ট্রাক থেকে নামিয়ে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ by মহিউদ্দীন জুয়েল
চট্টগ্রামের
বহদ্দারহাটের জরিনা আকতারের ছেলে মোহাম্মদ রুবেল। পেশায় একজন ড্রাইভার। গত
সোমবার রাত থেকে ছেলেকে একনজর দেখার জন্য এই মহিলা ভিড় করেন কোতোয়ালি
থানায়। তার অভিযোগ, ছেলে রুবেল বিএনপি করে না। ঘটনার দিন পুলিশ যখন দলটির
নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে, তখন সে একটি ট্রাকের চালকের আসনে বসাছিল। কিন্তু
পুলিশ তাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে থানায় নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই
মা জরিনার। গতকাল সকালে তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা ও
ভয়। যদি ভাঙচুরের মামলায় তাকে আসামি করা হয় তাহলে মামলা চালাবেন কি করে!
কেবল জরিনা নয়, তার মতো এমন অনেক ভুক্তভোগী ভিড় করেছেন গতকাল সকাল থেকে
সন্ধ্যা পর্যন্ত। যাদের সংখ্যা অন্তত আড়াই শ’। পুলিশ এর আগের দিন কাজীর
দেওড়ি মোড়ে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি
মামলা করেছে। দুটি মামলাই হয়েছে চকবাজার ও কোতোয়ালি থানায়। এসব মামলার
বেশির ভাগ আসামিই অজ্ঞাত। সংখ্যা ৭০০। আটক হওয়া লোকজনের ধারণা, তাদের
পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য এসব অজ্ঞাত মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারেন। কিন্তু
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযোগের কোন সত্যতা না পেলে আটককৃতদের
সবাইকে ছেড়ে দেয়া হবে। কাউকে হয়রানি করা হবে না। গতকাল সকাল ১০টায়
কোতোয়ালি থানার সামনে গিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে দলে দলে ছুটে আসেন
অন্তত ১০০-এর বেশি লোক। সবারই এক অভিযোগ, পুলিশ অন্যায়ভাবে সন্দেহজনক কারণে
তাদের ধরে এনেছে থানায়। গত সোমবার রাত থেকে সবাই থানাহাজতে বন্দি। এ সময়
উৎকণ্ঠায় থাকা লোকজন তাদের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। গাড়িচালক রুবেলের
মা জরিনা আকতার বলেন, আমার ছেলে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। সে গ্রেপ্তার
হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। তার বাবা একজন কাজ করতে অক্ষম লোক। ফলে
রুবেলের পয়সাতেই আমরা কয়েকজন বেঁচে আছি। থানা গেটের সামনে ভেতরে ঢোকার জন্য
এক এসআইয়ের সঙ্গে বাকবিত-ায় জড়িয়ে পড়েন কামাল উদ্দিন। পেশায় একটি শ্রমিক
ফেডারেশনের নেতা। তিনি বলেন, আমি ঘটনার সময় চট্টগ্রামের বাইরে ছিলাম। রাতে
শুনি আমার এলাকার কয়েকজন শ্রমিককে পুলিশ কথা আছে বলে থানায় নিয়ে এসেছে। এরা
হলো আলমগীর, শোয়েব ও টিটু। ছেলেগুলো একদম বাচ্চা। শ্রমিকের কাজ করে।
চিটাগাং শহর ভাল করে চেনে না। অথচ তাদের বানানো হয়েছে বোমা তৈরির কারিগর।
পুলিশ পারে না এমন কিছু নেই। তিনি তাদের নির্দোষ দাবি করে বলেন, কাজীর
দেওড়ির ওই আশপাশের বেশ কিছু ভবনে ঠিকাদারির কাজ চলছে। সেখানে এসব ছেলে
শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে কয়েক দিন ধরে। কিন্তু পুলিশ তার পরও তাদের কেন ধরলো
তা বুঝতে পারলাম না। সর্বশেষ মারামারির ওই ঘটনায় শহরের কোতোয়ালি ও চকবাজার
থানায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। এদের মধ্যে কোতোয়ালি থানায় নগর বিএনপির
সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাৎ হোসেনসহ ৫০০
জনকে!? আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে এসব মামলায় অনেককে ধরতে অভিযান অব্যাহত
রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ওসি মহিউদ্দিন সেলিম মানবজমিনকে
বলেন, পুলিশের কাজ হচ্ছে অপরাধীকে খুঁজে বের করা। আমরা কখনোই কোন নিরাপরাধ
মানুষ শাস্তি পাক তা চাই না। যাদের ধরা হয়েছে এদের অনেকে ঘটনার সঙ্গে
জড়িত। কে অপরাধী, কে নির্দোষ তা প্রমাণিত হবে আদালতে। তবে কাউকে যাতে
হয়রানি করা নয় সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার মতো একই রকম চিত্র
চকবাজারেও। সেখানকার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন মনোয়ারা বেগম।
বলেন, ভাই আমি মানুষের বাসায় বুয়ার কাজ করি। আমার ছেলে কাজীর দেওড়ির এমএ
আজিজ স্টেডিয়ামের একটির রেস্টুরেন্টে কাজ করে। ঘটনার সময় বিএনপি
নেতাকর্মীরা যখন ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল, তখন আমার ছেলেকে সন্দেহ করে
দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এ ব্যাপারে দোকানের মালিকের কোন বক্তব্যই
তারা শোনেননি। শুনেছি ২০০০ টাকা দিলে নাকি ছেড়ে দেবে। পুলিশের পরিচিত
একজনকে খুঁজছি। নগর পুলিশ দাবি করেছে, সোমবার খালেদাকে অবরুদ্ধ করে রাখার
খবরে চট্টগ্রামে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয় বিএনপি-
নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এ সময় অনেকে সেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তাই ক্যামেরা
ফুটেজ থেকে সবাইকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তবে এ কথা সত্যি, যাদের ধরা
হয়েছে তারা সবাই জড়িত নয়। তাই তাদের অবস্থানের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ
সত্যতা যাচাই করছে। চকবাজার থানার ওসি আতিক আহমেদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন,
আমাদের থানায় যে মামলাটি হয়েছে তা বিস্ফোরক আইনে। তবে সেখানে কারও নাম
নেই। সবাই অজ্ঞাত। আমরা জড়িতদের খুঁজে বের করছি। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের
জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আশা করছি নিরাপরাধ ব্যক্তিরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। বাকিদের
গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হবে।
No comments