ঢাকার ঘরবাড়ি: ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্রে’র সঙ্গে বসবাস by ফারুক ওয়াসিফ
চিলির ভূমিকম্পের পর আমার এক গায়ক বন্ধু তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখে রেখেছিলেন, ‘যখন ঢাকা শহর ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে যাবে, তখন আমি বাঁশিতে কোন সুর বাজাব?’ রোম যখন পুড়ছিল, তখন রোমের সম্রাট নিরো বাঁশিই বাজাচ্ছিলেন। নিরোর মতো শাসকের অভাব বাংলাদেশে কখনো হয়নি। কতবার কতজন কতভাবে বলেছেন যে ঢাকা ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে; কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সরকারগুলো মসনদে বসে বহু সুরের রাজনৈতিক বাঁশি বাজিয়েছে, কিন্তু সোয়া থেকে দেড় কোটি অধিবাসীর এ শহরটিতে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তেমন কিছুই করেনি।
এ শহরে এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যাঁরা ঘুমাতে যান ভূমিকম্পের ভয় নিয়ে, কিংবা ঘুমের মধ্যে আচমকা জেগে উঠে ভীতভাবে বুঝতে চান, বিছানাটা কি নড়ে উঠল? কোনো না কোনো দেশে নতুন ভূমিকম্প হলেই এ ধরনের আতঙ্কে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ক্যারিবিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্স সাত মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। ভবনচাপা পড়ে মারা যায় প্রায় তিন লাখ মানুষ। সে সময় প্রথম আলোর পাতাতেই লিখেছিলাম, ‘যে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতির রাজধানী ধূলিতে মিশে গিছে, সেই মাত্রার ভূমিকম্পে নিউইয়র্ক বা সানফ্রান্সিসকো এভাবে ধসে যেত না। আজ হাইতিতে যা দেখছি, তা হাইতির দীর্ঘ বিদেশি শোষণ, দুর্নীতি ও অপশাসনের ফল।’ এ কথাটাই সত্য হয়ে ফলে গেল দিনকতক আগের চিলির ভূমিকম্পে। এটি ছিল হাইতির ভূমিকম্পের থেকে কয়েক শ গুণ বেশি শক্তিশালী। অথচ ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হাজার হাজার গুণ কম। এ পর্যন্ত চিলিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে সাতশ—হয়তো তা শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজার হবে। দুটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার তুলনা করলেই চিলিতে লাখ লাখ মানুষের বেঁচে যাওয়ার কারণটি পরিষ্কার হয়। হাইতি কেবল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশই নয়, এক অকার্যকর রাষ্ট্রের আদর্শ মডেল। বছরের পর বছর এখানে সামরিক শাসন ও লুণ্ঠন চলেছে। মুক্তবাজারি অর্থনীতিতে লাখ লাখ কৃষক গ্রামাঞ্চল থেকে জমি হারিয়ে ভিড় জমায় রাজধানীতে। এর জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশই চলে যায় বিদেশি ঋণ শোধ করতে। রাজনীতিতে হানাহানি, অর্থনীতি রুগ্ণ আর অবকাঠামো এমনই অকেজো যে ভূমিকম্পের পরের জরুরি ত্রাণকাজ চালানোর সামর্থ্যও দেশটি হারিয়ে ফেলে। এরই ফলে ১০ হাজার মার্কিন সেনা কার্যত দেশটি অধিকার করে নেয়। হাইতির সেনাশাসকেরা এমনই অপদার্থ, না জনগণের জীবন, না দেশের স্বাধীনতা— কোনোটিই রক্ষা করার মুরোদ তাদের ছিল না।
অন্যদিকে চিলি হলো লাতিন আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোর একটি। এর অধিবাসীদের জীবনমান রাশিয়া ও মেক্সিকোর মতো মধ্যম আয়ের দেশের সমান। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুবাদে দেশটির নেতৃত্ব শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে ভবন নির্মাণ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে। সেই নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের সেখানে ধরাও যায়, ছোঁয়াও যায়। কারণ, আইনিব্যবস্থা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি ছিল কঠোর। দুর্নীতি সেখানে তুলনামূলকভাবে কম, কারণ বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী। হাইতি ছিল সেনাশাসনে আর চিলিতে গত দেড় দশক চলেছে মধ্য বামপন্থী দলের সরকার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্ট ভূমিকম্প মোকাবিলায় চিলির পূর্বপ্রস্তুতির প্রশংসা করে তাই লিখেছে, ‘কখন কোথায় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আঘাত হানবে তা ঠিক করার মালিক প্রকৃতি হলেও, তাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা নির্ধারণের অধিকারী এখনো মানুষ।’
চিলি আর হাইতির মধ্যে বাংলাদেশের চালচলন হাইতির কাছাকাছি। বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ দরিদ্র ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত মানুষ ঢাকা শহরে ভিড় জমিয়েছে। তাদের ঠাঁই দিতে অপরিকল্পিতভাবে শহর বড় করা হয়েছে। বিল-নদী-জলাশয় ভরাট করা অপরিকল্পিত আবাসন ইত্যাদির জন্য বিপন্ন ঢাকা আরও বিপন্নই হচ্ছে। মাঝখানে ফুলেফেঁপে উঠেছে আবাসন ব্যবসা। জাতিসংঘের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের পরে ঢাকাই সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগর। তেহরানের বিপদের কারণ শহরটি অনেকগুলো ভূমিকম্পের উেসর মাঝখানে অবস্থিত। আর ঢাকার বিপদ এর দুর্বল স্থাপনা এবং অধিকতর দুর্বল অবকাঠমো এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহা প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশ ভবনের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশ ভবনের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের আইএসডিআর নামক সংস্থা বলছে, ঢাকার বৃহত্ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসরিত হয়নি। অন্য একটি গবেষণায় বলা হয় ৯০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ (ডেইলি স্টার, ১৩ আগস্ট, ২০০৯)। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখকেই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। প্রকৌশলীদের মাধ্যমে নির্মিত ভবনগুলোর ৬০ শতাংশও ঝুঁকির বাইরে নয়। ঝুঁকি বেশি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। অল্প জায়গায় বেশি ভবনের ভারে ঢাকার মাটি দেবে যাচ্ছে, অতিমাত্রায় পানি তুলতে থাকায় পাতালস্তরে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে আবাসনশিল্প যেন চির দায়মুক্তি উপভোগ করছে। তাদের তৈরি অধিকাংশ ভবনই যে মাঝারি মাপের ভূমিকম্প সহ্য করতে সক্ষম নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা যথাযথ নকশা ও পরিকল্পনা অনুসরণ করে না, তার ব্যাখ্যা কে চাইবে? চাইতে পারে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো, তথা রাজউক, গণপূর্ত বিভাগ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ঘুষের ক্ষমতা’র সামনে ‘সকলই গরল ভেল’। ২০০৮ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে নির্মাণশিল্পে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর পরে রয়েছে ‘উন্নয়ন’ ও ‘রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসা। ঘুষ কারা দেন আর কারা তা খান, তা কি আর ভেঙে বলার প্রয়োজন আছে?
সিডিএমপির গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের মতে, কোনো বিশেষ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটতে ১০০-১৫০ বছর সময় লাগে (ডেইলি স্টার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১০)। তিনি সম্ভাব্য মৃত্যুর একটা পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। সেই ভয়ধরানো কথায় আর না গেলাম। এ দেশে শেষ বড় আকারের ভূমিকম্পটি (৮.৭ মাত্রার ) ঘটে ১৮৯৭ সালে। ঢাকার বেশির ভাগ ভবন সে সময় ধসে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ হিসাবে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ওপর একটি বড় আকারের ভূমিকম্প ঝুলে আছে। ভূমিকম্প কখন কোথায় আঘাত হানবে তা আমরা আগাম জানতে পারি না, কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি ভালো থাকলে ক্ষয়ক্ষতি যে বড় আকারে কমানো সম্ভব তার প্রমাণ তো চিলি। বাংলাদেশের সার্বিক দুরবস্থা কিন্তু আমাদের আশ্বস্ত করে না। আমাদের অনেক বাড়ি-ঘরই আজ এক বিরাট ‘উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’ তথা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অংশ হয়ে গেছে।
ঢাকা এখন হয়ে উঠছে রামায়ণের জতুগৃহের মতো। সপরিবারে রামের বনবাসের সময় জতুগৃহ নামে এক ঘরে তাঁরা আশ্রয় পান। কিন্তু সেটির মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটাই বানানো হয়েছিল দাহ্যবস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে পুড়িয়ে দেওয়া যায়। নিশ্চয়ই ঢাকাকে কেউ ইচ্ছে করে এমন ‘উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’ হিসেবে নির্মাণ করেনি। কিন্তু অবহেলার থেকে বড় দায় আর কী হতে পারে? কথা সত্য যে ভূমিকম্প যুক্তি মেনে চলে না এবং এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভূমিকম্প মোকাবিলা ও তার আঘাত সামলে ওঠার সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতির যোগ নাড়ির যোগের মতোই ঘনিষ্ঠ। দুর্নীতি, মন্দ রাজনীতি এবং দায়িত্বহীন নেতৃত্ব থাকলে কী হয় তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ হাইতি। হাইতিবাসী কেবল ভূমিকম্পের আঘাতেই গণহারে নিহত হয়নি, এর পরের লুটপাট, নৈরাজ্য, ত্রাণ-সহায়তা দেওয়ায় সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদির কারণে ক্ষয়ক্ষতি বিপুল হারে বেড়েছে। আমরা আমাদের দেশের সরকার, সরকারি সংস্থা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি যতটা চিনি, তাতে কল্পনা করতেও ভয় হয়, তেমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থা চিলির মতো না হয়ে হয়তো হাইতির মতোই হবে। কীভাবে বুঝলাম? বুঝলাম আইলা দুর্গতদের দিকে তাকিয়ে। এক বছর হয়ে গেল, অথচ এখনো তারা পানি-আশ্রয়-চিকিত্সাহীন অবস্থায় নারকীয় পরিবেশে দিনাতিপাত করছে।
পাঠক, বাস্তবতা যতই হতাশাময় হোক, জীবন নিজেই মস্তবড় এক আশার নাম। আমরাও আশার ঘরেই বসত করতে চাই, জতুগৃহে নয়। সদিচ্ছা থাকলে তাই কিছুই বাধা নয়। আর যদি সদিচ্ছা না জাগে, তাহলে আমাদের অবস্থা হবে গ্রিক উপকথার সেই অন্ধ জ্ঞানী তাইরেসিয়াসের মতো, যিনি জানেন কী ঘটবে কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা দেবতারা তাঁকে দেননি। আমরা মানুষ, আমরা তাইরেসিয়াস নই। আমরা জানি কী করতে হবে, জেনেশুনে তাই সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার থেকে বড় অপরাধ আর কিছু হতে পারে না।
বড় রদবদলের জন্য বড় উদ্যোগ চাই, মামুলি খুটখাট দিয়ে ঢাকাকে বাঁচানো আর কাঠি দিয়ে পাহাড় নড়ানোর চিন্তা সমান কথা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক
farukwasif@yahoo.com
এ শহরে এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যাঁরা ঘুমাতে যান ভূমিকম্পের ভয় নিয়ে, কিংবা ঘুমের মধ্যে আচমকা জেগে উঠে ভীতভাবে বুঝতে চান, বিছানাটা কি নড়ে উঠল? কোনো না কোনো দেশে নতুন ভূমিকম্প হলেই এ ধরনের আতঙ্কে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ক্যারিবিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্স সাত মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। ভবনচাপা পড়ে মারা যায় প্রায় তিন লাখ মানুষ। সে সময় প্রথম আলোর পাতাতেই লিখেছিলাম, ‘যে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতির রাজধানী ধূলিতে মিশে গিছে, সেই মাত্রার ভূমিকম্পে নিউইয়র্ক বা সানফ্রান্সিসকো এভাবে ধসে যেত না। আজ হাইতিতে যা দেখছি, তা হাইতির দীর্ঘ বিদেশি শোষণ, দুর্নীতি ও অপশাসনের ফল।’ এ কথাটাই সত্য হয়ে ফলে গেল দিনকতক আগের চিলির ভূমিকম্পে। এটি ছিল হাইতির ভূমিকম্পের থেকে কয়েক শ গুণ বেশি শক্তিশালী। অথচ ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হাজার হাজার গুণ কম। এ পর্যন্ত চিলিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে সাতশ—হয়তো তা শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজার হবে। দুটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার তুলনা করলেই চিলিতে লাখ লাখ মানুষের বেঁচে যাওয়ার কারণটি পরিষ্কার হয়। হাইতি কেবল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশই নয়, এক অকার্যকর রাষ্ট্রের আদর্শ মডেল। বছরের পর বছর এখানে সামরিক শাসন ও লুণ্ঠন চলেছে। মুক্তবাজারি অর্থনীতিতে লাখ লাখ কৃষক গ্রামাঞ্চল থেকে জমি হারিয়ে ভিড় জমায় রাজধানীতে। এর জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশই চলে যায় বিদেশি ঋণ শোধ করতে। রাজনীতিতে হানাহানি, অর্থনীতি রুগ্ণ আর অবকাঠামো এমনই অকেজো যে ভূমিকম্পের পরের জরুরি ত্রাণকাজ চালানোর সামর্থ্যও দেশটি হারিয়ে ফেলে। এরই ফলে ১০ হাজার মার্কিন সেনা কার্যত দেশটি অধিকার করে নেয়। হাইতির সেনাশাসকেরা এমনই অপদার্থ, না জনগণের জীবন, না দেশের স্বাধীনতা— কোনোটিই রক্ষা করার মুরোদ তাদের ছিল না।
