নিত্যজাতম্-স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনই একটি ভ্রান্ত ধারণা by মহসীন হাবিব
ইংরেজ শাসনের সময় কোনো কোনো কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে মহা আনন্দ পেতেন। এ দেশের জমিদার-মহাজন-নায়েব-গোমস্তারা অনেক ইংরেজকে প্রলুব্ধ করত ঘুষ নিতে। তাই এক ইংরেজ প্রশাসক ইংল্যান্ডে পাঠানো রিপোর্টে লিখেছিলেন, 'গুস' ইজ এ ভেরি ডিলিশাস ফুড ইন ইন্ডিয়া (ঘুষ অতি সুস্বাদু এক খাদ্য ভারতবর্ষে)। তারও আগে শত শত বছর রাজা-বাদশাহদের শাসনামলেও এই ঘুষ-দুর্নীতির নজির আছে ঢের। বাংলাদেশে এই বহুকালের সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণ বন্ধ
করতে শুধু নাম-পদবি পাল্টানো প্রতিষ্ঠান দিয়েই কি সম্ভব? বাংলাদেশে ঘুষ, অনিয়ম, দুর্নীতির একই প্রবাহ দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত রয়েছে। তাই বলছি, বিশ্বব্যাংকের তখনকার কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিন আই ওয়ালিক এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়া দু-সহ পশ্চিমা বিশ্বের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন পারল কি দুর্নীতি ফেরাতে? কমিশন কি সামান্য ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারল? তাহলে কেন এই কমিশনের জট সৃষ্টি করা! আর এই কমিশনকে কেনই বা স্বাধীন হতে হবে? সরকারকে কি আমরা স্থায়ীভাবে চোরের সাগরেদ ধরে নিয়েছি যে দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণের ভার কোনো সরকারের হাতে থাকতে পারবে না? দেশ যখন দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়, তখন দোষ দেওয়া হয় কাকে? দেশের জনগণ, এমনকি আন্তর্জাতিক মহলও কাকে দায়ী করে? অবশ্যই সরকারের নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো, বর্তমান কমিশন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এর জন্য একফোঁটা অভিযোগের সম্মুখীন হয়নি বা হয় না। কেউ দায় নেননি, এখনো নিচ্ছেন না। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান-কমিশনার-মহাপরিচালক আসেন, ক্ষমতা উপভোগ করেন এবং অবসর নিয়ে বাড়ি চলে যান। কিন্তু রাষ্ট্রের সব দুর্নীতির দায় বহন করতে হয় মুখ্যত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদকেই। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি বলতে আমরা সাধারণভাবে যেসব আচরণকে বুঝি (যেমন_ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ), ওগুলো সুস্পষ্টভাবেই অপরাধ। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ হিসেবে সরকার কোনো অপরাধ দমন বা প্রতিরোধের দায়িত্ব কোনোক্রমেই সরকারি নিয়ন্ত্রণবিযুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বশাসিত কোনো সংস্থার ওপর ছেড়ে দিতে পারে না। 'স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন' যদি দুর্নীতি দূরীকরণের এতই মোক্ষম অস্ত্র হয়, তাহলে সেটা পশ্চিমের দেশগুলো গঠন করে না কেন? পশ্চিমা প্রভাবিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বায়না ধরে যেসব দেশে 'স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন' গঠন করিয়েছে, সেই দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, বতসোয়ানা, জ্যামাইকা, নামিবিয়া, সিয়েরা লিয়ন, কেনিয়া ও মালয়েশিয়া। ইউরোপের মধ্যে এখন পর্যন্ত জর্জিয়া ছাড়া আর কোনো দেশে এই 'স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন' গঠিত হয়নি।
অন্য সমস্যাটিও প্রকট। এই দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনগুলো শুধু অসংগতিপূর্ণই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে দেশের বিভিন্ন অ্যাক্টের সঙ্গে এতটাই সাংঘর্ষিক যে কমিশনের কাজ তাতে চরমভাবে বিঘি্নত হচ্ছে এবং হতে থাকবে। 'স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন' ২০০৪ সালে যে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই আইনে কমিশনকে দণ্ডবিধির মাত্র ১৪টি ধারার অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ১৪টি ধারা হচ্ছে, দণ্ডবিধির ১৬১ থেকে ১৬৯ পর্যন্ত, ২১৭, ২১৮, ৪০৮ ও ৪০৯ ধারা। লক্ষ করুন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের শিডিউলে দণ্ডবিধির ৪২০ (কাগজপত্রসহযোগে প্রতারণা), ৪৬৭ (জালিয়াতি), ৪৭১ (জাল ডকুমেন্ট ব্যবহার) প্রভৃতি ধারা সংযোজিত নয়। ফলে দুদক ওই সব অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না! অথচ সরকারি অফিস-আদালতসহ বেশির ভাগ দুর্নীতিই প্রতারণা আর জালিয়াতির মাধ্যমে হয়ে থাকে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর প্রায় অর্ধেক মামলাই দায়ের করা হতো ৪২০/৪৬৭/৪৭১ ধারায়। অর্থাৎ আইনের দিক দিয়ে ব্যুরোর চেয়েও কমিশন দুর্বল।
