কিডনি প্রতিস্থাপন ॥ রেকর্ড সাফল্য বাংলাদেশে- ৬০১টি কিডনি প্রতিস্থাপন by নিখিল মানখিন
আর নয় বিদেশে, দেশেই স্বল্প খরচে নিরাপদ কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চলছে একের পর এক কিডনি প্রতিস্থাপন।
দেশে এ পর্যন্ত ৬০১টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোন রেকর্ড নেই। এ সব প্রতিষ্ঠানে প্রতিস্থাপিত কিডনি নিয়ে অনেক মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে আছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন। কিডনি প্রতিস্থাপিত দীর্ঘদিন ধরে সাফল্য দেখিয়ে আসছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। নামমাত্র এক লাখ টাকা প্যাকেজে এখানে করা হয় কিডনি প্রতিস্থাপন। এক লাখ টাকা প্যাকেজের বাইরে রোগী ও কিডনিদাতার তাৎণিক পরীার জন্য জমা রাখতে হয় ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দেড় লাখ টাকার মতো খরচ পড়ে। একই চিকিৎসা বিদেশে করাতে হলে ব্যয় হয় ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দেশে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন চালু রয়েছে। মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজনের প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাতা স্বল্পতা এবং ওষুধের উচ্চমূল্যের কারণে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের মাত্রা কম হয়ে থাকে বলে অভিযোগ তুলেছেন কিডনি বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি তাঁরা কিডনি চিকিৎসার ওষুধ আমদানি কর উঠিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন জানান।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি সংযোজন পরবর্তী চিকিৎসার অংশ হিসাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালে এসেছেন বগুড়া সদর থানার সুলতানা বেগম (৩৮)। তাঁর সঙ্গে রয়েছে প্রিয় সনত্মান মোঃ সাদ্দাম হোসেন (১৮)। দু'টি কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে সাদ্দামের জন্য একটি কিডনি দেন মা সুলতানা বেগম। ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর মায়ের দেয়া কিডনি প্রতিস্থাপিত করা হয় সাদ্দামের শরীরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ শহীদুল ইসলাম সেলিমের অফিসক েবসে আলাপ হয় সুলতানা বেগম ও তাঁর ছেলে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে। সুলতানা বেগম জনকণ্ঠকে জানান, সনত্মানকে বাম পাশের কিডনি দিয়েছি আমি। কিডনি দেয়ার প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেছে। দেখা দেয়নি কোন পাশর্্বপতিক্রিয়া। স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছি। ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্যাকেজ এবং প্রতিস্থাপন পরবর্তী ওষুধের খরচসহ ৩ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে বলে তিনি জানান। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে বলে হাসিমুখে জানায় সুলতানার ছেলে সাদ্দাম হোসেন।
দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের সফলতার চিত্র তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিভাগের চিকিৎসকরা। তাঁরা জানান, মৃত ব্যক্তি ও জীবিত নিকটাত্মীয়ের যেকোন একটি কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। দেশে বর্তমানে শুধুমাত্র জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। রোগীর কিডনি দু'টি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট, সনোগ্রাম করে কিডনি অবস্থান ও সাইজ দেখা, জিএফআর অথবা সিআর ইত্যাদি পরীা করে কিডনি অকেজো নির্ণয় করা হয়। কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো জানার পরই ডায়ালাইসিস করার সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়। পেরিটোনিয়েল ডায়ালাইসিস ও হিমোডায়ালাইসিস_এ দু'ধরনের ডায়ালাইসিসের প্রচলন রয়েছে। তবে হিমোডায়ালাইসিস শুরম্ন করার পূর্বে সাধারণত বাম হাতের কব্জির উপরে একটি এ-ভি ফিস্টুলা তৈরি করে নেয়া হয় যা পরিপক্ব হতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। হিমোডায়ালাইসিস বা মেশিনের পাশাপাশি রোগীকে ও তাঁর নিকট পরিজনকে রোগ সম্পর্কে ধারণা, চিকিৎসার ভবিষ্যত পরিকল্পনা, সুযোগ-সুবিধা এবং আর্থিক দিক সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হয়। একজন রোগীকে সব দিক বিবেচনা করে যখন কিডনি প্রতিস্থাপন কর্মসূচীতে মনোনীত করা হয় তখন সেই রোগীকে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিভাগের চিকিৎসকরা আরও জানান, দেশে বর্তমানে শুধুমাত্র জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেফ্রোলজি, ইউরোলজি ও এ্যানেস্থেসিওলোজি বিভাগের সমন্বয়ে প্রতি সপ্তাহে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। এছাড়া কিডনি ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল এবং সম্প্রতি ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন চলছে। এ পর্যনত্ম বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬৫টি, কিডনি ফাউন্ডেশনে ১৪৭টি, বারডেমে ৫০টি, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৩টি এবং ন্যাশনাল কিডনি ইনস্টিটিউটে ১৬টি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে চলে আসছে। এ পর্যনত্ম কিডনিদাতা ও রোগী কোন ধরনের সমস্যায় পড়েননি। এ কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ কোন টাকা গ্রহণ করে না। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরি করা হয় ১ লাখ টাকার প্যাকেজ। এক লাখ টাকা প্যাকেজের বাইরে রোগী ও কিডনিদাতার তাৎণিক পরীার জন্য জমা রাখতে হয় ২৫ হাজার টাকা। কিডনি দাতা পাওয়া না গেলে ডায়ালাইসিস চালু রাখতে হয়। এ জন্য বছরে ১ থেকে দেড় লাখ ব্যয় হয়। আর প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। কিডনিদাতার ব্যাপারে তিনি বলেন, আত্মীয় ছাড়া কিডনিদান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের উপরে এবং ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। আর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দু'টি কিডনিই সম্পূর্ণভাবে ভাল থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনিদান করতে হবে, জোর জবরদসত্মি করা চলবে না। কিডনিদাতার পরীা করে সব কিছু নিরাপদ জেনেই তার একটি কিডনি নেয়া হয় এবং একটি কিডনি নিয়েই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে স্বল্পসংখ্যক কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রধান অনত্মরায় নিকটাত্মীয় কিডনি স্বল্পতা। কাজেই কিডনিদাতার স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে হলে মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা ও শিার প্রসার ঘটাতে হবে। দাতাস্বল্পতা এবং ওষুধের উচ্চমূল্যের কারণে দেশে কিডনি সংযোজনের মাত্রা কম হয়ে থাকে বলে পাশাপাশি তাঁরা কিডনি চিকিৎসার ওষুধ আমদানি কর উঠিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন জানান অধ্যাপক ডা. মোঃ শহিদুল ইসলাম।
No comments