নতুন বছরে দরিদ্রদের পরিবর্তন যদি হয় by লুৎফর রহমান রনো

যে দিন, যে সময় গত হলো-যে বছর বিদায় নিল, তার ওপর ভিত্তি করেই নতুন বছরের প্রত্যাশা জন্ম নেবে। আবার অনুরূপ গত বছরের মতোই নিজ নিজ জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশা, সাফল্য-ব্যর্থতা থেকেই যাবে। জীবনের রং বদলানো সহজ নয়-কোনো বছর বা নির্দিষ্ট সময়ের মাপজোকের মধ্যে। জুয়া, ঘুষ, কমিশন, তোষামোদ ইত্যাদি লাইনের অগ্রভাগে যারা আছে, তাদের কথা আলাদা। আর ২০১১ সাল বলি বা গত কয়েক দশক বলি-সবই তো


ব্যবসায়ীদের। বর্তমানের বিশ্বায়নিক 'উদারতার' সুবিধাভোগী একমাত্র বিশ্বের ব্যবসায়ীরা। তা ইতালি ও আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি হোক কিংবা হোক আমাদের দেশের সয়াবিন তেলের পরিবেশক। বাণিজ্য-মুুনাফা রমরমা। লিটারপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে গেল সয়াবিন তেলের দাম। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল গত এক বছরে চারবার। এতে জীবনযাত্রার মান কমছে, ব্যয় বাড়লে জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিকভাবেই কমতে থাকে। আর যাদের জীবনযাত্রার কোনো মানই নেই, তাদের জীবনের যাত্রাই বিঘি্নত হয়, অর্থাৎ দরিদ্র্যের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে যে অভাব ও বেকারত্ব বেড়েছে, তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ইংল্যান্ডের ধর্মঘট বা যুক্তরাষ্ট্রে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের চেহারায়। কিন্তু বিশ্বমন্দার প্রভাব আমাদের দেশে আগেরবারের মন্দার মতো প্রকট হয়ে পড়েনি। তার কারণ, আমাদের জীবন এখনো অর্ধেক অন্তত বেঁচে আছে কৃষিনির্ভরশীলতায়। যা-ই হোক, বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের খাদ্যপণ্যের বা জ্বালানি খাতের মূল্যবৃদ্ধির কারণ যতটা না আন্তর্জাতিক বাজার, তার চেয়ে অভ্যন্তরীণ নীতিমালাই বেশি দায়ী। আর অভ্যন্তরীণ নীতিমালা যাদের দ্বারা তৈরি হয় তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। একাধিক রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেছেন, 'সংসদে প্রায় ৬০ শতাংশ দখল করে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।' আরো খোলাখুলি মন্তব্য করেছেন অনেকেই-বলেছেন, 'সরকার দরিদ্রবান্ধব নয়, ধনীবান্ধব।' যে যা-ই বলুন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্যের শতকরা হার কমানোর প্রচেষ্টায় দুর্দমনীয় রয়েছেন। বাংলাদেশ অ্যাপারেল অ্যান্ড টেঙ্টাইল এঙ্পোজিশনের (বাটেঙ্পো-২০১১) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চার বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২১ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে তাঁর সরকার কৃষি ও শিল্প খাতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দারিদ্র্যের হার এখনো ৪০ শতাংশের ওপর। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'প্রথমবারের মতো দেশে ২৭০টি রুগ্ণ ও বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানার ঋণ হিসেবে তারল্যের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।' পাশাপাশি বলেছেন, '৩৬ লাখ পোশাকশ্রমিকের স্বার্থে তাঁর সরকার শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি এক হাজার ৬৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করেছে।' নিশ্চয়ই, এটি একটি সরকারের ভালো কাজ। বড়জোর একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করা হয়েছে বলা যায়। কারণ আজকের বাজারে ১৫০০ টাকায় একজন হতদরিদ্র শ্রমিকের জীবনও বেশি দিন টিকবে না। অনাহারে ও অপুষ্টিতে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর আশ্রয়ে চলে যাবে। আর তাদের বাঁচিয়ে না রাখলে সেলাই মেশিনের চাকা চলবে না। তাই মালিকরা এটা মেনে নিতে খুব গড়িমসি করেননি। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা দাবি করেছিল ছয় হাজার টাকা। সরকার যদি পাঁচ হাজারে তা রফা করে দিত, তাহলে তা হতো ন্যায়ভিত্তিক পদক্ষেপ। রাষ্ট্রের যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে মৃত ও রুগ্ণ শিল্প-কারখানা পুনরুজ্জীবিত করা, তেমনি শিল্পপতিদের রয়েছে কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা। আর তা কোনো খেলার ক্লাব, এতিমখানা, স্কুল-কলেজে দান করার মধ্য দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়ে সারা হয় না, সামাজিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে শ্রমিকস্বার্থ নিবিড়। সেটাও রাষ্ট্রের দেখতে হবে, শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে কি না, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত আছে কি না, পরিবেশ দূষণ করছে কি না। আমাদের সরকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতির স্বার্থ সম্পর্কে যতটুকু সচেতন, ঠিক ততটুকুই অমনোযোগী শ্রমিকস্বার্থের বেলায়। একজন শ্রমিককে যে শিল্পোৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার টাকা মাইনে দিলে লোকসান গুনতে হবে বলে, তার কোনো অধিকার নেই শ্রমিক খাটিয়ে ব্যবসা করার। দেশে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা গলা মিলিয়ে চিৎকার করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে তাই...। আন্তর্জাতিক বাজারে, বহুজাতিক বাণিজ্যে, বিশ্বায়নিক রাজনীতিতে, আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতিতে কত কিছুই হচ্ছে, বদলাচ্ছে, ঘটে চলেছে নিরন্তর হাজারো ঘটনা। তাতে বাংলাদেশ কতটুকুই সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে? শুধু পণ্যের দাম বাড়লেই আন্তর্জাতিক বাজারের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়। আর যদি তা-ই সত্য হয়, তবে এটাও স্পষ্ট করে বলা ভালো যে আন্তর্জাতিক মানের আয়-রোজগার যাদের আছে, তারাই ওই পণ্যের ক্রেতা, অতএব হৈচৈ করার কোনো অর্থ নেই। কেরোসিনের দাম বেড়েছে, গ্রামে বিদ্যুৎবিহীন ঘরে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো ছাড়া গরিব মানুষ পারতপক্ষে আলোতে মুখ দেখাদেখি করবে না। বিদ্যুৎ আছে যাদের, তারাও সুইচ অন করে বেশি সময় রাখবে না। এত খরচ কুলোতে পারবে না বলে আলোর সময়টুকু এখন দখল করে নেবে অন্ধকার। ঠিক এভাবেই পুষ্টির জায়গায় অপুষ্টি, শিক্ষার জায়গায় অশিক্ষা, স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে ঝরেপড়া, দারিদ্র্য রেখা টপকে যাওয়ার বদলে দারিদ্র্য রেখার নিচে তলিয়ে যাওয়া চলবেই। সরকার জনগণের জন্য ভর্তুকি দিতে অপারগ, বাজার মাত্রায় মাইনে দিতে ব্যর্থ বা অনীহা, ফলে একদিকে বৃদ্ধি পাবে অনাহার, অপুষ্টি, অশিক্ষা, আর অপরদিকে ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর মুনাফা যথাযথভাবে অর্জিত হবে সরকারের সহায়তা ও সহৃদয়তায়-তাহলে সরকার তো যথার্থই ধনীবান্ধব। ... কী আর লেখা যায়। নতুন বছরে সেই পরিচিত কাসুন্দি। ডিজিটাল যুগ হোক কিংবা গ্রহান্তর যুগও যদি আসে, তবুও নগরবাসী বাসে বাদুড়ঝোলা ঝুলবে। ভাড়া নিয়ে ঝগড়া বাধবে। গ্রামের মানুষ ধান, পাট, সবজির একটি হিস্যা ফড়িয়াদের দেবেই। ফলে সচ্ছলতার স্বাদ কোনো দিন পাবে না। তাই গেল বছর-এ বছর-সে বছর-সবই আমাদের সমান।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.