মহাজোট সরকারের ৩ বছর-মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ হোক by ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর ঢেউ আঘাত হেনেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। গ্রিস ও ইতালির অর্থনীতি প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে স্পেন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রে বিরাজ করছে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব। অর্থনীতি সামাল দিতে সে দেশের সরকার ঘোষণা করেছে প্যাকেজ। বলা হচ্ছে, সাড়ে চার লাখ ডলার খরচ করে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে আমেরিকার সিটিজেনশিপ দেওয়া হবে। উন্নত বিশ্বের এ
ধরনের বেসামাল অবস্থায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি আরো ভয়াবহ হওয়ার কথা। কিন্তু এ রকম আশঙ্কা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। একটি দেশের অর্থনীতিকে তখনই 'বিপর্যয়কর' বলা যায়, যখন সে দেশের রপ্তানি খাতে ধস নামে। বাংলাদেশের জন্য আশার বিষয় হলো, এখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আগের বছরের দ্বিগুণ হয়েছে এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি।
দেশের রপ্তানি খাতকে সচল রাখার জন্য সবার আগে প্রয়োজন জ্বালানি খাতকে সচল রাখা। নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যেমন প্রয়োজন স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, তেমনই প্রয়োজন জ্বালানি উপকরণের প্রাচুর্য। বাংলাদেশের ভূমির নিচে খনিজ তেল নেই। আছে গ্যাস ও কয়লার মতো জ্বালানি উপকরণ। কিন্তু এ দুটি উপকরণ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা আমাদের ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে। বড়পুকুরিয়ার বিপুল কয়লাভাণ্ডার আমরা ব্যবহার করতে পারছি না, কিভাবে উত্তোলন করব সেই সিদ্ধান্তে আসতে না পারায়। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি নামের একটি সংগঠন পণ করে বসে আছে মাটির নিচের খনিজ মাটির নিচে ফেলে রাখতে। গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে তারা উন্নয়ন সহযোগী দেশের কোনো কম্পানির অংশগ্রহণ মেনে নিতে চায় না। তাদের কথা হলো, সমুদ্রের তলদেশে বা পাহাড়ের পাদদেশে-যেখানেই গ্যাস থাকুক না কেন, তা উত্তোলন করবে একমাত্র বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বাপেক্স)। প্রশ্ন হলো, সমুদ্রের তলদেশ থেকে বাপেঙ্রে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা আছে কি না। স্থলভাগ থেকে গ্যাস উত্তোলন যতটা সহজ, সমুদ্রের তলদেশ থেকে উত্তোলন ততটাই কঠিন। এর জন্য যে পরিমাণ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, তার কিছুই নেই বাপেঙ্রে কাছে। সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস ফেলে রেখে লোডশেডিংয়ের নামে দেশকে অন্ধকার রাখা, শিল্প-কারখানার চাকা বন্ধ করে রপ্তানি খাতে ধস নামানো, দেশকে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর করে তোলা কোনো কাজের কথা নয়। তাই বিদেশি কম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন এবং সঠিক পদ্ধতিতে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে সরকার চাইছে দেশের জ্বালানি খাতকে সচল রাখতে। কিন্তু এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া প্রয়োজন, সময়েরও প্রয়োজন। আমদানিনির্ভরতা কমাতে, রপ্তানি আয় বজায় রাখতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে। বাংলাদেশে গত তিন বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এক হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট।
আজ থেকে তিন বছর আগে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াটে পেঁৗছবে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ঘাটতিও বেড়েছে। এটা হয়েছে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। একটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন অর্থনীতি স্থির না থেকে গতিশীল হয়। আজকাল অনেক অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ইলেকট্রনিক মিডিয়া আয়োজিত টকশোতে সোজাসাপটাই বলেন, 'দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে নিপতিত।' কোন সূচকে বাংলাদেশ গভীর সংকটে পড়ল এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই বলছেন না। তাঁদের বোঝা দরকার, গত তিন বছরে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও কেন এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক হিসাবেই বলা চলে, শিল্পোৎপাদন অব্যাহত থাকার কারণেই বিদ্যুতের এ ঘাটতি না কমে বরং বেড়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন যে স্বাভাবিক নিয়মে চলছে এবং কৃষি অর্থনীতি ও শিল্পোৎপাদনে যে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক 'জিডিপি' হারের দিকে তাকালে। যদিও জিডিপি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র সূচক নয়, তবুও বিশ্বের সব দেশেই জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সূচক। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সাত অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত তিন বছরে জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি ছয় থেকে সাতে পেঁৗছেছে। এটি একটি বিশাল অর্জন। দেশের অর্থনীতি যদি স্থবির থাকত, অর্থনৈতিক সূচকে যদি অচলাবস্থা বিরাজ করত, তাহলে জিডিপি ছয় থেকে সাতের ঘরে উন্নীত হতো না। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি করতে পেরেছে কৃষি উন্নয়নে সর্বাধিক নজর দিয়ে। খাদ্য সমস্যা বরাবরই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ইত্যাদি বাবদ বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তার বেশির ভাগই ব্যয় হয় খাদ্য আমদানিতে। দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে কমবেশি ১৬ কোটি। দৈনিক ৪৮ কোটি বার খাবার গ্রহণ করে এ দেশের মানুষ। সীমিত সম্পদ ও কঠিন দারিদ্র্য নিয়ে যেকোনো সরকারের পক্ষেই এ সমস্যা মোকাবিলা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। গত তিন বছর সরকার এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে সঠিকভাবেই। যার ফলে উত্তরবঙ্গের নিত্য বছরের 'মঙ্গা' শব্দটি এখন বাস্তব থেকে ডিকশনারিতে স্থান নিয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় গত তিন বছরে দেশে বাম্পার ফলন হয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা মতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট তিন কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে দেশে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৯০ লাখ টন। সে হিসাবে তিন বছরে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৭০ লাখ টন। অর্থাৎ বছরে বেড়েছে ২৩ লাখ টনেরও বেশি। বছরে ২৩ লাখ টন বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদন সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, দেশে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। এখানেও পরিসংখ্যানের আশ্রয় না নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে।
এ দেশের জনগণের জন্য আশার বিষয় হলো, গত তিন বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে কম। এসকাপের এক গবেষণায় দেখে গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে মূল্যস্ফীতি ৭.৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫.৫ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৯.৫ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৭.২ শতাংশ, যা ২০১১ সালে ছিল ৭.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এক বছরে মূল্যস্ফীতি দশমিক এক শতাংশ হলেও কমেছে।
শ্রমিক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে। এ দেশের প্রায় ৭০ লাখ প্রবাসী প্রতিবছর এক হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, যা প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প থেকেও বেশি। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বছরে পাঁচ লাখ শ্রমিক রপ্তানি নিতান্ত কম নয়। রেমিট্যান্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত এক বছরে ৯০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
সুতরাং দেশের অর্থনীতি নাজুক ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে-কিছু বুদ্ধিজীবীর পরিসংখ্যানহীন এমন তথ্য দেওয়ার আগে দেশ যে স্থির না থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে তথ্যও দেওয়া দরকার। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় দেশ যে সঠিক পথে এগোচ্ছে, এ সত্যটি এখন জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার। বর্তমান সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে না পারলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার যে দেশের কল্যাণে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে, এটি কারো কাছে অস্পষ্ট নয়। আজকাল বাংলাদেশের মানুষের প্রজ্ঞা, বিবেচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা বহু বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার দিন শেষ।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের রপ্তানি খাতকে সচল রাখার জন্য সবার আগে প্রয়োজন জ্বালানি খাতকে সচল রাখা। নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যেমন প্রয়োজন স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, তেমনই প্রয়োজন জ্বালানি উপকরণের প্রাচুর্য। বাংলাদেশের ভূমির নিচে খনিজ তেল নেই। আছে গ্যাস ও কয়লার মতো জ্বালানি উপকরণ। কিন্তু এ দুটি উপকরণ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা আমাদের ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে। বড়পুকুরিয়ার বিপুল কয়লাভাণ্ডার আমরা ব্যবহার করতে পারছি না, কিভাবে উত্তোলন করব সেই সিদ্ধান্তে আসতে না পারায়। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি নামের একটি সংগঠন পণ করে বসে আছে মাটির নিচের খনিজ মাটির নিচে ফেলে রাখতে। গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে তারা উন্নয়ন সহযোগী দেশের কোনো কম্পানির অংশগ্রহণ মেনে নিতে চায় না। তাদের কথা হলো, সমুদ্রের তলদেশে বা পাহাড়ের পাদদেশে-যেখানেই গ্যাস থাকুক না কেন, তা উত্তোলন করবে একমাত্র বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বাপেক্স)। প্রশ্ন হলো, সমুদ্রের তলদেশ থেকে বাপেঙ্রে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা আছে কি না। স্থলভাগ থেকে গ্যাস উত্তোলন যতটা সহজ, সমুদ্রের তলদেশ থেকে উত্তোলন ততটাই কঠিন। এর জন্য যে পরিমাণ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, তার কিছুই নেই বাপেঙ্রে কাছে। সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস ফেলে রেখে লোডশেডিংয়ের নামে দেশকে অন্ধকার রাখা, শিল্প-কারখানার চাকা বন্ধ করে রপ্তানি খাতে ধস নামানো, দেশকে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর করে তোলা কোনো কাজের কথা নয়। তাই বিদেশি কম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন এবং সঠিক পদ্ধতিতে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে সরকার চাইছে দেশের জ্বালানি খাতকে সচল রাখতে। কিন্তু এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া প্রয়োজন, সময়েরও প্রয়োজন। আমদানিনির্ভরতা কমাতে, রপ্তানি আয় বজায় রাখতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে। বাংলাদেশে গত তিন বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এক হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট।
আজ থেকে তিন বছর আগে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াটে পেঁৗছবে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ঘাটতিও বেড়েছে। এটা হয়েছে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। একটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন অর্থনীতি স্থির না থেকে গতিশীল হয়। আজকাল অনেক অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ইলেকট্রনিক মিডিয়া আয়োজিত টকশোতে সোজাসাপটাই বলেন, 'দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে নিপতিত।' কোন সূচকে বাংলাদেশ গভীর সংকটে পড়ল এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই বলছেন না। তাঁদের বোঝা দরকার, গত তিন বছরে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও কেন এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক হিসাবেই বলা চলে, শিল্পোৎপাদন অব্যাহত থাকার কারণেই বিদ্যুতের এ ঘাটতি না কমে বরং বেড়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন যে স্বাভাবিক নিয়মে চলছে এবং কৃষি অর্থনীতি ও শিল্পোৎপাদনে যে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক 'জিডিপি' হারের দিকে তাকালে। যদিও জিডিপি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র সূচক নয়, তবুও বিশ্বের সব দেশেই জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সূচক। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সাত অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত তিন বছরে জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি ছয় থেকে সাতে পেঁৗছেছে। এটি একটি বিশাল অর্জন। দেশের অর্থনীতি যদি স্থবির থাকত, অর্থনৈতিক সূচকে যদি অচলাবস্থা বিরাজ করত, তাহলে জিডিপি ছয় থেকে সাতের ঘরে উন্নীত হতো না। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি করতে পেরেছে কৃষি উন্নয়নে সর্বাধিক নজর দিয়ে। খাদ্য সমস্যা বরাবরই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ইত্যাদি বাবদ বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তার বেশির ভাগই ব্যয় হয় খাদ্য আমদানিতে। দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে কমবেশি ১৬ কোটি। দৈনিক ৪৮ কোটি বার খাবার গ্রহণ করে এ দেশের মানুষ। সীমিত সম্পদ ও কঠিন দারিদ্র্য নিয়ে যেকোনো সরকারের পক্ষেই এ সমস্যা মোকাবিলা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। গত তিন বছর সরকার এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে সঠিকভাবেই। যার ফলে উত্তরবঙ্গের নিত্য বছরের 'মঙ্গা' শব্দটি এখন বাস্তব থেকে ডিকশনারিতে স্থান নিয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় গত তিন বছরে দেশে বাম্পার ফলন হয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা মতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট তিন কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে দেশে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৯০ লাখ টন। সে হিসাবে তিন বছরে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৭০ লাখ টন। অর্থাৎ বছরে বেড়েছে ২৩ লাখ টনেরও বেশি। বছরে ২৩ লাখ টন বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদন সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, দেশে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। এখানেও পরিসংখ্যানের আশ্রয় না নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে।
এ দেশের জনগণের জন্য আশার বিষয় হলো, গত তিন বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে কম। এসকাপের এক গবেষণায় দেখে গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে মূল্যস্ফীতি ৭.৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫.৫ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৯.৫ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৭.২ শতাংশ, যা ২০১১ সালে ছিল ৭.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এক বছরে মূল্যস্ফীতি দশমিক এক শতাংশ হলেও কমেছে।
শ্রমিক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে। এ দেশের প্রায় ৭০ লাখ প্রবাসী প্রতিবছর এক হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, যা প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প থেকেও বেশি। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বছরে পাঁচ লাখ শ্রমিক রপ্তানি নিতান্ত কম নয়। রেমিট্যান্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত এক বছরে ৯০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
সুতরাং দেশের অর্থনীতি নাজুক ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে-কিছু বুদ্ধিজীবীর পরিসংখ্যানহীন এমন তথ্য দেওয়ার আগে দেশ যে স্থির না থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে তথ্যও দেওয়া দরকার। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় দেশ যে সঠিক পথে এগোচ্ছে, এ সত্যটি এখন জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার। বর্তমান সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে না পারলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার যে দেশের কল্যাণে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে, এটি কারো কাছে অস্পষ্ট নয়। আজকাল বাংলাদেশের মানুষের প্রজ্ঞা, বিবেচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা বহু বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার দিন শেষ।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments