যে নদী দু'ভাগ হয়ে খোলামেলা হয়ে গেছে। এ নদীর
তীরে দাঁড়িয়ে ওপার দেখা যায়। ওপারে করিমগঞ্জ। এটা আমাদেরই হওয়ার কথা ছিল।
মহম্মদ আলী জিন্নাহর্ যাডক্লিফের বাউন্ডারির ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্পর্কে
তেমন কোনো মনোযোগ দিতে পারেননি। ফলে করিমগঞ্জ হারিয়েছে পাকিস্তান তথা
বাংলাদেশ। জাফলংয়ে কোনো বসতিও ছিল না। সুনসান এক পল্লীগ্রাম ছিল। ডাউকী পার
হয়ে ওপারে খাশিয়া পল্লী। তারা এখানে প্রধানত পান-সুপারির চাষ করে। সুপারি
গাছে পানের চারা লাগায়। তারপর অদ্ভুত কৌশলে সে পানের চারাগুলোর পরিচর্যা
করে। দোকান দেয়। পাথরের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়। এভাবে দিনমান চলে। পাথর
উত্তোলন এখানে এক বিরাট ব্যবসা। এগুলোও ঘুমন্ত ছিল। নিভৃতে পাথর তুলতো শত
শত শ্রমিক। খুব বেশি শোরগোল ছিল না জাফলংয়ে। যেন নিভৃত পল্লী, কোথায় যে কী
কাজ হচ্ছে কেউ তেমন একটা খোঁজও রাখত না। তারপর জাফলংয়ে কী যে ঘটে গেল এখানে
এক শিল্প বিপ্লবের সূচনা হলো। কথাটা হয়ত বেশিই বলে ফেললাম। কিন্তু নির্মাণ
কাজ যা হলো তাতে বিপ্লব ঘটে গেল জাফলংয়ে। হাজার হাজার বারকি শ্রমিক সমবেত
হলেন জাফলংয়ে। উত্তোলিত পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য বসল শত শত ক্রাশার
মেশিন। নিয়োজিত হলেন আরও হাজার হাজার শ্রমিক। সেভাবে জাফলং ক্রমেই এক শিল্প
নগরীতে পরিণত হতে শুরু করল। জাফলংকে নগরী বলা যায় না। কিন্তু সিলেটের
তামাবিল স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে জাফলং দ্রুত নগরী হয়ে উঠছিল। হাজার হাজার
বারকি শ্রমিকের পাথর উত্তোলন, শত শত ক্রাশার মেশিন, কলরব পর্যটকদের পদধ্বনি
জাফলংকে নগরের মর্যাদা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক যে দেশবিরোধী
সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল তারা দুই বছরের শাসনকালে দুই কোটি লোককে বেকার
করেছিল। জাফলং এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু কিছু বাংলাদেশবিরোধী লোক পরিবেশের
দোহাই দিয়ে বলেছিল, জাফলংয়ের ক্রাশার মেশিনগুলো এলাকায় শব্ধদূষণ করছে। ফলে
বিদেশিদের ক্রীড়নক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই লাখ মানুষকে এক সামান্য ঘোষণায়
বেকার করে দিল। এখন সব কিছু বন্ধ। বন্ধ। দিনভর, রাতভর যে জনপদ সরব ছিল, সে
জনপদ এখন নিথর হয়ে গেছে। পর্যটকের আনাগোনা কমে গেছে। তার কারণ শুধু এই নয়
যে, এখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে। তার কারণ এও যে পর্যটকরা পার্বত্য
চট্টগ্রামসহ যে কোনো সীমান্ত এলাকায় পর্যটনে ভীত। গুলি করে দেবে নাকি
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। ফলে পর্যটকের আনাগোনাও কম। পাথর উত্তোলন নেই।
পাথরের ক্রাশার মেশিন নেই। লাখ শ্রমিকের আনাগোনা নেই। এখন কষ্টের জনপদ হয়ে
উঠেছে জাফলং। সন্ধ্যা নামতেই সুন্দরবনের নিস্তব্ধ নীরবতা। প্রশস্ত রাজপথে
শৃগালের আনাগোনা। হঠাৎ এক-আধটি যানবাহনের ছুটে চলা। তারপর সবকিছু শেষ।
সুনসান জাফলংয়ে সুন্দরবনের নীরবতা। সুন্দরবনে তবু হরিণের ডাক আছে, তার
জ্বলজ্বলে চক্ষু আছে, বাঘের গর্জন আছে, বানরের হঠাৎ কিচিরমিচির আছে;
জাফলংয়ে কিছু নেই। মৃত নগরীর স্তব্ধতা আছে, ঝিঁ ঝি পোকার ডাক আছে, মানুষের
বেদনা ভার আছে, আর কিছু নেই। কিছু নেই। যন্ত্র ও জীবন যন্ত্র ছাড়া জীবন
অচল। যন্ত্র উদ্ভাবনের আগে নগর সভ্যতা সৃষ্টি হয়নি। মহেঞ্জোদারো কিংবা
হরোপ্পা কিংবা নরসিন্দির প্রাচীন নিদর্শন এলাকায় যে সভ্যতার উন্মেষ সেখানে
যন্ত্রই প্রধান। মহেঞ্জোদারোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা কিংবা ব্যাবিলনের
শূন্যযানে জলসিঞ্চন ব্যবস্থা সবকিছু ছিল যন্ত্রনির্ভর। সে যন্ত্র আধুনিক
সভ্যতার মতো কম্পিউটার চিপসের ভেতরে বিশাল দানবের বন্দি থাকার যন্ত্র ছিল
না। সেগুলো এবড়ো-খেবড়ো বিশাল দানবের মতো ছিল। পিরামিড তৈরিতে ওইসব আজদাহা
পাথর ওপরে ওঠাতে কেবল লোকবলই যথেষ্ট ছিল, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তার
পেছনে কোনো না কোনো যন্ত্র কাজ করেছে। তাই সভ্যতার সঙ্গে যন্ত্র
ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু যন্ত্র কি মানুষকে সুখী করে? যন্ত্র অধিকাংশ সময়
কেবলই যন্ত্রণার কারণ ঘটায়। যন্ত্র সভ্যতার প্রতি মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে
ওঠে। ঘুম থেকে উঠে কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে মানুষ যন্ত্রকে অভিসম্পাত দেয়।
যন্ত্রসভ্যতার নির্যাতনে মানুষ এখন অতিষ্ঠ, কিন্তু যন্ত্র ছাড়া জীবন অচল।
যন্ত্রকে গালি দিতে দিতে আমরা বাসে উঠে বসি। যন্ত্রকে গালি দিতে দিতে আমরা
গাড়ির ষ্টিয়ারিং ধরি, যন্ত্রকে গালি দিতে দিতে আমরা টেলিভিশনের রিমোট
কন্ট্রোলের বোতাম চাপি। যন্ত্রকে গালি দিতে দিতে আমরা এসি চালিয়ে দিয়ে
শান্তিতে ঘুমাই। যন্ত্রকে যতই গালি দেই, আধুনিক সভ্যতায় যন্ত্র ছাড়া জীবন
অচল। তবু যন্ত্রের বিরুদ্ধেই নাগরিকদের সব আন্দোলন। পরিবেশ রক্ষার জন্য,
জীবনের উপাদানগুলো সংরক্ষণের জন্য, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এখন
যন্ত্রের বিরুদ্ধেই সব আন্দোলন। কিন্তু সে আন্দোলনও আমরা করি যন্ত্রে
চেপেই। যন্ত্র ছাড়া কিছুই হয় না। কোনো কেষ্টই মেলে না। এ কথা কল্পনাও করা
যায় না যে, যন্ত্রকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবন চালু রাখা সম্ভব। কিন্তু
যন্ত্রের অপব্যবহারের ফলে জীবনের যে ক্ষতি, সে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই
আবারও যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। পানিতে আর্সেনিক দূষণের জন্য যন্ত্র দায়ী।
কিন্তু পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করার জন্য আবারও যন্ত্রেরই প্রয়োজন। কিন্তু
যন্ত্রের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা যন্ত্রকে জীবনের সঙ্গে যাতে খাপ
খাইয়ে নিতে পারি, সেটাই সব থেকে বড় বেশি প্রয়োজন। ফুটনোট ঈদে ঘরমুখী এক
দম্পতি দাঁড়িয়েছিলেন বাসের অপেক্ষায়। বাসে সিট নেই। ভদ্রলোক সত্রীকে বললেন,
'চলো, কী আর করা, ছাদেই যাই।' সত্রী বললেন, কেমন করে? ভদ্রলোক সত্রীর হাত
ধরে ছাদে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, 'আরে ওঠো। ছাদে এসি বাসের মতো ঠান্ডায়
ঠান্ডায় চলে যেতে পারব।'
No comments