কৃষি খাতে ভর্তুকি ও কৃষকদের লাভক্ষতি by ড. তুহিন ওয়াদুদ

বাংলাদেশের কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কোনোকালেই প্রকৃত অর্থে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও কৃষকদের প্রাচীনকাল থেকেই বঞ্চিত থাকতে হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে কৃষকদের জীবন ছিল দারিদ্র্যক্লিষ্ট। ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে উঠতে যাতে কৃষকরা জমির প্রতি অধিক যত্নশীল হয় এবং জমি থেকে ইংরেজ ও কৃষক_উভয়ে লাভবান হয়, সেই লক্ষ্য থেকে পাঁচসনা ভূমি বন্দোবস্ত, পরে দশসনা


ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। সব শেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হয়। এই সুযোগে জমিদাররা ভূমি থেকে ফসল আদায়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে কৃষকদের আরো করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভেতর দিয়ে কৃষকদের শোষিত হওয়ার মাত্রাটা আরো বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি_সব ক্ষেত্রেই নেমে এসেছিল সীমাহীন শোষণ-পীড়ন। সেই শোষণ-পীড়ন থেকে কৃষি খাতও মুক্ত ছিল না। দেশের সব শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ জীবন আমাদের উৎসর্গ করতে হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তান প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ শিক্ষা, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি_সব ক্ষেত্রে পাকিস্তান শাসনামলের চেয়ে, এমনকি বর্তমান পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় হলেও বাংলাদেশের কৃষি খাতে চলছে নীরব দুর্যোগ। এই দুর্যোগ যদি সরব হয়ে ওঠে, সেটা হবে বিভীষিকাময়।
গত একটি বছরে কৃষির প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষককে লোকসান গুনতে হয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গত বছরে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাত্রাটা অনেক বেশি। অন্যান্য বছর হয়তো একটি ফসলে লোকসান হলে আরেকটি দিয়ে তাঁরা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠেন। কিন্তু এ বছরের চিত্রটা ভিন্ন। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধান, গম, পাট, আলু_সব ক্ষেত্রেই কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকার কৃষকের ক্ষতি পূরণের পরিবর্তে কৃষককে ক্ষতির মুখে দিনের পর দিন যেভাবে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব পরিচিতির গায়ে কালি পড়বে। কৃষক যখন আলুর লোকসান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাটের চাষ করছেন, তখন সেখানেও লোকসান। পাটের লোকসান থেকে ক্ষতি পূরণের চেষ্টায় যখন ধানের চাষ করছেন, সেখানেও লোকসান। মূলত কৃষককে কৃষি খাতে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। এই ক্ষতির নেপথ্যে সরকারের ভূমিকাও অনেকখানি। কৃষি খাত থেকে সরকার ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে আবার কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই চেষ্টা থেকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান, চাল, গম, পাটও কিনছে না, তখন কৃষকের পক্ষে ক্ষতির মুখ দেখা ছাড়া আর উপায় থাকে না। কখনো কখনো যে ধান-চাল সরকারি উদ্যোগে কেনা হয়, সেখানে অল্প পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা কৃষকের পক্ষে ফসল দেওয়া সম্ভব হয় না। শুধু তা-ই নয়, সরকারি উদ্যোগে ফসল কেনার ক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক পরিচয়ও গুরুত্বপূর্ণ। এমন নানা জটিলতায় প্রকৃত কৃষকরা সরকারি রেটে ফসল বিক্রি করতে ব্যর্থ হন। ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কারণে সার, কীটনাশক, জ্বালানি কৃষককে কিনতে হয় চড়া দামে। তার ওপর বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে কৃষি খাতে ব্যয়ের মাত্রাটা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে সরকার।
বর্তমানে কৃষি খাতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, যারা কৃষি খাতে এই অস্থিরতা তৈরি করছে, তারা বর্তমান সরকারের শত্রু। কারণ কৃষি খাতে অস্থিরতা তৈরি করতে পারলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যখন বিপন্নতার মুখোমুখি হবে, তখন তারা মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কৃষি খাত নিয়ে বর্তমান সরকারের যে সুনাম ছিল, তা দিনের পর দিন কুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকার যদি অনতিবিলম্বে এই পতন থেকে কৃষির উন্নয়নসাধনে তৎপর না হয়, তাহলে কৃষককে অপেক্ষা করতে হবে অন্য কোনো সময়ের জন্য, অন্য কোনো নেতৃত্বের জন্য। কিন্তু সেই নেতৃত্ব আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান দুই সংগঠনের অন্য সংগঠন হচ্ছে বিএনপি। তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সারের দাবিতে কৃষককে তাজা প্রাণ দিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে গত এক বছরে প্রাকৃতিক কোনো বড় দুর্যোগের কারণে কৃষি বিপন্ন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে এই দুর্যোগ নেমে এসেছে। যেমন_সরকারি নির্দেশনা না থাকার কারণে পরিমাণের বেশি আলুর চাষ করা হচ্ছে। আবার সেই আলু যাতে কম দামে হিমঘরে রাখা যায়, সে ব্যবস্থা সরকার যদি করত, তাহলে কৃষকের বর্তমানে যত ক্ষতি হচ্ছে, ততটা হতো না। গত বছর হিমঘরে আলু রাখার পর আলুর দাম অধিক মাত্রায় পতনের কারণে কৃষকরা আর হিমঘর থেকে আলু ওঠাননি। এ বছর আবার কৃষকরা আলুর চাষ করছেন। কৃষকদের চোখমুখে এক সীমাহীন দুশ্চিন্তার ছায়া। তাঁরা যখন ভূমিতে ফসল ফলান, সেই ফসলের সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁদের স্ত্রী-সন্তানের স্বপ্ন। সেই ফসলের যখন বাম্পার ফলন হয়, তখন তাঁদের পরিবারে নামে কত অভাব পূরণের স্বপ্ন। হয়তো স্কুলগামী সন্তানের বেতন, নতুন পোশাক, স্ত্রীর একটি নতুন শাড়ি, নিজের একটি নতুন লুঙ্গি, নড়বড়ে ঘরের কংক্রিটের সিঁড়ি_কত কিছু! কিন্তু যখন দেখা যায়, হিমঘর থেকে আলু আর বাজারে ওঠে না, যখন দেখা যায় ধান-পাট-গম উৎপাদনের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কম, তখন তাঁদের স্বপ্নের ওপর পড়ে এক কালো হতাশার আবরণ। আমাদের দেশে কৃষকরা কখনো দেশের কোনো ক্ষতি করেননি। বরং আমাদের দেশে এমএ পাস মূর্খরা আমাদের ক্ষতি করেছে। দেশের সবচেয়ে মাটিসংলগ্ন মানুষ হচ্ছেন আমাদের কৃষক। এই কৃষকরা আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাবলম্বী হবে না।
বাংলার জনপদকে বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষকসমাজ। এই কৃষকদের প্রতি কাল-পরম্পরায় অবিচার চলতেই থাকবে_এটা যুক্তিনির্ভর সভ্য সমাজে খুবই অপ্রত্যাশিত। কৃষকের দুর্দিন রোধে আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ হোক। একজন কৃষক যেন মাথা উঁচু করে নিজেকে গর্বিত কৃষক বলে পরিচয় দিতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা আসুক আমাদের জাতীয় পর্যায়ে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর, wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.