দূরপাল্লার রুটে ভাড়া নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁকি by রাশেদ মেহেদী

দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা রুটে পরিবহন মালিকদের নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের সুযোগ করে দিচ্ছে খোদ বিআরটিএ! অনুসন্ধানে দেখা যায়, দূরপাল্লার রুটে এখন আর ৫২ আসনের বাস চলে না। দূরপাল্লা এবং আন্তঃজেলা রুটে ৯৮ শতাংশ বাসের আসন সংখ্যা ৪০। বিআরটিএ ৫২ আসন ধরে ভাড়া নির্ধারণ করছে। আর পরিবহন কোম্পানিগুলো ৫২ আসনের ভাড়াকে ৪০ দিয়ে ভাগ করে আনুপাতিক হারে ভাড়া নির্ধারণ করছে। আনুপাতিক হারের গাণিতিক জটিলতায়


প্রত্যেকবার ভাড়া বাড়ার পর শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ যাত্রী। যাত্রীরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কিলোমিটারপ্রতি ৩০ পয়সা অতিরিক্ত ভাড়া দিচ্ছেন। পরিবহন মালিকরা কাগজে-কলমে ১০ শতাংশের জায়গায় ২৫ শতাংশ লাভ আদায় করছেন। বিআরটিএর চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান সমকালকে বলেছেন,
অনেক আগে থেকেই ৫২ আসন হিসাব করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। সেটা এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে। গাড়ির আসন সংখ্যা কম হলে বিআরটিএর অনুমতিসাপেক্ষে আনুপাতিক হারে ভাড়া নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে বগুড়ার দূরত্ব ১৯১ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত পুরনো ভাড়ার হার কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ২০ পয়সা অনুপাতে একজন যাত্রীর ভাড়া দাঁড়ায় ২২৯ টাকা ২০ পয়সা। কিন্তু ঢাকা-বগুড়া রুটে গত সেপ্টেম্বর মাসে আগের দফায় ভাড়া বাড়ানোর পর থেকেই যাত্রীপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। আজ সোমবার থেকে এই ভাড়া আরও বেড়ে ৩৩০ টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। অথচ সরকার নির্ধারিত ১ টাকা ৩৫ পয়সা হিসাবে ভাড়া হয় ২৫৭ টাকা। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং বিআরটিএ বলছে, তারা সঠিক ভাড়াই নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরিবহনের কর্তা-ব্যক্তিরা হিসাব করছেন আনুপাতিক হারে। তারা ২২৯ টাকা ২০ পয়সাকে প্রথমে ৫২ দিয়ে গুণ দিচ্ছেন। তারপর গুণফলকে ভাগ দিচ্ছেন ৪০ দিয়ে। এর পর যে ভাগফল আসছে সেটাই হচ্ছে তাদের নির্ধারিত ভাড়া। এর কারণ, বিআরটিএ যে ভাড়ার হার নির্ধারণ করেছে সেখানে বাসের আসন ধরা হয়েছে ৫২টি। এ কারণে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা ৫২ আসনের জন্য যে ভাড়া তাকে আনুপাতিক হারে ৪০ আসনের ভিত্তিতে ভাগ করে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। এই আনুপাতিক হারের হিসাবের সঙ্গে কখনও কিছু টাকা বেশি যোগ করা হচ্ছে। কখনও কিছু কমও রাখা হচ্ছে। যেমন ১ টাকা ২০ পয়সা হারে ভাড়া হিসাবে ৪০ আসনের বাসে আনুপাতিক হারে যাত্রী ভাড়া দাঁড়ায় ২৯২ টাকা। সেখানে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। আবার ঢাকা থেকে রংপুরে ৩০৮ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ৪০ আসনের আনুপাতিক হারে ভাড়া হয় ৪৭১ টাকা। সেখানে নেওয়া হচ্ছে ৪৫০ টাকা। আসন সংখ্যার তারতম্যের কারণে একেক পরিবহনের বাসে একেক রকম ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। যেমন ঢাকা-বগুড়া রুটে অন্যান্য পরিবহনে ৩০০ টাকা নেওয়া হলেও টিআর ট্রাভেলসে ৩৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।
শুভঙ্করের বড় ফাঁকিটা অন্যখানে। বিআরটিএ প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জ্বালানি খরচ, প্রতি মাসে স্বাভাবিক মেরামত খরচ, পরিবহন কর্মচারীদের বেতন, ট্যাক্স প্রভৃতি বিষয় হিসাবে মোট পরিচালন ব্যয় ধরে তার অনুপাতে যাত্রী ভাড়া নির্ধারণ করে। একটি বাসের সার্বিক পরিচালন ব্যয়ের সঙ্গে ১০ শতাংশ লাভ হিসাব করে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, ১০ শতাংশ লাভ হিসাব করলে নতুন নির্ধারিত ভাড়া ১ টাকা ৩৫ পয়সার ক্ষেত্রে যাত্রীপ্রতি পরিচালন ব্যয় ১ টাকা ২২ পয়সা, আর লাভ ১৩ পয়সা। যদি বিআরটিএ বহু বছর আগের ৫২ আসন না ধরে বর্তমানের ৪০ আসন ধরে হিসাব করত, তাহলেও পরিচালন ব্যয়ের সঙ্গে ১০ শতাংশ মুনাফাই যোগ হতো। কারণ পরিচালন ব্যয় হিসাব করা হয় পুরো একটা বাসের; একেকটা আসন ধরে নয়। অন্যদিকে লাভের হিসাব করা হয় প্রতিটি আসন ধরে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লা সমকালকে বলেন, ৫২ আসনের বাস এখন আর স্ট্যান্ডার্ড নয়। এখন সবাই ৪০ আসনের বাস নামায়। আমরা বিআরটিএর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫২ আসনের জন্য নির্ধারিত ভাড়া ৪০ আসনে আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করে সেটা যাত্রীদের কাছ থেকে নিই।
এদিকে দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা রুটে আজ সোমবার থেকে কার্যকর হচ্ছে বর্ধিত ভাড়ার হার। গতকাল রোববারই মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী টার্মিনালে কিছু কিছু পরিবহন কাউন্টারে সোমবার থেকে বর্ধিত ভাড়ার নোটিশ টানানো হয়।
বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ :জ্বালানি ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ সোমবার নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে বিএনপি। বারবার অতিরিক্ত মূল্যের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে কল্যাণ পার্টি। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

No comments

Powered by Blogger.