আবার দেখুন, ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯(১)(ক) এবং ১৯(১)(গ) ধারায় কমিশনের কর্মকর্তাদের শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, হাস্যকরও বটে। কারণ শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ একটি বিচারিক (জুডিশিয়াল) ক্ষমতা, যা কেবল বিচার বিভাগীয় ও আধা-বিচার বিভাগীয় (কোয়াসি জুডিশিয়াল) প্রতিষ্ঠানের ওপরই অর্পণ করা যায়। সুতরাং একটি তদন্তকারী ও প্রসিকিউটিং এজেন্সিকে শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া জুরিসপ্রুডেন্সের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কমিশন আইনের ১৯(১)(ঘ) ধারায় দুদককে কোনো আদালত বা অফিস থেকে পাবলিক রেকর্ড বা তার অনুলিপি তলবের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইনবিজ্ঞান অনুসারে কোনো আদালতের রেকর্ড তদূর্ধ্ব আদালত (আপিল কোর্ট) ব্যতীত অন্য কেউ তলব করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ কিংবা কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ, এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও কোনো আদালতের রেকর্ড দেখতে চাইলে তাঁকে ওই আদালত বরাবর কারণ বর্ণনা করে আবেদন করতে হবে। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে আদেশ বা অনুমতি প্রদান করলেই কেবল সেই রেকর্ড দেখা যাবে। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের এই ধারাটির বলে দুদকের ডিএডি (পরিদর্শক) পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাও যদি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কোনো রেকর্ড তলব করে বসেন, তাহলে অবস্থা কী হবে! এ কাজটি করেছিলেন ২০০৪ সালের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পরিষ্কার, ওই ধারা সংযোজন করে তাঁরা আদালতের সাংবিধানিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন!
মাইনর অ্যাক্টগুলো যেহেতু সময়ের পরিবর্তন ও যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা হয়, সেহেতু সেগুলো সাধারণত Notwithstanding anything contained in the Criminal Procedure Code or in any other law (ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা অন্য কোনো আইনে যা-ই লেখা থাকুক না কেন) লিখে শুরু করা হয়, যাতে অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কিছু লেখা থাকলেও সর্বশেষ প্রণীত আইনের বিধানটিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু মওদুদ আহমদসহ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কমিশন আইনের শুরুতে কিংবা ভেতরে তেমন কিছুই লেখেননি। ফলে বিভিন্ন আইনের বিভিন্ন বিধানের সঙ্গে দুদক আইনের সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুদক আইন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। যেমন_১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার গ্রাহকের হিসাবের তথ্য প্রকাশ করতে পারে না; এ-সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট সরবরাহ তো দূরের কথা। আবার দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ নম্বর ধারায় যেকোনো অফিস-আদালত থেকে রেকর্ড তলবের ক্ষমতা দুদককে দেওয়া হয়েছে! শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে দুদক কোনো কর্মকর্তার নির্দেশ কেউ লঙ্ঘন করলে তাঁর তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বা অর্থদণ্ডের বা উভয় প্রকার দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তার মানে কী দাঁড়াল, একজন ব্যাংকার কোনটা অনুসরণ করবেন?
