বাস ভাড়া-জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার

গ্রাম সমাজে একটি প্রবাদ বেশ প্রচলিত_ 'খাওয়ার আগে, আর মারের শেষে।' এ প্রবাদ অনুসারে, কোনো দাওয়াতে গিয়ে ভালো খাবার ও সেবা পেতে হলে আগে বসতে হয়। আর ঝামেলা এড়াতে মারধরের শেষে থাকতে হয়। তাতে ঢিল ও পাটকেল কোনোটাই আঘাত করতে পারে না। এ প্রবাদটির কথা অনেকের বিশেষভাবে মনে পড়তে পারে দেশের বাজার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে। বিশেষত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ২০১১ সালে বিশেষ


আলোচিত বিষয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে দু'বার করে মোট চারবার তেলের মূল্যবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা সইতে হয়েছে নাগরিকদের। বেড়েছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজির মূল্যও। অনেকেই মনে করেন, মূল্যস্ফীতির প্রাবল্যের মধ্যে এভাবে পরপর তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্তও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সর্বত্র পড়ে। বাস ভাড়া থেকে শুরু করে সবজির দাম_ কোনো কিছুকেই রেহাই দেয় না। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অতীতে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারও ঘটছে না। ফলে ২০১২ সালে বছর শুরু হলো দূরপাল্লার বাস ভাড়ার দুঃসংবাদ দিয়ে। তবে আশার কথা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে ভাড়া বাড়েনি। আগের মতো তেলের দাম বাড়ার রাতেই বাড়তি ভাড়া আদায়ের তোড়জোড় শুরু হয়নি, এতটুকুই স্বস্তি। তবে এই সামান্য স্বস্তির বাইরে আছে বিপুল অস্বস্তির খবর। দূরপাল্লার বাস ভাড়া বাড়লে ভ্রমণ খরচ বাড়বে। ডিজেলচালিত অন্য যানগুলোর ব্যয়বৃদ্ধি পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়াবে। বাজারে এর প্রভাব পড়বেই। নৌযানগুলোর ভাড়া বৃদ্ধির খবরও হয়তো সহসাই মিলবে। বলাবাহুল্য, ব্যয় বৃদ্ধির দায়ভার পুরোটাই বহন করতে হবে সাধারণ নাগরিকদের। পৃথিবীর উন্নত দেশ তো বটেই, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কিছুটা ভার ব্যবসায়ীদের বহন করতে হয়। তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া যখন সরকারের কোনো উপায় থাকে না, তখন মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়তি ব্যয়ের একটি অংশ ব্যবসায়ীদের, একটি অংশ সাধারণ মানুষের ওপর বর্তায়। এতে ব্যবসায়ীদের লাভ কমে, কিন্তু সহসা ক্রেতাদের ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে না। বাজার সহনীয় রাখার জন্য এর বিকল্পও নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এমন উদাহরণ দুর্লভ। লাভ কমানো দূরের কথা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি বাস ভাড়া আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট, ব্যবসায়ীরা ছাড় দিতে নারাজ। শুধু নারাজ নন, এ সুযোগকে কাজে লাগাতেই তৎপর। আর সরকারও মূল্য বাড়ানোর পর ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পুরো দায় সাধারণ মানুষকেই নিতে হয়। যে কোনো উপলক্ষ কাজে লাগিয়ে মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা বাজারকে সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল করে তুলছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, একটি পণ্যের দাম বাড়ার পর কখনোই না কমার নজির বোধকরি বাংলাদেশের বাজার ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, কখনও কখনও কমেও। বাড়লে যতটা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি করে ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে স্থানীয় বাজারে যে দাম কমানো যায় এমন নজির খুবই দুর্লভ। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকা উচিত। ব্যবসায়ীরা যাতে যেনতেন উপায়ে দাম বাড়াতে না পারে, সে জন্য সরকারের নির্দেশনা থাকা উচিত। বাস ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আলোচনার মাধ্যমে হচ্ছে, সেটি ইতিবাচক। কিন্তু এই আলোচনায় যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। পাশাপাশি, বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কিছুটা দায় ব্যবসায়ীদেরও নেওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.