চলে গেলেন নির্মল সেন
‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’—এমন শিরোনামে প্রকাশিত যাঁর লেখা একসময় স্লোগানে পরিণত হয়, সেই নির্মল সেন, সবার প্রিয় নির্মলদা চলে গেলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, নিরহংকার ও নির্লোভ এই সাংবাদিক জীবনভর অবিচল ছিলেন বাম ও প্রগতিশীল আদর্শে।
গত ২২ ডিসেম্বর থেকে নির্মল সেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মৃত্যু তাঁকে আলিঙ্গন করে। অকৃতদার এই সংগ্রামী মানুষটির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। অসুস্থ হয়ে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় রওনা হওয়ার আগে তিনি পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে জীবনের শেষ চার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এগুলো হচ্ছে: নিজ গ্রামের বাড়ি দিঘীরপাড়ে একটি মহিলা কলেজ নির্মাণ করা। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ কোনো মেডিকেল কলেজে দান করা। সাংবাদিকতা পেশায় অবদানের জন্য তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পুরস্কার দেওয়া হলে তা গ্রহণ না করা। এ ছাড়া মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর মৃত্যুর সময় নির্মল সেনকে যেসব কথা বলে গেছেন, তা বাম রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সংবাদ সমেঞ্চলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা।সাংবাদিকতা ছাড়াও জীবনভর ছাত্ররাজনীতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, শ্রমিক আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নির্মল সেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত সাংবাদিক সমাবেশে হুইলচেয়ারে এসে তিনি বিভেদ ভুলে অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া নির্মল সেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্মল সেনের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে নির্মল সেনের অবদানের কথা স্মরণ করেন। খালেদা জিয়া বলেন, নির্মল সেন ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক অনন্য প্রতীক।
আজ বুধবার নির্মল সেনের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি কোটালীপাড়ায় দিঘীরপাড়ে নেওয়া হবে। সেখান থেকে মরদেহ আনা হবে ঢাকায়। কাল বৃহস্পতিবার সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং জাতীয় প্রেসক্লাবে রাখা হবে। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রয়াতের মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হবে।
১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে নির্মল সেনের জন্ম। পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মাতার নাম লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্তা। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ।
১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি। তখন রেভলুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (আরএসপি) কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হন। আরএসপি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল।
নির্মল সেন বরিশালের বিএম কলেজে পড়াশোনা করছেন। ভাষা আন্দোলন এবং ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। আরএসপির নির্দেশে ১৯৫৬ সালে ছাত্রলীগ ছেড়ে দেন। যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। এরপর জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ এবং পথচলা।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য সাংবাদিকতা শুরু করেন নির্মল সেন। সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক-এ। কিন্তু জেল থেকে রক্ষা পাননি। প্রায় পাঁচ বছর পর জেল খাটার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়ে যোগ দেন জেহাদ পত্রিকায়। এরপর সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা) আত্মপ্রকাশ করে। প্রায় ৩৩ বছর ধরে দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম সংখ্যা থেকে দৈনিক বাংলার শেষ সংখ্যা পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি।
জীবনভর অসংখ্য কলাম লিখেছেন নির্মল সেন। এগুলোর মধ্যে ‘হাশেম চৌধুরী একটি লাশ চায়’, ‘লজ্জা দিলে তো আবরণ দিলে না কেন?’, ‘জান দেব তো গ্যাস দেব না’ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতাত্তোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’।
নির্মল সেনের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: মানুষ সমাজ রাষ্ট্র, বার্লিন থেকে মস্কো, পূর্ব বঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশ, মা জন্মভূমি, লেনিন থেকে গর্ভাচেভ, আমার জবানবন্দী, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৯ সালে আদমজী জুটমিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন। একই বছর অগ্নিযুগের বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায়, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, নেপাল নাহা, রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৮ সালে নির্মল সেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
No comments