চরাচর-মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা by সাইফুল ইসলাম

মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে মনে রাখতে পারে অতীতের কথা। অতীতের কথা ভেবেই সে আজকের কাজ করে এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে; কর্মপরিকল্পনা করে। গতকালের অপচয়ের ফলে আজকে যখন তাকে না খেয়ে থাকতে হয়, তখন তা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। বর্তমানে অপচয় রোধে সচেষ্ট হয়, চেষ্টা করে আগামীকালের জন্য কিছু সম্পদ জমিয়ে রাখতে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ভাবতে পারে বলেই মানুষের মধ্যে সেই আদিকাল থেকেই গড়ে উঠেছে সঞ্চয়ের প্রবণতা।


একসময় মানুষের উদরপূর্তির একমাত্র উপায় ছিল পশু শিকার করে মাংস আর বনের ফল আহরণ করে খাওয়া। কিন্তু এ দুটোই পচনশীল দ্রব্য। এমনকি এক দিন বা দুই দিনের বেশি জমিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না আগুনে ঝলঝানো মাংসও। আর শিকারে পাওয়া মাংস ফুরিয়ে যাওয়া মানেই পরবর্তী শিকার না পাওয়া পর্যন্ত অনাহার। ফলে উদরপূর্তির চিন্তা থেকেই মানুষের মাথায় ঢুকল সংরক্ষণচিন্তা, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়চিন্তা। শুরু হলো সূর্যের তাপে মাংস শুঁটকি করা। কিন্তু তাতে যে সঞ্চয় হলো, তা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। এ কারণে শিকারকে জীবিত আটকে রাখার চিন্তা মানুষের মাথায় এল। বন্য প্রাণীকে শিকারের সঙ্গে সঙ্গেই বলি না দিয়ে বাড়তিগুলোকে বেঁধে রাখা শুরু হলো মানুষের ডেরার আঙ্গিনায়। এতে মানুষ দেখতে পেল যে কিছু কিছু বন্য পশু ছাড়া পেলেও চলে যায় না আঙ্গিনা ছেড়ে; মানে ওইসব পশু তত দিনে পোষ মানতে শুরু করেছে। এ থেকেই মানুষ শুরু করল পশুপালন। মানবজাতি এ পর্যায়েই শুরু করে কৃষিকাজও। পশুপালন আর কৃষিকাজ মানুষের সামনে সঞ্চয়ের অর্থাৎ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য খুলে দিল নতুন দুয়ার। পশু সঞ্চিত হতে লাগল চারণভূমিতে। ধান সংরক্ষণ করতে সৃষ্টি হলো গোলাঘর ও বড় বড় গুদামঘর। চাল, ডাল, কলাই তুলে রাখতে তৈরি করা হলো জালা, মটকি, বেড়, ডোল ইত্যাদি বড় পাত্র। পশুখাদ্য পালা বা স্তূপ করে রাখা হলো বাড়ির আঙ্গিনায়। একসময় মানুষের হাতে অনেক কিছুই উদ্বৃত্ত হতে লাগল। তখন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল ওইসব দ্রব্যের হাতবদলের। শুরু হলো বিনিময়প্রথা। আর বিনিময়কে আরো সহজতর করতে মানুষ প্রচলন ঘটাল মুদ্রার, যা যেকোনো জিনিসের বিনিময়ের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। সব পাওয়ার জিনিস এই মুদ্রা এলেও কিন্তু মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা এতটুকুও কমল না, বরং সঞ্চয় পেল ভিন্ন্ন মাত্রা। গড়ে উঠল ব্যাংক। ব্যাংকগুলো স্লোগান জুড়ে দিল, চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না, তা হলেই হারিয়ে যাবে; মানে খরচ হয়ে যাবে। সঞ্চয়ী হিসাবে দেওয়া হতে লাগল মুনাফা, লোভনীয় ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রলোভন। কেউ কেউ মাটির ব্যাংক বা বাঁশের খোলে ধাতব মুদ্রা জমা করলেও তা দ্রুত চলে যেতে লাগল ব্যাংকে। ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলো সামাজিক সঞ্চয়ের ধোয়া তুলে গ্রামীণ সঞ্চয় কাঠামোকে ভেঙে তছনছ করে দিল, সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে তুলে নিল নিজেদের হাতে। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় এসব প্রতিষ্ঠানের পুঁজিতে রূপান্তরিত হলো। শহর-নগরে এসব প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবন গড়ে উঠল, বাড়ল নগরের চাকচিক্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের সে সঞ্চয় সাধারণের রইল কি না তা কেউ জানে না। ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান, হারিয়ে যাওয়ার পথেও রয়েছে কোনো কোনো সংগঠন। এভাবেই মানুষের সঞ্চয় অর্থাৎ স্বপ্ন এখনো ছিনিয়ে নিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তাদের কর্মপদ্ধতি নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করলেও থেমে নেই তাদের কাজ। আর এটা সহজেই সম্ভ্ভব হয়, কারণ মানুষ স্বপ্ন্ন দেখতে পছন্দ করে, স্বপ্নের জাল বুনতে ভালোবাসে। এমনকি প্রতারণার ফাঁদে পড়েও মানুষ সঞ্চয় করে। তবে একসময় মানুষ প্রতারণার ফাঁদ ভাঙার স্বপ্নও সঞ্চয় করবে নিশ্চয়ই।
সাইফুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.