দুর্নীতি দমন ব্যুরো নামে যে সরকারি সংস্থাটি ইতিপূর্বে ক্রিয়াশীল ছিল, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের দ্বারা। আর ওই আইনটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সভায় উপস্থাপন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সূত্রে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর জন্মের সঙ্গে জাতির জনকের নামটি জড়িয়ে ছিল। সরকার সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। এটাও কারো অজানা নয় যে সরকারের একটি মহল যেমন দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে ব্যগ্র, তেমনি কমিশনের কমিশনাররাও তাঁদের ক্ষমতা খর্ব হয় কি না, সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু এর আইনকানুনে যে বিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো সংশোধনের ব্যাপারে কোনো পক্ষের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কথায় কথা আসে। আকবরের দরবারে কবিরাজ ফৈজী 'মালিকুশ্ শু'য়ারা' উপাধিতে ভূষিত হয়ে বলেছিলেন, 'আরোজ কি ফৈজে-আম করদান্দ। মারা মালিকুল-কলাম করদান্দ্্ (যিনি আমাকে বাণীর মালিক বানালেন, সেদিন থেকেই তাঁর অনুগ্রহের স্রোত বয়ে যাচ্ছে)।' নিঃসন্দেহে দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি। এ কথাও ঠিক, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিযুক্ত করার বর্তমান পদ্ধতিটি সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু বাস্তবে নিয়োগপ্রাপ্তদের বেলায় কী দেখেছি আমরা? মারা মালিকুল-কলাম করদান্দ্্! উদাহরণ দিই : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত সচিব দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর সময়ই ২০০১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাঁকে কোনো দায় নিতে হয়নি। পরবর্তী সময়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার ফিরে এসে তিনিই হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার! কী দাঁড়াল? কথায় বলে, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়! মোদ্দাকথা, ব্যুরো বা কমিশন নয়, এ প্রতিষ্ঠানে কে নিযুক্ত হচ্ছেন, তিনি দুর্নীতি দমনে কতটা আন্তরিক_সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যে কমিশন দুর্নীতি দমনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে না, তা ব্যর্থ ছাড়া আর কিছু নয়।
পুনশ্চঃ ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী গিতা ভিরজাওয়ান গত ১২ ডিসেম্বর বলেছেন, 'ইন্দোনেশিয়ার মানুষ যদি ভাত কম খায়, তাহলে আমরা চাল রপ্তানিকারক দেশ হতে পারি।' তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো গড়ে প্রতিবছর মাথাপিছু ৭০ কেজি চাল খেয়ে থাকে। সেখানে একজন ইন্দোনেশীয় খায় ১৪০ কেজি। তারা খাবার কমিয়ে দিলে ইন্দোনেশিয়া হবে সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ। 'কী! ভাত কম খাইতে কইছে!' বলে এমন মন্তব্য একবাক্যে উড়িয়ে দেওয়া কিন্তু ঠিক নয়। বাংলাদেশের সরকার খাদ্যে অবিশ্বাস্য ভর্তুকি দিচ্ছে। কথাটা বুঝে নিন।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
অন্য সমস্যাটিও প্রকট। এই দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনগুলো শুধু অসংগতিপূর্ণই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে দেশের বিভিন্ন অ্যাক্টের সঙ্গে এতটাই সাংঘর্ষিক যে কমিশনের কাজ তাতে চরমভাবে বিঘি্নত হচ্ছে এবং হতে থাকবে। 'স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন' ২০০৪ সালে যে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই আইনে কমিশনকে দণ্ডবিধির মাত্র ১৪টি ধারার অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ১৪টি ধারা হচ্ছে, দণ্ডবিধির ১৬১ থেকে ১৬৯ পর্যন্ত, ২১৭, ২১৮, ৪০৮ ও ৪০৯ ধারা। লক্ষ করুন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের শিডিউলে দণ্ডবিধির ৪২০ (কাগজপত্রসহযোগে প্রতারণা), ৪৬৭ (জালিয়াতি), ৪৭১ (জাল ডকুমেন্ট ব্যবহার) প্রভৃতি ধারা সংযোজিত নয়। ফলে দুদক ওই সব অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না! অথচ সরকারি অফিস-আদালতসহ বেশির ভাগ দুর্নীতিই প্রতারণা আর জালিয়াতির মাধ্যমে হয়ে থাকে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর প্রায় অর্ধেক মামলাই দায়ের করা হতো ৪২০/৪৬৭/৪৭১ ধারায়। অর্থাৎ আইনের দিক দিয়ে ব্যুরোর চেয়েও কমিশন দুর্বল।
আবার দেখুন, ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯(১)(ক) এবং ১৯(১)(গ) ধারায় কমিশনের কর্মকর্তাদের শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, হাস্যকরও বটে। কারণ শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ একটি বিচারিক (জুডিশিয়াল) ক্ষমতা, যা কেবল বিচার বিভাগীয় ও আধা-বিচার বিভাগীয় (কোয়াসি জুডিশিয়াল) প্রতিষ্ঠানের ওপরই অর্পণ করা যায়। সুতরাং একটি তদন্তকারী ও প্রসিকিউটিং এজেন্সিকে শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া জুরিসপ্রুডেন্সের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কমিশন আইনের ১৯(১)(ঘ) ধারায় দুদককে কোনো আদালত বা অফিস থেকে পাবলিক রেকর্ড বা তার অনুলিপি তলবের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইনবিজ্ঞান অনুসারে কোনো আদালতের রেকর্ড তদূর্ধ্ব আদালত (আপিল কোর্ট) ব্যতীত অন্য কেউ তলব করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ কিংবা কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ, এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও কোনো আদালতের রেকর্ড দেখতে চাইলে তাঁকে ওই আদালত বরাবর কারণ বর্ণনা করে আবেদন করতে হবে। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে আদেশ বা অনুমতি প্রদান করলেই কেবল সেই রেকর্ড দেখা যাবে। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের এই ধারাটির বলে দুদকের ডিএডি (পরিদর্শক) পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাও যদি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কোনো রেকর্ড তলব করে বসেন, তাহলে অবস্থা কী হবে! এ কাজটি করেছিলেন ২০০৪ সালের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পরিষ্কার, ওই ধারা সংযোজন করে তাঁরা আদালতের সাংবিধানিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন!