অন্যদিকে চিলি হলো লাতিন আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোর একটি। এর অধিবাসীদের জীবনমান রাশিয়া ও মেক্সিকোর মতো মধ্যম আয়ের দেশের সমান। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুবাদে দেশটির নেতৃত্ব শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে ভবন নির্মাণ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে। সেই নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের সেখানে ধরাও যায়, ছোঁয়াও যায়। কারণ, আইনিব্যবস্থা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি ছিল কঠোর। দুর্নীতি সেখানে তুলনামূলকভাবে কম, কারণ বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী। হাইতি ছিল সেনাশাসনে আর চিলিতে গত দেড় দশক চলেছে মধ্য বামপন্থী দলের সরকার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্ট ভূমিকম্প মোকাবিলায় চিলির পূর্বপ্রস্তুতির প্রশংসা করে তাই লিখেছে, ‘কখন কোথায় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আঘাত হানবে তা ঠিক করার মালিক প্রকৃতি হলেও, তাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা নির্ধারণের অধিকারী এখনো মানুষ।’
চিলি আর হাইতির মধ্যে বাংলাদেশের চালচলন হাইতির কাছাকাছি। বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ দরিদ্র ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত মানুষ ঢাকা শহরে ভিড় জমিয়েছে। তাদের ঠাঁই দিতে অপরিকল্পিতভাবে শহর বড় করা হয়েছে। বিল-নদী-জলাশয় ভরাট করা অপরিকল্পিত আবাসন ইত্যাদির জন্য বিপন্ন ঢাকা আরও বিপন্নই হচ্ছে। মাঝখানে ফুলেফেঁপে উঠেছে আবাসন ব্যবসা। জাতিসংঘের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের পরে ঢাকাই সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগর। তেহরানের বিপদের কারণ শহরটি অনেকগুলো ভূমিকম্পের উেসর মাঝখানে অবস্থিত। আর ঢাকার বিপদ এর দুর্বল স্থাপনা এবং অধিকতর দুর্বল অবকাঠমো এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহা প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশ ভবনের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশ ভবনের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের আইএসডিআর নামক সংস্থা বলছে, ঢাকার বৃহত্ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসরিত হয়নি। অন্য একটি গবেষণায় বলা হয় ৯০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ (ডেইলি স্টার, ১৩ আগস্ট, ২০০৯)। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখকেই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। প্রকৌশলীদের মাধ্যমে নির্মিত ভবনগুলোর ৬০ শতাংশও ঝুঁকির বাইরে নয়। ঝুঁকি বেশি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। অল্প জায়গায় বেশি ভবনের ভারে ঢাকার মাটি দেবে যাচ্ছে, অতিমাত্রায় পানি তুলতে থাকায় পাতালস্তরে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে আবাসনশিল্প যেন চির দায়মুক্তি উপভোগ করছে। তাদের তৈরি অধিকাংশ ভবনই যে মাঝারি মাপের ভূমিকম্প সহ্য করতে সক্ষম নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা যথাযথ নকশা ও পরিকল্পনা অনুসরণ করে না, তার ব্যাখ্যা কে চাইবে? চাইতে পারে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো, তথা রাজউক, গণপূর্ত বিভাগ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ঘুষের ক্ষমতা’র সামনে ‘সকলই গরল ভেল’। ২০০৮ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে নির্মাণশিল্পে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর পরে রয়েছে ‘উন্নয়ন’ ও ‘রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসা। ঘুষ কারা দেন আর কারা তা খান, তা কি আর ভেঙে বলার প্রয়োজন আছে?
