নামমাত্র শেয়ার ছেড়ে কিছু কোম্পানি নিচ্ছে কর রেয়াত সুবিধা by রাজু আহমেদ
পুঁজিবাজারে নামমাত্র শেয়ার ছেড়ে কর রেয়াত সুবিধা নিচ্ছে কিছু কোম্পানি। কোম্পানির মোট শেয়ারের সিংহভাগ উদ্যোক্তাদের হাতে থাকায় কর্পোরেট করের ৰেত্রে সরকারের দেয়া বিশেষ সুবিধার সুফল পাচ্ছেন না শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা।
উল্টো এসব কোম্পানির হাতেগোনা শেয়ার নিয়ে কারসাজির কারণে মাঝেমধ্যেই অস্থির হয়ে উঠছে পুঁজিবাজার। শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের কর রেয়াতের সুফল পেঁৗছে দিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ৰেত্রে কোম্পানির মোট শেয়ারের নির্দিষ্ট অংশ বাজারে ছাড়া বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেস্নষকরা। সরকারের কর কাঠামো অনুযায়ী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কর্পোরেট করের ৰেত্রে ১০ শতাংশ রেয়াত সুবিধা লাভ করে। বর্তমানে কর্পোরেট কর হার তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ৰেত্রে ৩০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪০ শতাংশ। অবশ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৰেত্রে এ হার ৩৫ ও ৪৫ শতাংশ। কর রেয়াত সুবিধা থাকলেও তা ভোগ করতে বাজারে কী পরিমাণ শেয়ার ছাড়তে হবে_তা সুনির্দিষ্ট না থাকায় নামমাত্র শেয়ার ছেড়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক কোম্পানি। চলতি অর্থবছর থেকে টেলিফোন কোম্পানিগুলোর ৰেত্রে কর রেয়াত পেতে হলে কমপৰে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের বিধান না থাকায় তালিকাভুক্ত হয়েই তারা ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১০২ কোম্পানিই মোট শেয়ারের সামান্য অংশ বাজারে ছেড়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দেশী কোম্পানির মধ্যে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে সবচেয়ে কম শেয়ার রয়েছে আলহাজ টেক্সটাইল লিমিটেডের। এ কোম্পানির মোট শেয়ারের মাত্র ০.০২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। আর পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৯৯.১৬ শতাংশ। বাকি সামান্য কিছু শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে হিমাদ্রী লিমিটেডের ০.০৯ শতাংশ, সোনালি পেপারের ৪.৭৪ শতাংশ, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৯.৬৭ শতাংশ, সোনারগাঁও টেক্সটাইলের ৪.৫৯ শতাংশ, তালস্নু স্পিনিংয়ের ৭.২১ শতাংশ, শ্যামপুর সুগারের ৮.৪২ শতাংশ এবং জেমিনি সি ফুডের ৯.৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ছাড়া হয়েছে। এছাড়া ১০ শতাংশের সামান্য বেশি শেয়ার ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে এমন কোম্পানির সংখ্যাও অনেক। 'জেড' ক্যাটাগরির দুর্বল কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি এ তালিকায় রয়েছে আর্থিক দিক থেকে ভাল অবস্থানে থাকা দেশ গার্মেন্টস, রহিম টেক্সটাইল, মুন্নু ফেব্রিকস, এপেক্স স্পিনিং, এপেক্স ফুটওয়্যার, মিতা টেক্সটাইল, জনতা ইন্সু্যরেন্স, রূপালী ইন্সু্যরেন্স, পূরবী জেনারেল ইন্সু্যরেন্স, আরামিট, এমবি ফার্মাসহ বেশকিছু কোম্পানি।
এদিকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিদেশী কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বল্পসংখ্যক শেয়ার ছেড়েছে। মূলত সরকারের কাছ থেকে কর রেয়াত সুবিধা আদায় করতেই এসব বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে বিশেস্নষকদের অভিমত। বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪ কোটি ৭ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের রেকিট বেনকিজার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ার ছেড়েছে মাত্র ৩.২ শতাংশ। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট শেয়ারের ৭.৫২ শতাংশ। এছাড়া বার্জার পেইন্টসের ৩.২ শতাংশ, গস্নাক্সো স্মিথকোইনের ০.৭৯ শতাংশ এবং রেনেটার ৮.৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।
বাজার বিশেস্নষকদের মতে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণেই সামান্য শেয়ার ছেড়ে কর রেয়াত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। এতে কোম্পানির পরিচালকরা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তার সুফল পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু কোম্পানির পরিচালকরা লভ্যাংশ ঘোষণার আগে বাজার থেকে অধিকাংশ শেয়ার কিনে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে শেয়ার সঙ্কটের কারণে বাজারে দর বেড়ে যাচ্ছে। কোম্পানির লভ্যাংশের পুরোটাই পকেটে পুরে বর্ধিত দরে শেয়ার ছেড়ে দু'দিক থেকে লাভবান হচ্ছেন পরিচালকরা।
হাতেগোনা শেয়ার ছেড়ে কর রেয়াত সুবিধা ভোগ এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরির সুযোগ বন্ধ করতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য নূ্যনতম শেয়ার ছাড়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ৫ নবেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত পুঁজিবাজার সম্পর্কিত এক সভায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য কোম্পানির কমপৰে ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ওই সিদ্ধানত্মের কারণে এসইসিতে প্রক্রিয়াধীন বেশ কয়েকটি আইপিও আটকে গেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পৰ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধানত্মের বিরোধিতা করা হয়েছে। তাদের মতে, পরিশোধিত মূলধনের ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধানত্ম কার্যকর হলে অনেক ভাল কোম্পানির তালিকাভুক্তির সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। ফলে চাহিদার ক্রমাগত বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে দুর্বল কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রকৃত অবস্থা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে পুঁজিবাজারে প্রবেশের সুযোগ নেবে।
পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাটি সময়োচিত নয় বলে এসইসির একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া বাধ্যতামূলক করা হলে ভাল কোম্পানিগুলো নিরম্নৎসাহিত হবে। তবে সামান্য শেয়ার ছেড়ে সুবিধাভোগের প্রবণতা বন্ধে অবশ্যই তালিকাভুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান করা উচিত। শেয়ার ছাড়ার বাধ্যতামূলক হার ৫শ' কোটি টাকার কম পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির জন্য ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং এর বেশি মূলধন হলে ১৫ শতাংশ করা যেতে পারে।
বাজার বিশেস্নষকরা মনে করেন, ভাল শেয়ারের যোগান বাড়াতে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সম কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সক্রিয় বিদেশী কোম্পানিগুলোকেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে একদিকে যেমন পুঁজিবাজার শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরাও ভাল শেয়ারে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন। শুধু কর রেয়াতের সুযোগ নিতে নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার প্রবণতা বন্ধ করতে কোম্পানির নির্দিষ্ট অংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার পদৰেপ নিতে হবে। তবে এ বাধ্যবাধকতা যাতে সহনীয় হয়_সেদিক বিবেচনায় রেখেই চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম নেয়া উচিত।
No comments