মাইনর অ্যাক্টগুলো যেহেতু সময়ের পরিবর্তন ও যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা হয়, সেহেতু সেগুলো সাধারণত Notwithstanding anything contained in the Criminal Procedure Code or in any other law (ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা অন্য কোনো আইনে যা-ই লেখা থাকুক না কেন) লিখে শুরু করা হয়, যাতে অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কিছু লেখা থাকলেও সর্বশেষ প্রণীত আইনের বিধানটিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু মওদুদ আহমদসহ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কমিশন আইনের শুরুতে কিংবা ভেতরে তেমন কিছুই লেখেননি। ফলে বিভিন্ন আইনের বিভিন্ন বিধানের সঙ্গে দুদক আইনের সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুদক আইন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। যেমন_১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার গ্রাহকের হিসাবের তথ্য প্রকাশ করতে পারে না; এ-সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট সরবরাহ তো দূরের কথা। আবার দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ নম্বর ধারায় যেকোনো অফিস-আদালত থেকে রেকর্ড তলবের ক্ষমতা দুদককে দেওয়া হয়েছে! শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে দুদক কোনো কর্মকর্তার নির্দেশ কেউ লঙ্ঘন করলে তাঁর তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বা অর্থদণ্ডের বা উভয় প্রকার দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তার মানে কী দাঁড়াল, একজন ব্যাংকার কোনটা অনুসরণ করবেন?
দুর্নীতি দমন ব্যুরো নামে যে সরকারি সংস্থাটি ইতিপূর্বে ক্রিয়াশীল ছিল, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের দ্বারা। আর ওই আইনটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সভায় উপস্থাপন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সূত্রে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর জন্মের সঙ্গে জাতির জনকের নামটি জড়িয়ে ছিল। সরকার সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। এটাও কারো অজানা নয় যে সরকারের একটি মহল যেমন দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে ব্যগ্র, তেমনি কমিশনের কমিশনাররাও তাঁদের ক্ষমতা খর্ব হয় কি না, সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু এর আইনকানুনে যে বিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো সংশোধনের ব্যাপারে কোনো পক্ষের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কথায় কথা আসে। আকবরের দরবারে কবিরাজ ফৈজী 'মালিকুশ্ শু'য়ারা' উপাধিতে ভূষিত হয়ে বলেছিলেন, 'আরোজ কি ফৈজে-আম করদান্দ। মারা মালিকুল-কলাম করদান্দ্্ (যিনি আমাকে বাণীর মালিক বানালেন, সেদিন থেকেই তাঁর অনুগ্রহের স্রোত বয়ে যাচ্ছে)।' নিঃসন্দেহে দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি। এ কথাও ঠিক, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিযুক্ত করার বর্তমান পদ্ধতিটি সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু বাস্তবে নিয়োগপ্রাপ্তদের বেলায় কী দেখেছি আমরা? মারা মালিকুল-কলাম করদান্দ্্! উদাহরণ দিই : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত সচিব দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর সময়ই ২০০১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাঁকে কোনো দায় নিতে হয়নি। পরবর্তী সময়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার ফিরে এসে তিনিই হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার! কী দাঁড়াল? কথায় বলে, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়! মোদ্দাকথা, ব্যুরো বা কমিশন নয়, এ প্রতিষ্ঠানে কে নিযুক্ত হচ্ছেন, তিনি দুর্নীতি দমনে কতটা আন্তরিক_সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যে কমিশন দুর্নীতি দমনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে না, তা ব্যর্থ ছাড়া আর কিছু নয়।
পুনশ্চঃ ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী গিতা ভিরজাওয়ান গত ১২ ডিসেম্বর বলেছেন, 'ইন্দোনেশিয়ার মানুষ যদি ভাত কম খায়, তাহলে আমরা চাল রপ্তানিকারক দেশ হতে পারি।' তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো গড়ে প্রতিবছর মাথাপিছু ৭০ কেজি চাল খেয়ে থাকে। সেখানে একজন ইন্দোনেশীয় খায় ১৪০ কেজি। তারা খাবার কমিয়ে দিলে ইন্দোনেশিয়া হবে সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ। 'কী! ভাত কম খাইতে কইছে!' বলে এমন মন্তব্য একবাক্যে উড়িয়ে দেওয়া কিন্তু ঠিক নয়। বাংলাদেশের সরকার খাদ্যে অবিশ্বাস্য ভর্তুকি দিচ্ছে। কথাটা বুঝে নিন।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments