তেলের দাম বাড়লে কার লাভ? by জয়তী ঘোষ
আড়াই বছরের মধ্যে এখন তেলের দাম সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। যে তেল এপ্রিলে সরবরাহ করার কথা, তার দাম গত সপ্তাহান্তে ব্যারেলপ্রতি ১০৪ ডলারের ওপরে উঠে গেল নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের পর এটাই সর্বোচ্চ। অন্যদিকে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জে দাম আরও বেশি—ব্যারেলপ্রতি ১১৫ ডলার। এই মুহূর্তে দামের পূর্বাভাস এখনো ঊর্ধ্বমুখী।
বর্তমান মূল্যস্ফুরণের পেছনে সাধারণভাবে চালিকাশক্তি মনে করা হয় মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত লিবিয়া সংকটকে। তবে সারা দুনিয়ার পেট্রোলিয়ামের ৩ শতাংশের কম লিবিয়ায় উৎপাদন করা হয়। আর কোনো ঘাটতি দেখা দিলে তা পূরণের প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্যে দিয়ে রেখেছে সৌদি আরব (দেশটিতে বাড়তি মজুদের পরিমাণ লিবিয়া ও আলজেরিয়ার বার্ষিক উৎপাদনেরও বেশি)।
তেলের মূল্যবৃদ্ধি চালিত হয়েছে অনিশ্চয়তা, গুজব ও ফিউচার বাজারের ফাটকাবাজি কর্মকাণ্ডের দ্বারা। পুরো সমস্যার মাত্র একটি দিক লিবিয়া। আসলে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলেও লিবিয়ার বেশ কিছু তেলক্ষেত্রে এখনো উৎপাদন অব্যাহত আছে। আর্থিক বাজারের উদ্বেগ আসলে শেষ অবধি সৌদি আরবে বিক্ষোভ ছড়ায় কি না, তা নিয়ে। কিন্তু তেমন নাটকীয় কিছু ঘটা এবং তেলের জোগানে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটার বহু আগেই তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে।
তেলের দাম বাড়লে কার ক্ষতি, তা সবারই জানা। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ভুক্তভোগী হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তেলের মূল্য অন্য সব দ্রব্যমূল্যে চলে আসে উৎপাদন ও যানবাহন খরচ বৃদ্ধির আদলে। সরাসরি আক্রান্ত হয় কৃষি। তাই খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে; খাদ্যসংকটের আরও অবনতি ঘটবে। খরচ বাড়ার পরিণতিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ (যেমন—সুদের হার বাড়ানো) নেওয়ার। এতে ব্যবসায়, বিশেষত ক্ষুদ্র ব্যবসায় ব্যয়বৃদ্ধি ঘটে। চলমান সংকটের সময়ে তা দুর্বল বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকেও দুর্বল করে। তাই সারা দুনিয়ার মানুষকে তাদের প্রকৃত আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে।
তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ভেতরে উন্নতদের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত বেশি আক্রান্ত হয়। প্রথমত, উন্নত দেশগুলোতে শিল্পোৎপাদনে যে জ্বালানি লাগে, তার প্রায় দ্বিগুণ জ্বালানি লাগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আর দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকেও বিপত্তিতে পড়তে হয়। তাই তেল আমদানির জন্য অনেক অর্থ খরচ করতে হলে অর্থ পরিশোধের ভারসাম্যে অসংগতি দেখা দেয়। দরিদ্রতম দেশগুলো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অধিকতর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরই চেপে বসে জীবন যাপনের উচ্চব্যয় ও নিম্নমজুরির বোঝা।
তেল আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলো যে বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছিল, এক বছরে তেলের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় তার ইতিবাচক সব প্রভাবই ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব যুক্ত হয়। ২০০৮ সালে শেষবার যখন তেলের দাম চূড়ায় পৌঁছে, তখন তেল ও খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য আইএমএফ যেন ক্ষতিপূরণমূলক অর্থায়ন করে, সেই দাবি তোলা হয়। সেটি বাস্তব রূপ পায়নি। এবার সে রকম কোনো দাবির কথা শোনা যাচ্ছে না অথবা শুনতে পারার মতো জোরালো স্বরে তেমন কোনো দাবি তোলা হচ্ছে না।
কিন্তু তেলের দাম বাড়লে কার লাভ? প্রচলিত দৃষ্টিতে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশগুলোর ওপরই চোখ যায়, মনে করা হয় এরাই সুবিধাভোগী, এমনকি এমনও মনে করা হয় যে তেল আমদানিকারক দেশগুলোর বৈশ্বিক আয় পুনর্বণ্টিত হয়ে চলে যায় তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর হাতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি জোরেশোরে তুলে ধরে গণমাধ্যম। রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরকারের অপ্রত্যাশিত মুনাফার ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে সেই কাজটি করা হয়। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক বাদ যায়। প্রকৃত বড় মাপের সুবিধাভোগী হলো বড় তেল কোম্পানি। এদের ভাগে লাভের বড় অংশটা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বড় তেল কোম্পানিগুলো ধাক্কা খেয়েছিল। ২০১১ সালে পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়ার ওপর ভর করে অত্যন্ত সফলভাবে ফিরে এসেছে এসব কোম্পানি।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বড় তেল কোম্পানিগুলো আগের বছরের তুলনায় আয় দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা দেয়। খরচ ও কর বাদে এক্সনমবিল, শেভরন ও কোনকোফিলিপস নামের তিন মার্কিন কোম্পানি একত্রে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার লাভ করে। ইঙ্গ-ডাচ কোম্পানি রয়াল ডাচ শেল প্রত্যাশিত উৎপাদন না করতে পারলেও আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ আয় করে।
তেলের দাম যখন বেশি কিংবা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন বড় তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফা এত বাড়ল কেন? মূলত কোম্পানির প্রতি ব্যারেল তেলের দামের মধ্যে প্রতিফলিত হয় খনন, অনুসন্ধানের এবং অথবা অশোধিত তেল ক্রয়ের মূল্য। এগুলো বহু আগের দামে। বর্তমান অশোধিত তেলের মূল্যের সঙ্গে সেসব মূল্যের সম্পর্ক অতি সামান্য অথবা কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু বাজারে তেলের দাম বাড়লে তারা নিজেদের পণ্যের দাম খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য নিয়ে যায়। বিপরীতে পরিশোধিত তেলের দাম কমলে তাদের পণ্যের দাম কমানোর ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা যায়। তাই অশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত বিরাট মুনাফা নিয়ে আসে। সুতরাং বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সময়ে ফিউচার বাজারের প্রকৃত লাভবানেরা হলো ফিউচার বাজারের ফাটকাবাজ আর বড় তেল কোম্পানিগুলো। বাজারের উত্তেজনাপূর্ণ ভাবের কারণে এসব কোম্পানি তাদের পণ্য উৎপাদনের খরচের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য ধরে বিপুল মুনাফা তুলে নিতে পারে।
এই অপ্রত্যাশিত মুনাফার ওপর তাৎক্ষণিক ও মোটা অঙ্কের করারোপ খুবই আবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে এমন করারোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে তাঁর প্রশাসন এখনো তা করেনি। এমন করের বিরুদ্ধে সাধারণত যেসব যুক্তি দেখানো হয় তা হলো, কোনো কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফা করলে প্রদত্ত করের হার অনুযায়ী তারা আরও বেশি কর দেয়; তারা ভোক্তাপ্রদেয় মূল্য আরও বাড়িয়ে দেবে (কোম্পানিগুলো নিজস্ব খরচ তুলে আনবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে); আর এই করের ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলোর চেয়ে বেশি লাভবান হবে বিদেশি জোগানদাতারা।
কিন্তু এসব যুক্তিই খণ্ডনীয়। অপ্রত্যাশিত বিপুল মুনাফা হয় আসলে প্রতিযোগিতাবিরোধী কোম্পানি অনুশীলনের ফলে—দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পুনর্নির্ধারণ এবং নিম্নমুখিতার ক্ষেত্রে জড়তা। সুতরাং করারোপই ন্যায্য। কেননা এই উদ্বৃত্তমূল্য কোম্পানির বর্তমান ব্যয়ে কিংবা বিনিয়োগের পরিমাণকে প্রতিফলিত করে না, বরং অন্য নিয়ামকের দ্বারা মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের মুনাফা করার সামর্থ্যকেই প্রকাশ করে।
এভাবে সংগৃহীত কর ভর্তুকি অথবা সরকারি বিনিয়োগে ব্যবহার করা যায়, যা উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষ জ্বালানি ব্যবহার এবং ঘরে ব্যবহারোপযোগী বিকল্প জ্বালানির বিকাশে উৎসাহ জোগাবে। নিয়ন্ত্রণহীন ও জট সৃষ্টিকারী ব্যক্তিগত যানকেন্দ্রিক পরিবহনব্যবস্থার পরিবর্তে জ্বালানি-সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা বিকশিত করতে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।
উন্নত দেশগুলোর সরকার এমন কর থেকে অর্জিত অর্থের একাংশ আজ মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা আক্রান্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষতিপূরণমূলক ও শর্তহীন সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জয়তী ঘোষ: ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।
বর্তমান মূল্যস্ফুরণের পেছনে সাধারণভাবে চালিকাশক্তি মনে করা হয় মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত লিবিয়া সংকটকে। তবে সারা দুনিয়ার পেট্রোলিয়ামের ৩ শতাংশের কম লিবিয়ায় উৎপাদন করা হয়। আর কোনো ঘাটতি দেখা দিলে তা পূরণের প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্যে দিয়ে রেখেছে সৌদি আরব (দেশটিতে বাড়তি মজুদের পরিমাণ লিবিয়া ও আলজেরিয়ার বার্ষিক উৎপাদনেরও বেশি)।
তেলের মূল্যবৃদ্ধি চালিত হয়েছে অনিশ্চয়তা, গুজব ও ফিউচার বাজারের ফাটকাবাজি কর্মকাণ্ডের দ্বারা। পুরো সমস্যার মাত্র একটি দিক লিবিয়া। আসলে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলেও লিবিয়ার বেশ কিছু তেলক্ষেত্রে এখনো উৎপাদন অব্যাহত আছে। আর্থিক বাজারের উদ্বেগ আসলে শেষ অবধি সৌদি আরবে বিক্ষোভ ছড়ায় কি না, তা নিয়ে। কিন্তু তেমন নাটকীয় কিছু ঘটা এবং তেলের জোগানে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটার বহু আগেই তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে।
তেলের দাম বাড়লে কার ক্ষতি, তা সবারই জানা। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ভুক্তভোগী হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তেলের মূল্য অন্য সব দ্রব্যমূল্যে চলে আসে উৎপাদন ও যানবাহন খরচ বৃদ্ধির আদলে। সরাসরি আক্রান্ত হয় কৃষি। তাই খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে; খাদ্যসংকটের আরও অবনতি ঘটবে। খরচ বাড়ার পরিণতিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ (যেমন—সুদের হার বাড়ানো) নেওয়ার। এতে ব্যবসায়, বিশেষত ক্ষুদ্র ব্যবসায় ব্যয়বৃদ্ধি ঘটে। চলমান সংকটের সময়ে তা দুর্বল বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকেও দুর্বল করে। তাই সারা দুনিয়ার মানুষকে তাদের প্রকৃত আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে।
তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ভেতরে উন্নতদের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত বেশি আক্রান্ত হয়। প্রথমত, উন্নত দেশগুলোতে শিল্পোৎপাদনে যে জ্বালানি লাগে, তার প্রায় দ্বিগুণ জ্বালানি লাগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আর দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকেও বিপত্তিতে পড়তে হয়। তাই তেল আমদানির জন্য অনেক অর্থ খরচ করতে হলে অর্থ পরিশোধের ভারসাম্যে অসংগতি দেখা দেয়। দরিদ্রতম দেশগুলো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অধিকতর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরই চেপে বসে জীবন যাপনের উচ্চব্যয় ও নিম্নমজুরির বোঝা।
তেল আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলো যে বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছিল, এক বছরে তেলের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় তার ইতিবাচক সব প্রভাবই ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব যুক্ত হয়। ২০০৮ সালে শেষবার যখন তেলের দাম চূড়ায় পৌঁছে, তখন তেল ও খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য আইএমএফ যেন ক্ষতিপূরণমূলক অর্থায়ন করে, সেই দাবি তোলা হয়। সেটি বাস্তব রূপ পায়নি। এবার সে রকম কোনো দাবির কথা শোনা যাচ্ছে না অথবা শুনতে পারার মতো জোরালো স্বরে তেমন কোনো দাবি তোলা হচ্ছে না।
কিন্তু তেলের দাম বাড়লে কার লাভ? প্রচলিত দৃষ্টিতে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশগুলোর ওপরই চোখ যায়, মনে করা হয় এরাই সুবিধাভোগী, এমনকি এমনও মনে করা হয় যে তেল আমদানিকারক দেশগুলোর বৈশ্বিক আয় পুনর্বণ্টিত হয়ে চলে যায় তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর হাতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি জোরেশোরে তুলে ধরে গণমাধ্যম। রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরকারের অপ্রত্যাশিত মুনাফার ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে সেই কাজটি করা হয়। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক বাদ যায়। প্রকৃত বড় মাপের সুবিধাভোগী হলো বড় তেল কোম্পানি। এদের ভাগে লাভের বড় অংশটা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বড় তেল কোম্পানিগুলো ধাক্কা খেয়েছিল। ২০১১ সালে পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়ার ওপর ভর করে অত্যন্ত সফলভাবে ফিরে এসেছে এসব কোম্পানি।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বড় তেল কোম্পানিগুলো আগের বছরের তুলনায় আয় দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা দেয়। খরচ ও কর বাদে এক্সনমবিল, শেভরন ও কোনকোফিলিপস নামের তিন মার্কিন কোম্পানি একত্রে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার লাভ করে। ইঙ্গ-ডাচ কোম্পানি রয়াল ডাচ শেল প্রত্যাশিত উৎপাদন না করতে পারলেও আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ আয় করে।
তেলের দাম যখন বেশি কিংবা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন বড় তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফা এত বাড়ল কেন? মূলত কোম্পানির প্রতি ব্যারেল তেলের দামের মধ্যে প্রতিফলিত হয় খনন, অনুসন্ধানের এবং অথবা অশোধিত তেল ক্রয়ের মূল্য। এগুলো বহু আগের দামে। বর্তমান অশোধিত তেলের মূল্যের সঙ্গে সেসব মূল্যের সম্পর্ক অতি সামান্য অথবা কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু বাজারে তেলের দাম বাড়লে তারা নিজেদের পণ্যের দাম খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য নিয়ে যায়। বিপরীতে পরিশোধিত তেলের দাম কমলে তাদের পণ্যের দাম কমানোর ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা যায়। তাই অশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত বিরাট মুনাফা নিয়ে আসে। সুতরাং বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সময়ে ফিউচার বাজারের প্রকৃত লাভবানেরা হলো ফিউচার বাজারের ফাটকাবাজ আর বড় তেল কোম্পানিগুলো। বাজারের উত্তেজনাপূর্ণ ভাবের কারণে এসব কোম্পানি তাদের পণ্য উৎপাদনের খরচের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য ধরে বিপুল মুনাফা তুলে নিতে পারে।
এই অপ্রত্যাশিত মুনাফার ওপর তাৎক্ষণিক ও মোটা অঙ্কের করারোপ খুবই আবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে এমন করারোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে তাঁর প্রশাসন এখনো তা করেনি। এমন করের বিরুদ্ধে সাধারণত যেসব যুক্তি দেখানো হয় তা হলো, কোনো কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফা করলে প্রদত্ত করের হার অনুযায়ী তারা আরও বেশি কর দেয়; তারা ভোক্তাপ্রদেয় মূল্য আরও বাড়িয়ে দেবে (কোম্পানিগুলো নিজস্ব খরচ তুলে আনবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে); আর এই করের ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলোর চেয়ে বেশি লাভবান হবে বিদেশি জোগানদাতারা।
কিন্তু এসব যুক্তিই খণ্ডনীয়। অপ্রত্যাশিত বিপুল মুনাফা হয় আসলে প্রতিযোগিতাবিরোধী কোম্পানি অনুশীলনের ফলে—দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পুনর্নির্ধারণ এবং নিম্নমুখিতার ক্ষেত্রে জড়তা। সুতরাং করারোপই ন্যায্য। কেননা এই উদ্বৃত্তমূল্য কোম্পানির বর্তমান ব্যয়ে কিংবা বিনিয়োগের পরিমাণকে প্রতিফলিত করে না, বরং অন্য নিয়ামকের দ্বারা মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের মুনাফা করার সামর্থ্যকেই প্রকাশ করে।
এভাবে সংগৃহীত কর ভর্তুকি অথবা সরকারি বিনিয়োগে ব্যবহার করা যায়, যা উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষ জ্বালানি ব্যবহার এবং ঘরে ব্যবহারোপযোগী বিকল্প জ্বালানির বিকাশে উৎসাহ জোগাবে। নিয়ন্ত্রণহীন ও জট সৃষ্টিকারী ব্যক্তিগত যানকেন্দ্রিক পরিবহনব্যবস্থার পরিবর্তে জ্বালানি-সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা বিকশিত করতে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।
উন্নত দেশগুলোর সরকার এমন কর থেকে অর্জিত অর্থের একাংশ আজ মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা আক্রান্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষতিপূরণমূলক ও শর্তহীন সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জয়তী ঘোষ: ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।
No comments