পাঁচ বছর পরে একদিন by ফিরোজ জামান চৌধুরী
পাঁচ বছর আগে এমন এক বাদল দিনের ভোরে সূর্য উঠেছিল কান্নামাখা চোখে। বন্ধুর টেলিফোনে খবর পেলাম, সিতারা পারভীন নেই...। ‘পৃথিবীর সব রং মুছে’ দিয়ে ‘প্রিয়তম পাতাটি’ ঝরে গেল। ২০০৫ সালের ২৩ জুন ড. সিতারা পারভীন, আমাদের প্রিয় সিতারা আপা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে ক্যানসাসে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ২৩ জুন ছিল তাঁর জীবনের শেষ পথচলা। তারপর, বাকি সব ইতিহাস। আজ সেই কালরাত ২৩ জুন। এই দিনে আমরা আমাদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ সিতারা পারভীনকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা, পরম মমতা আর ীম ভালোবাসায়।
যখন ‘চারপাশে সব মুখস্থ মানুষ দেখি’, ভণ্ডামি আর শঠতায় ভরা সম্পর্কের ভান দেখি, তখনই মনে পড়ে সিতারা আপার কথা। আজকের সমাজে ক্ষমতার মোহ আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, তখন সিতারা পারভীন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে দেখা দেন।
পাঁচ বছর হলো তাঁর বিদায়ের কাল। নাজিম হিকমতের প্রিয় পঙিক্তটি ইদানীং ফিরে ফিরে মনে পড়ে, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ হিকমতের কাছেই উল্টো জানতে ইচ্ছে করে, একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু তবে কত? মহাকালের গর্ভে সময় দ্রুত চলে যায়, মানুষ স্মৃতি খুঁজে ফেরে আজীবন। পাঁচ থেকে দশ। দশ থেকে কুড়ি—অপেক্ষার হয় না শেষ। জীবনানন্দ যেমন বলেন, ‘আবার কুড়ি বছর পরে তার সাথে যদি দেখা হয়, আবার বছর কুড়ি পরে...।’
২.
সিতারা পারভীন আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমারও। বলা ভালো এখনো আছেন। নিয়মনিষ্ঠ এ মানুষটির কাছে আমি আমার জীবনের অনেক জটিল ধাঁধার সরল সমাধান পেয়েছি। সিতারা আপা বলতেন, ‘অ্যাভয়েড নেগেটিভ থিংকিং, দেখো, এতেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এ দর্শনটি সে সময় আমাকে আমূল আলোড়িত করেছিল। আমি এখনো আপার এ কথাটি বিশ্বাস করি, মান্য করি এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।
সিতারা পারভীন শুধু বড় মাপের শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষও। অল্প পরিচিত কোনো শিক্ষার্থীর ছোট্ট প্রয়োজনেও তিনি এগিয়ে আসতেন। যে কেউই তাঁর কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতে পারত। আপা সবার কথা শুনতেন অকাতরে, শিক্ষার্থীরা তার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করত। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, তেমনি প্রিয় ছিলেন তাঁর সহকর্মীদের কাছেও। তাঁর সহকর্মী, এমনকি সাধারণ কর্মচারীরাও তাঁকে আশ্রয়ের ক্ষেত্র মনে করতেন।
তাঁর কথা মনে হলেই হেলেন কেলারের একটি উক্তি কানে বাজে, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য চোখে দেখে বা কানে শুনে উপলব্ধি করা যায় না; এটা উপলব্ধি করতে হয় হূদয় দিয়ে।’ তাই সই। সিতারা আপাকে হূদয় দিয়েই উপলব্ধি করে যাব সারা জীবন।
৩.
অধ্যাপক সিতারা পারভীনের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ এবং পুনরায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচডি করেন ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আমৃত্যু অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক সিতারা পারভীন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাঁর স্বামী তাঁরই সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। তাঁর একমাত্র সন্তান এষা শ্রাবণী।
২০০৫ সালের ২৩ জুন ড. সিতারা পারভীন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি আইডব্লিউপিআরের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলনে অংশ নিতে ২০০৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন।
ড. সিতারা পারভীনের গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ছিল গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, নারী ও আদিবাসী। আদিবাসীবিষয়ক গবেষণায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন মাতৃতান্ত্রিক মান্দি (গারো) সম্প্রদায়কে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মান্দি-অধ্যুষিত টাঙ্গাইলের মধুপুর ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর-বিরিশিরিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণার কাজ করেছেন। তাঁর অনেক গবেষণাকর্ম অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। এগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
৪.
সিতারা পারভীন নারী-পুরুষ সাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নীরবে নারী-অধিকার বিষয়ে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান থাকাকালে তিনি ‘চেয়ারপারসন’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করেন, চেষ্টা করেছিলেন নারী-পুরুষ সব শিক্ষকের জন্য এ শব্দটির ব্যবহার স্থায়ীভাবে চালু করতে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তন স্থায়ী করতে পারেননি। সাংবাদিকতা বিভাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনা বা একাডেমিক কাজে এখনো ‘চেয়ারম্যান’ শব্দটিই দেখা যায়। এ শব্দটির পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শব্দটির পরিবর্তন করে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেবে কি? সিতারা পারভীনের সহকর্মী অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি উদ্যোগ নিলে কাজটি অনেক সহজ হয়।
firoz.choudhuryঅ্যাটgmail.com
যখন ‘চারপাশে সব মুখস্থ মানুষ দেখি’, ভণ্ডামি আর শঠতায় ভরা সম্পর্কের ভান দেখি, তখনই মনে পড়ে সিতারা আপার কথা। আজকের সমাজে ক্ষমতার মোহ আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, তখন সিতারা পারভীন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে দেখা দেন।
পাঁচ বছর হলো তাঁর বিদায়ের কাল। নাজিম হিকমতের প্রিয় পঙিক্তটি ইদানীং ফিরে ফিরে মনে পড়ে, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ হিকমতের কাছেই উল্টো জানতে ইচ্ছে করে, একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু তবে কত? মহাকালের গর্ভে সময় দ্রুত চলে যায়, মানুষ স্মৃতি খুঁজে ফেরে আজীবন। পাঁচ থেকে দশ। দশ থেকে কুড়ি—অপেক্ষার হয় না শেষ। জীবনানন্দ যেমন বলেন, ‘আবার কুড়ি বছর পরে তার সাথে যদি দেখা হয়, আবার বছর কুড়ি পরে...।’
২.
সিতারা পারভীন আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমারও। বলা ভালো এখনো আছেন। নিয়মনিষ্ঠ এ মানুষটির কাছে আমি আমার জীবনের অনেক জটিল ধাঁধার সরল সমাধান পেয়েছি। সিতারা আপা বলতেন, ‘অ্যাভয়েড নেগেটিভ থিংকিং, দেখো, এতেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এ দর্শনটি সে সময় আমাকে আমূল আলোড়িত করেছিল। আমি এখনো আপার এ কথাটি বিশ্বাস করি, মান্য করি এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।
সিতারা পারভীন শুধু বড় মাপের শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষও। অল্প পরিচিত কোনো শিক্ষার্থীর ছোট্ট প্রয়োজনেও তিনি এগিয়ে আসতেন। যে কেউই তাঁর কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতে পারত। আপা সবার কথা শুনতেন অকাতরে, শিক্ষার্থীরা তার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করত। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, তেমনি প্রিয় ছিলেন তাঁর সহকর্মীদের কাছেও। তাঁর সহকর্মী, এমনকি সাধারণ কর্মচারীরাও তাঁকে আশ্রয়ের ক্ষেত্র মনে করতেন।
তাঁর কথা মনে হলেই হেলেন কেলারের একটি উক্তি কানে বাজে, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য চোখে দেখে বা কানে শুনে উপলব্ধি করা যায় না; এটা উপলব্ধি করতে হয় হূদয় দিয়ে।’ তাই সই। সিতারা আপাকে হূদয় দিয়েই উপলব্ধি করে যাব সারা জীবন।
৩.
অধ্যাপক সিতারা পারভীনের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ এবং পুনরায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচডি করেন ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আমৃত্যু অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক সিতারা পারভীন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাঁর স্বামী তাঁরই সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। তাঁর একমাত্র সন্তান এষা শ্রাবণী।
২০০৫ সালের ২৩ জুন ড. সিতারা পারভীন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি আইডব্লিউপিআরের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলনে অংশ নিতে ২০০৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন।
ড. সিতারা পারভীনের গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ছিল গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, নারী ও আদিবাসী। আদিবাসীবিষয়ক গবেষণায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন মাতৃতান্ত্রিক মান্দি (গারো) সম্প্রদায়কে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মান্দি-অধ্যুষিত টাঙ্গাইলের মধুপুর ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর-বিরিশিরিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণার কাজ করেছেন। তাঁর অনেক গবেষণাকর্ম অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। এগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
৪.
সিতারা পারভীন নারী-পুরুষ সাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নীরবে নারী-অধিকার বিষয়ে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান থাকাকালে তিনি ‘চেয়ারপারসন’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করেন, চেষ্টা করেছিলেন নারী-পুরুষ সব শিক্ষকের জন্য এ শব্দটির ব্যবহার স্থায়ীভাবে চালু করতে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তন স্থায়ী করতে পারেননি। সাংবাদিকতা বিভাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনা বা একাডেমিক কাজে এখনো ‘চেয়ারম্যান’ শব্দটিই দেখা যায়। এ শব্দটির পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শব্দটির পরিবর্তন করে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেবে কি? সিতারা পারভীনের সহকর্মী অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি উদ্যোগ নিলে কাজটি অনেক সহজ হয়।
firoz.choudhuryঅ্যাটgmail.com
No comments