টিপাইমুখ বাঁধ : সমাধান আছে ট্রানজিটে by সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন
ফারাক্কার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো ওজর-আপত্তিতে কান না দিয়ে ভারত বরাক নদে বাঁধ নির্মাণ করবেই। সেই লক্ষ্যে টিপাইমুখে 'বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প' বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার গত ২২ অক্টোবর মণিপুর রাজ্য সরকার ও একটি সংস্থার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং বরাক নদের পানিপ্রবাহকে বাংলাদেশের দিক থেকে ফিরিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ধরে রাখবে।
বরাক একটি অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদ। লুসাই পর্বত থেকে সৃষ্ট এ নদ ভারতের আসাম, মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্যে বরাক নামে এবং বাংলাদেশের সিলেটে সুরমা-কুশিয়ারা ও ভৈরববাজার, আশুগঞ্জ, চাঁদপুরে মেঘনা নামে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। অভিন্ন নদী বিষয়ে জাতিসংঘ নীতিমালা (১৯৯৭) ও হেলসিংকি নীতিমালায় (১৯৬৬) বলা আছে, 'প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পার্শ্ববর্তী একই অববাহিকার অন্যান্য দেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আন্তর্জাতিক এসব নীতিমালাকে অবজ্ঞা করে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয় এমন বাঁধই ভারত নির্মাণ করছে টিপাইমুখে। ডাবি্লউডির উচ্চতার ড্যাম বা বাঁধ কোনো আন্তর্জাতিক নদীতে নির্মিত হলে তা বড় ড্যাম হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং এ ধরনের ড্যাম কোনো নদীতে তৈরি করতে চাইলে সেই নদী অববাহিকার মানুষের কাছে ড্যামের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ভারত এসবের কিছুই না করে বাংলাদেশের সঙ্গে রীতিমতো লুকোচুরি খেলে বরাক নদের বুকে ১৬২ দশমিক আট মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করছে। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পরীক্ষামূলক চালুর সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে ধরনের লুকোচুরি করেছে, এখনো তাই করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এসে গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বলেন, 'বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন বাঁধ ভারত নির্মাণ করবে না।' অথচ এই বিবৃতির ১৯ মাস আগেই টিপাইমুখে বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়। সেই হিসেবে বলা যায়, মনমোহন বাংলাদেশের জনগণকে প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ডে দাঁড়িয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেছেন এবং এখনো দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের জনগণকে যত আশ্বাসই দিক না কেন, মেঘনা অববাহিকার মানুষ রাজশাহীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তলদেশের বালুরাশি দেখে ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে, কী ভয়াবহ বিপর্যয়ই না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ফারাক্কার কারণে যেমন রাজশাহী থেকে পদ্মা হারিয়ে গেছে, টিপাইমুখের কারণে বৃহত্তর সিলেট থেকে তেমনি হারিয়ে যাবে সুরমা-কুশিয়ারা। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওর হয়ে যাবে মরুভূমি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের যে বন্দরটি ব্যবহার করে ভারত পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল ত্রিপুরায় নিয়েছে, সে আশুগঞ্জ বন্দরটির মৃত্যু ঘটবে। ভৈরব রেলওয়ে ও সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে মেঘনার ধারা প্রবাহিত না হয়ে জেগে উঠবে বালুচর। বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ জনগণ ও এলাকা হয়ে উঠবে মরুময়।
১৬২ মিটার উঁচু টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে যে ৫০০ ফুট গভীর জলাধারটি তৈরি হবে, তার পানি ধারণ ক্ষমতা ১৫ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার, টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে এই পরিমাণ পানিকে শাসন করা হবে। বাঁধের নির্মাণ ত্রুটি, কারিগরি জটিলতা, প্রবল বৃষ্টিপাত ইত্যাদি কারণে শাসনে বন্দি থাকা বিপুল জলরাশি যেকোনো সময় নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে। পানি তার চাপ কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে অববাহিকায় ভাটির দিকে প্রবল বন্যা কিংবা আট মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। বলা বাহুল্য, বন্যা ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের মেঘনা অববাহিকা অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রেহাই পাবে না খোদ ভারতেরই তিন রাজ্য আসাম, মণিপুর ও মিজোরাম। বাঁধ নির্মাণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ইতিমধ্যে ফুঁসে উঠেছে বরাক ও সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার মানুষ। বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে মণিপুরে যেমন বিক্ষোভ হয়েছে, তেমনি সিলেটে হয়েছে হরতাল। বিরোধীদলীয় নেত্রী চিঠি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে এবং চিঠির উত্তর পাওয়ার পর টিপাইমুখ বিষয়ে দিয়েছেন কঠোর বিবৃতি। এরশাদ টিপাইমুখ অভিমুখে করেছেন রোডমার্চ।
কিন্তু 'টিপাইমুখ বাঁধ' নির্মাণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের যতটা সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল_তার কিছুই দেখা যায়নি। সরকারের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা দিলি্ল ঘুরে এসে বিবৃতি দিলেন, 'টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করতে পারে।' পানিসম্পদমন্ত্রী বিবৃতি দিলেন, 'আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হবে।' কিন্তু এ পর্যন্তই। সরকার আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কঠোর বিবৃতি দিতে পারেনি কিংবা উদ্যোগ নিতে পারেনি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার।
ভারত তার প্রভুসুলভ আচরণের কারণে এবং বাংলাদেশ সরকারের নিস্পৃহতায় নির্দিষ্ট সময়েই বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করবে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই বড় ধরনের স্থাপনা তৈরির মতো নির্মাণসামগ্রী বাংলাদেশের আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ভারতের সাত বোন রাজ্যে নেওয়া হবে; যেভাবে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল। ভারত ভালো করেই জানে, টিপাইমুখ বাঁধ হলে ভৈরব ব্রিজের নিচে আশুগঞ্জ বন্দরে পানি থাকবে না। তাই দেশটি এখন প্রকাশ্যেই তোড়জোড় করছে আগামী মার্চ থেকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের স্থায়ী ট্রানজিট পেতে।
বাংলাদেশ এই জায়গাটিতে তার প্রভাব খাটাতে পারে। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে পারে, আশুগঞ্জ নৌবন্দর রক্ষার জন্যই ভারতের উচিত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা। আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার ছাড়া ভারতের সাত বোন রাজ্যে অন্য কোনো পন্থায় পণ্য পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আশুগঞ্জ নৌবন্দর হয়ে যত দ্রুত ত্রিপুরা গিয়ে পেঁৗছেছে, সেভাবে আর কোনো মালামাল নিতে না দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবাদ করতে পারে।
বাংলাদেশ ভারতকে রেল ট্রানজিট দিলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতীয় পণ্য রেলযোগে আখাউড়া হয়ে আগরতলা চলে যাবে। সে ক্ষেত্রে আখাউড়া-আগরতলা ১৫ কিলোমিটার রেলপথ নতুন তৈরি করতে হবে। এ জন্য অবশ্য ভারত বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের উচিত হবে এই ঋণ সহায়তা প্রত্যাহার করা এবং আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণ না করা। এই রেলপথ নির্মাণ না করলে ভারত তার সাত বোন রাজ্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে আশুগঞ্জ নৌবন্দর তথা মেঘনা নদীকে সচল রাখতে বাধ্য হবে।
রেল ট্রানজিটের পাশাপাশি সড়ক ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য প্রবেশ করে তামাবিল কিংবা আখাউড়া হয়ে সেভেন সিস্টার্সে যেতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে আরেকটি প্রতিবাদ।
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে শতভাগ এবং বাংলাদেশ থেকে দেড় শ ভাগ পিছিয়ে থাকা সাত বোন রাজ্যের অস্তিত্বের প্রশ্নেই বাংলাদেশকে ভারতের বড় প্রয়োজন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধে আমাদের উচিত এই সুযোগটিই কাজে লাগানো। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য প্রেরণে যেহেতু বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার ছাড়া দিলি্লর কোনো উপায় নেই, সেহেতু তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের বিষয়টি চেপে গিয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয় সামনে আনতে হবে। ভারত যদি ট্রান্সশিপমেন্টের সুযোগ পায় এবং ট্রানজিট না পায় তাহলে তার সাত বোন রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের নদী তথা মেঘনা নদীকে টিকিয়ে রাখবে। আর যদি এখনই ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আশুগঞ্জ বন্দর মরে গেলে, বিশাল ভাটি অঞ্চল মরুভূমি হয়ে গেলে কিংবা ভূমিকম্পপ্রবণ এ অঞ্চলে আরো ঘন ঘন ভূমিকম্প আঘাত হানলেও ভারতের কিছুই যাবে-আসবে না।