সিডিএমপির গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের মতে, কোনো বিশেষ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটতে ১০০-১৫০ বছর সময় লাগে (ডেইলি স্টার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১০)। তিনি সম্ভাব্য মৃত্যুর একটা পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। সেই ভয়ধরানো কথায় আর না গেলাম। এ দেশে শেষ বড় আকারের ভূমিকম্পটি (৮.৭ মাত্রার ) ঘটে ১৮৯৭ সালে। ঢাকার বেশির ভাগ ভবন সে সময় ধসে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ হিসাবে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ওপর একটি বড় আকারের ভূমিকম্প ঝুলে আছে। ভূমিকম্প কখন কোথায় আঘাত হানবে তা আমরা আগাম জানতে পারি না, কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি ভালো থাকলে ক্ষয়ক্ষতি যে বড় আকারে কমানো সম্ভব তার প্রমাণ তো চিলি। বাংলাদেশের সার্বিক দুরবস্থা কিন্তু আমাদের আশ্বস্ত করে না। আমাদের অনেক বাড়ি-ঘরই আজ এক বিরাট ‘উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’ তথা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অংশ হয়ে গেছে।
ঢাকা এখন হয়ে উঠছে রামায়ণের জতুগৃহের মতো। সপরিবারে রামের বনবাসের সময় জতুগৃহ নামে এক ঘরে তাঁরা আশ্রয় পান। কিন্তু সেটির মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটাই বানানো হয়েছিল দাহ্যবস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে পুড়িয়ে দেওয়া যায়। নিশ্চয়ই ঢাকাকে কেউ ইচ্ছে করে এমন ‘উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’ হিসেবে নির্মাণ করেনি। কিন্তু অবহেলার থেকে বড় দায় আর কী হতে পারে? কথা সত্য যে ভূমিকম্প যুক্তি মেনে চলে না এবং এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভূমিকম্প মোকাবিলা ও তার আঘাত সামলে ওঠার সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতির যোগ নাড়ির যোগের মতোই ঘনিষ্ঠ। দুর্নীতি, মন্দ রাজনীতি এবং দায়িত্বহীন নেতৃত্ব থাকলে কী হয় তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ হাইতি। হাইতিবাসী কেবল ভূমিকম্পের আঘাতেই গণহারে নিহত হয়নি, এর পরের লুটপাট, নৈরাজ্য, ত্রাণ-সহায়তা দেওয়ায় সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদির কারণে ক্ষয়ক্ষতি বিপুল হারে বেড়েছে। আমরা আমাদের দেশের সরকার, সরকারি সংস্থা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি যতটা চিনি, তাতে কল্পনা করতেও ভয় হয়, তেমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থা চিলির মতো না হয়ে হয়তো হাইতির মতোই হবে। কীভাবে বুঝলাম? বুঝলাম আইলা দুর্গতদের দিকে তাকিয়ে। এক বছর হয়ে গেল, অথচ এখনো তারা পানি-আশ্রয়-চিকিত্সাহীন অবস্থায় নারকীয় পরিবেশে দিনাতিপাত করছে।
পাঠক, বাস্তবতা যতই হতাশাময় হোক, জীবন নিজেই মস্তবড় এক আশার নাম। আমরাও আশার ঘরেই বসত করতে চাই, জতুগৃহে নয়। সদিচ্ছা থাকলে তাই কিছুই বাধা নয়। আর যদি সদিচ্ছা না জাগে, তাহলে আমাদের অবস্থা হবে গ্রিক উপকথার সেই অন্ধ জ্ঞানী তাইরেসিয়াসের মতো, যিনি জানেন কী ঘটবে কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা দেবতারা তাঁকে দেননি। আমরা মানুষ, আমরা তাইরেসিয়াস নই। আমরা জানি কী করতে হবে, জেনেশুনে তাই সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার থেকে বড় অপরাধ আর কিছু হতে পারে না।
বড় রদবদলের জন্য বড় উদ্যোগ চাই, মামুলি খুটখাট দিয়ে ঢাকাকে বাঁচানো আর কাঠি দিয়ে পাহাড় নড়ানোর চিন্তা সমান কথা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক
farukwasif@yahoo.com
No comments