মিরপুরে ১৪ একর জমি দখল করে মার্কেট-স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত by হকিকত জাহান হকি ও শরীফুল ইসলাম
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় রাতারাতি সরকারের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার জমি দখলে নিয়ে বিশাল মার্কেট নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ছয়-সাতজনের প্রভাবশালী একটি গ্রুপ শত শত মানুষের বস্তি উচ্ছেদ করে স্বল্প সময়ে বিশাল আকারের মার্কেটটি তৈরি করেন। আগ্রহীদের কাছ থেকে দোকানের অগ্রিম ভাড়ার টাকা তুলে দ্রুত ইট, বালি, রড, সিমেন্ট, টিন জোগাড় করে কাজ শুরু করা হয়। উঁচু স্থানে মার্কেট নির্মাণের পর এর
পাশের জলাশয় বালি দিয়ে ভরাট ও মার্কেট নির্মাণের কাজ চলছে একই সঙ্গে। সরেজমিন দেখা গেছে, মিরপুর ১ নম্বর এলাকার প্রধান সড়ক ও আনসার ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানে গণপূর্ত অধিদফতরের ১৪ একর জায়গা দখল করে মার্কেটটি দুই ভাগে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জায়গাটির বর্তমান বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা। মার্কেটটির মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বেশ চওড়া রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে উত্তর পাশের অংশের উঁচু জমিতে একটি বিশাল আকারের মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, যা গতকাল উদ্বোধন করা হয়। দক্ষিণ পাশের অংশের জলাশয় বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এ অংশে দ্রুত মার্কেট তৈরির কাজ চলছে। অবৈধভাবে জায়গা দখলের অভিযোগে গণপূর্ত বিভাগ মামলা করেছে দারুসসালাম থানায়। জমি দখল ও দখলমুক্ত
করার বিষয়ে সরকার এবং দখলদারদের মধ্যে হাইকোর্টে আইনগত লড়াইও চলছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সাংসদ আসলামুল হক বলেন, অবৈধভাবে সরকারি জমি দখল করে মার্কেট তৈরি করা হয়েছে, যা উচ্ছেদ করা দরকার। গণপূর্ত সচিব খন্দকার শওকত বলেন, এ নিয়ে আইনগত লড়াই চলছে। দখলকারীদের নেতা মিজানুর রহমান খোকন নিজেদেরকে জমির মালিক উল্লেখ করে বলেন, যারা জমির মালিক তারাই ওই মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, দখল প্রক্রিয়ায় মিরপুর থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতারা মূল ভূমিকায় থাকলেও সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির এক নেতাকে। মার্কেটের সামনে টানানো একটি ব্যানারে মিরপুর থানা জাতীয় পার্টির নেতা 'মিজানুর রহমান খোকন গং' লেখা রয়েছে। দখলের সঙ্গে যুক্তরা মার্কেটটি পরিচালনার জন্য 'শক্তি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি' গঠন করেছেন। মার্কেটটির নাম দেওয়া হয়েছে ইউনিটি সুপার মার্কেট।
স্থানীয় লোকজন জানান, আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরপর দু'বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। দু'বারই মিজানুর রহমান গংয়ের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালত থেকে প্রাপ্ত উচ্ছেদের আদেশ স্থগিতের কপি দেখানো হয়। এর মধ্যে প্রথম উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় গত বছর ৮ ডিসেম্বর। এরপর ২৮ ডিসেম্বর আরও একটি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
সূত্র জানায়, ১৫ ডিসেম্বর গণপূর্ত অধিদফতর থেকে দখলদারদের দায়ের করা রিটের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গণপূর্তের পক্ষে রায় দেন। একই সঙ্গে সরকারি জায়গাতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশ দেন। তারা আবারও হাইকোর্টে অন্য একটি বেঞ্চে আবেদন জানালে স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। ফলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে তারা বিশাল জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। মিজানুর রহমান গংয়ের পক্ষের আদেশ বাতিলের দাবি করে এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
থানায় মামলা
অবৈধভাবে সরকারি জমি দখলের অভিযোগে মিরপুরের গণপূর্ত অধিদফতর-৩-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী শরীফ উদ্দিন আহমেদ বাদী হয়ে গত বছর ১০ অক্টোবর মিরপুরের দারুসসালাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন_ মিজানুর রহমান খোকন, খোরশেদ আলম ও আবদুল হাই গং।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক সমকালকে বলেন, সরকারি জায়গা দখল করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি উচ্ছেদে তিনি এরই মধ্যে গণপূর্ত অধিদফতর বরাবর একটি ডিও দিয়েছেন; কিন্তু গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এতদিন এটি উচ্ছেদ করা হয়নি। আর এ সুযোগে তারা স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। সরকারের উচিত দ্রুত স্থগিতাদেশ বাতিল করে মার্কেটটি অপসারণ করা। এ জন্য কোনো সহযোগিতা লাগলে তিনি করবেন বলে জানান।
গণপূর্ত সচিব বলেন, জায়গাটি নিয়ে যেহেতু হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকার ও রিট আবেদনকারীরা জায়গাটি নিয়ে কিছুই করতে পারবেন না যতক্ষন না এটির চূড়ান্ত রায় হয়। এখন তারা যেহেতু এটি ভঙ্গ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আদালতের সম্মতি নিয়েই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মিজানুর রহমান খোকন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার ঘটনাটি সত্য। তবে যারা জায়গার মালিক তারা মামলা করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। 'জায়গা তো সরকারের'_ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারের জায়গা হলে সরকার বুঝে নেয় না কেন? 'মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে মার্কেট নির্মাণ কতটুকু বৈধ'_ এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান।
মিরপুর জাতীয় পার্টির নেতা তহিদুর রহমান এনার কাছে মার্কেটের দোকানের ক্রেতা সেজে এ প্রতিবেদক জানতে চাইলে তিনি বলেন, জায়গা সরকারের ঠিক আছে। তবে এটি তো এতদিন ফাঁকা পড়েছিল। সরকার এখান থেকে কোনো রাজস্ব পেত না। এখন মার্কেট করা হয়েছে। এর থেকে সরকার রাজস্ব পাবে। 'সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া হয়েছে কি-না' এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে।
No comments