এ জন্য ট্রানজিট দেওয়া বন্ধের পাশাপাশি জাতি হিসেবে আমাদের জোর প্রতিবাদ জানাতে হবে। প্রকৃতি ও জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। মণিপুরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মেঘনা অববাহিকা তথা বাংলাদেশের জনগণ যদি বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ভারত সরকার পিছু হটতে পারে। মরণঘাতি এই বাঁধ বন্ধে এর চেয়ে ভালো বিকল্প বাংলাদেশের হাতে নেই।
লেখক : সাংবাদিক
আন্তর্জাতিক এসব নীতিমালাকে অবজ্ঞা করে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয় এমন বাঁধই ভারত নির্মাণ করছে টিপাইমুখে। ডাবি্লউডির উচ্চতার ড্যাম বা বাঁধ কোনো আন্তর্জাতিক নদীতে নির্মিত হলে তা বড় ড্যাম হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং এ ধরনের ড্যাম কোনো নদীতে তৈরি করতে চাইলে সেই নদী অববাহিকার মানুষের কাছে ড্যামের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ভারত এসবের কিছুই না করে বাংলাদেশের সঙ্গে রীতিমতো লুকোচুরি খেলে বরাক নদের বুকে ১৬২ দশমিক আট মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করছে। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পরীক্ষামূলক চালুর সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে ধরনের লুকোচুরি করেছে, এখনো তাই করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এসে গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বলেন, 'বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন বাঁধ ভারত নির্মাণ করবে না।' অথচ এই বিবৃতির ১৯ মাস আগেই টিপাইমুখে বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়। সেই হিসেবে বলা যায়, মনমোহন বাংলাদেশের জনগণকে প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ডে দাঁড়িয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেছেন এবং এখনো দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের জনগণকে যত আশ্বাসই দিক না কেন, মেঘনা অববাহিকার মানুষ রাজশাহীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তলদেশের বালুরাশি দেখে ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে, কী ভয়াবহ বিপর্যয়ই না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ফারাক্কার কারণে যেমন রাজশাহী থেকে পদ্মা হারিয়ে গেছে, টিপাইমুখের কারণে বৃহত্তর সিলেট থেকে তেমনি হারিয়ে যাবে সুরমা-কুশিয়ারা। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওর হয়ে যাবে মরুভূমি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের যে বন্দরটি ব্যবহার করে ভারত পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল ত্রিপুরায় নিয়েছে, সে আশুগঞ্জ বন্দরটির মৃত্যু ঘটবে। ভৈরব রেলওয়ে ও সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে মেঘনার ধারা প্রবাহিত না হয়ে জেগে উঠবে বালুচর। বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ জনগণ ও এলাকা হয়ে উঠবে মরুময়।
১৬২ মিটার উঁচু টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে যে ৫০০ ফুট গভীর জলাধারটি তৈরি হবে, তার পানি ধারণ ক্ষমতা ১৫ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার, টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে এই পরিমাণ পানিকে শাসন করা হবে। বাঁধের নির্মাণ ত্রুটি, কারিগরি জটিলতা, প্রবল বৃষ্টিপাত ইত্যাদি কারণে শাসনে বন্দি থাকা বিপুল জলরাশি যেকোনো সময় নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে। পানি তার চাপ কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে অববাহিকায় ভাটির দিকে প্রবল বন্যা কিংবা আট মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। বলা বাহুল্য, বন্যা ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের মেঘনা অববাহিকা অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রেহাই পাবে না খোদ ভারতেরই তিন রাজ্য আসাম, মণিপুর ও মিজোরাম। বাঁধ নির্মাণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ইতিমধ্যে ফুঁসে উঠেছে বরাক ও সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার মানুষ। বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে মণিপুরে যেমন বিক্ষোভ হয়েছে, তেমনি সিলেটে হয়েছে হরতাল। বিরোধীদলীয় নেত্রী চিঠি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে এবং চিঠির উত্তর পাওয়ার পর টিপাইমুখ বিষয়ে দিয়েছেন কঠোর বিবৃতি। এরশাদ টিপাইমুখ অভিমুখে করেছেন রোডমার্চ।
কিন্তু 'টিপাইমুখ বাঁধ' নির্মাণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের যতটা সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল_তার কিছুই দেখা যায়নি। সরকারের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা দিলি্ল ঘুরে এসে বিবৃতি দিলেন, 'টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করতে পারে।' পানিসম্পদমন্ত্রী বিবৃতি দিলেন, 'আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হবে।' কিন্তু এ পর্যন্তই। সরকার আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কঠোর বিবৃতি দিতে পারেনি কিংবা উদ্যোগ নিতে পারেনি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার।
ভারত তার প্রভুসুলভ আচরণের কারণে এবং বাংলাদেশ সরকারের নিস্পৃহতায় নির্দিষ্ট সময়েই বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করবে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই বড় ধরনের স্থাপনা তৈরির মতো নির্মাণসামগ্রী বাংলাদেশের আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ভারতের সাত বোন রাজ্যে নেওয়া হবে; যেভাবে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল। ভারত ভালো করেই জানে, টিপাইমুখ বাঁধ হলে ভৈরব ব্রিজের নিচে আশুগঞ্জ বন্দরে পানি থাকবে না। তাই দেশটি এখন প্রকাশ্যেই তোড়জোড় করছে আগামী মার্চ থেকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের স্থায়ী ট্রানজিট পেতে।
বাংলাদেশ এই জায়গাটিতে তার প্রভাব খাটাতে পারে। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে পারে, আশুগঞ্জ নৌবন্দর রক্ষার জন্যই ভারতের উচিত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা। আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার ছাড়া ভারতের সাত বোন রাজ্যে অন্য কোনো পন্থায় পণ্য পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আশুগঞ্জ নৌবন্দর হয়ে যত দ্রুত ত্রিপুরা গিয়ে পেঁৗছেছে, সেভাবে আর কোনো মালামাল নিতে না দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবাদ করতে পারে।
বাংলাদেশ ভারতকে রেল ট্রানজিট দিলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতীয় পণ্য রেলযোগে আখাউড়া হয়ে আগরতলা চলে যাবে। সে ক্ষেত্রে আখাউড়া-আগরতলা ১৫ কিলোমিটার রেলপথ নতুন তৈরি করতে হবে। এ জন্য অবশ্য ভারত বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের উচিত হবে এই ঋণ সহায়তা প্রত্যাহার করা এবং আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণ না করা। এই রেলপথ নির্মাণ না করলে ভারত তার সাত বোন রাজ্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে আশুগঞ্জ নৌবন্দর তথা মেঘনা নদীকে সচল রাখতে বাধ্য হবে।
রেল ট্রানজিটের পাশাপাশি সড়ক ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য প্রবেশ করে তামাবিল কিংবা আখাউড়া হয়ে সেভেন সিস্টার্সে যেতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে আরেকটি প্রতিবাদ।
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে শতভাগ এবং বাংলাদেশ থেকে দেড় শ ভাগ পিছিয়ে থাকা সাত বোন রাজ্যের অস্তিত্বের প্রশ্নেই বাংলাদেশকে ভারতের বড় প্রয়োজন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধে আমাদের উচিত এই সুযোগটিই কাজে লাগানো। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য প্রেরণে যেহেতু বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার ছাড়া দিলি্লর কোনো উপায় নেই, সেহেতু তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের বিষয়টি চেপে গিয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয় সামনে আনতে হবে। ভারত যদি ট্রান্সশিপমেন্টের সুযোগ পায় এবং ট্রানজিট না পায় তাহলে তার সাত বোন রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের নদী তথা মেঘনা নদীকে টিকিয়ে রাখবে। আর যদি এখনই ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আশুগঞ্জ বন্দর মরে গেলে, বিশাল ভাটি অঞ্চল মরুভূমি হয়ে গেলে কিংবা ভূমিকম্পপ্রবণ এ অঞ্চলে আরো ঘন ঘন ভূমিকম্প আঘাত হানলেও ভারতের কিছুই যাবে-আসবে না।
এ জন্য ট্রানজিট দেওয়া বন্ধের পাশাপাশি জাতি হিসেবে আমাদের জোর প্রতিবাদ জানাতে হবে। প্রকৃতি ও জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। মণিপুরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মেঘনা অববাহিকা তথা বাংলাদেশের জনগণ যদি বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ভারত সরকার পিছু হটতে পারে। মরণঘাতি এই বাঁধ বন্ধে এর চেয়ে ভালো বিকল্প বাংলাদেশের হাতে নেই।
লেখক : সাংবাদিক
No comments