চালচিত্র-সম্ভাব্য দু'টি ঝড়ের চোখ গুপ্তহত্যা ও তত্ত্বাবধায়ক by শুভ রহমান
ইংরেজি সাল ২০১২-এর যেমন শুরু, তেমনি সরকারের শেষ দুই বছরেরও সূচনা। পুরনো বছর যেমনই গেছে যাক, নতুন বছরটা যেন আরো ভালো যায়-এটাই তো সবার মনস্কামনা। আর সরকারের তো একটা মাথাব্যথাই, শেষ দুটো বছর যেন বৃথা না যায়, যেন নিষ্ফল না হয়। কিন্তু দুটো প্রত্যাশারই আসল ভিত্তিটা কি রচিত হয়েছে দেশে? রাতারাতি তো কোনো কিছুই বদলায় না। মন্ত্রী রদবদল, মন্ত্রণালয় ভাঙাগড়া, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাঙা-পুরনো বছরের শেষদিকে এসে এ
রকম সংস্কার নতুন বছরে কী ফল দেয়, আদৌ ফলপ্রসূ হয় কি না, তা দেখতে সময় লাগবে বৈকি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে মানুষের ভাবনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আর গুম-খুন। যুদ্ধাপরাধের বিচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি-এসব নিয়ে গেল বছরের জের চলছে, তাগিদ আছে একটা হেস্তনেস্ত করার, সরকারের একাংশের, জনমনেরও।
রাজনীতির ধারায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি নতুন বছরেও; যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও শাসক দলের বিরোধী অন্য কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক সংলাপ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগের সাফল্য নিয়ে বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেমন আশাবাদী নন, তেমনি অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর প্রায় সবাই মূলত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানাতেই সংলাপে অংশ নিচ্ছে। সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিটিকে ঐক্যবদ্ধ রূপ দেওয়া ও জোরদার করাই যেন তাদের লক্ষ্য। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, একটা নিম্নচাপ ঘনীভূত হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক আর গুপ্তহত্যাকে কেন্দ্র করে। রাজনীতিতে এ দুটো ইস্যুই যেন আসন্ন ঝড়ের চোখ। ইতিমধ্যে ১২টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। এ মাসের ১১ তারিখে সংলাপে যাবে বিএনপি, ১২ তারিখে আওয়ামী লীগ। কোনো কোনো দল কমিশন গঠনে নতুন আইন প্রণয়ন ও অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ওপরও জোর দিয়েছে। শাসক দল আওয়ামী লীগও হয়তো শেষ পর্যন্ত মনে মনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে, শুধু এ প্রশ্নে এখন একটা গণতান্ত্রিক এঙ্ারসাইজ করে দাবিটি মেনে নেবে, অনেক বিশ্লেষকের এমনই ধারণা। সাধারণ মানুষ বস্তুত এ প্রশ্নে একটা জাতীয় ঐকমত্যই চায়। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক রাষ্ট্রপতি যেন বিতর্কিত না হন, সে জন্য তাঁর সংলাপ উদ্যোগের সফল পরিসমাপ্তি ঘটুক, দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রমনা সব নাগরিকের এটাই ঐকান্তিক কামনা।
সারা দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে আরো এ জন্য ভাবছে যে এ প্রশ্নে জাতি যেন একটা সংঘাতময় ও রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত না হয়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হোক-এটাই মোদ্দা কথা। ১৯৯৬-এ তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবি ছিল-তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হতে হবে, তা না হলে সাধারণ নির্বাচনে মাগুরা উপনির্বাচনের মতো কারচুপি ঠেকানো যাবে না এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত হবে না। তখন আওয়ামী লীগের সে দাবি সাধারণ মানুষ তাদের সদ্য মাগুরা উপনির্বাচনের লোমহর্ষক কারচুপির অভিজ্ঞতা থেকে মেনে নিয়েছিল। একটা গণ-অভ্যুত্থানই ঘটিয়ে দিয়েছিল মানুষ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে। পাগল ও শিশু ছাড়া নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই, এমন যুক্তি দিয়ে প্রশাসনের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রক্তপাত ঘটিয়েও তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি সে দাবি রুখতে পারেনি। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাতারাতি সে দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন দিতে হয়েছিল তাদের। সেই তারাই এখন এ দাবি আদায় করতে দেশজুড়ে রোডমার্চের পর রোডমার্চ করছে। বলছে, কোনোক্রমেই দলীয় বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। হাইকোর্টের 'অসম্পূর্ণ' রায়েও আরো দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অসম্পূর্ণ রায় সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে শাসক মহাজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে একতরফাভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়ে নিয়েছে। বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত থাকার দায়টা গায়ে না মেখে রাজপথে আন্দোলন করেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায় করতে চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি যদি শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়ও, তবু বিএনপির তাতে গৌরব বৃদ্ধি পাবে না। বরং সংঘাত ও রক্তক্ষয় এড়াতে এবং একটি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শাসক আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল মনোভাব প্রদর্শনই জয়যুক্ত ও প্রশংসিত হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগই তার ডিভিডেন্ড পাবে।
সাধারণ মানুষ বস্তুত একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রশংসিত এবং সর্বাংশে গণতান্ত্রিক ও অর্থবহ নির্বাচনেরই নিশ্চয়তা চায়। তার ভোটটি কাজে লাগুক, এটাই তার একমাত্র আন্তরিক কামনা। সাধারণ মানুষের স্বার্থ আর অন্য কিছুতে নেই।
গুম-খুন
সাধারণ মানুষ দেশে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান গুম-খুন ও মানুষের অব্যাখ্যাত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনারও ত্বরিত অবসান ও প্রতিকার চায়। জনমনে ত্রাস সৃষ্টিকারী ও একেকটি পরিবারকে চরম অসহায়ত্ব ও দুর্যোগের মধ্যে নিক্ষেপকারী প্রতিকারহীন যে গুপ্তহত্যা আর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে, তা যদি এ মুহূর্তে বন্ধ না করা যায়, শাসক মহাজোটের জন্য তা সত্যিই এক মহা অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াবে। শাসক দলের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ, কোনো একটি ক্ষেত্রেও রহস্য উদ্ঘাটনের বাস্তব তৎপরতা সাধারণ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। এ ধরনের ভয়াবহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঘটতে পারে না। ইতিহাসে এ-জাতীয় গুপ্তহত্যা কেবল ফ্যাসিস্ট ও চরম অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ই পরিদৃষ্ট হয়েছে। রাশিয়ায় জারের আমলে ব্ল্যাক হ্যান্ড্রেডস, স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট শাসনামলে ফালাঙ্গি বাহিনী (তরুণ কবি লোবকাকে যারা অপহরণ ও গুম করেছিল), ইরানে শাহের রাজতন্ত্রে সাবাক বাহিনী, জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে সভ্যতার দুশমন হিটলারের নাৎসি শাসনামলে গেস্টাপো, ব্রাউন টেরর, এসএস এবং ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনামলে ব্ল্যাকশার্ট, আমেরিকায় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের ক্লু ক্লাঙ্ ক্ল্যান, আর আমাদের এ ভূখণ্ডে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে মুখোশধারী সশস্ত্র আলবদর-রাজাকার-আলশামস বাহিনী নৃশংস গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রধানত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিধনই ছিল গুপ্তবাহিনী দিয়ে গুম-খুনের উদ্দেশ্য। আবার সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কখনো কখনো গুপ্তহত্যা চালানো হয়েছে। এখন, এই একবিংশ শতকের সভ্য এ গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃপ্ত অভিযাত্রায় শামিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে বিপুল গণম্যান্ডেটের অধিকারী মহাজোট সরকারের শাসনামলে গুপ্তহত্যা আর মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা নির্বিচারে ঘটে চলবে-এটা কারো কল্পনায়ও আসে না।
নতুন বছরে সাধারণ মানুষ বস্তুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর গুম খুন-দুটো প্রশ্নেই দ্রুততম সময়ে একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আশা করে। এ দুই প্রশ্নে শুধু যে আইনের শাসন হুমকির সম্মুখীন তা-ই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাসযোগ্যতা এবং গণতান্ত্রিক সত্তাই এতে একটা নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।
বছরের দৃপ্ত ও সফল অভিযাত্রা যেন এ দুই উদ্বেগজনক প্রশ্নের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির মধ্য দিয়েই সূচিত এবং নিশ্চিত হয়। যেন প্রখর গণতান্ত্রিক চেতনায় সব জরুরি জাতীয় প্রশ্নে দৃঢ় জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠে, সে জন্যই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
রাজনীতিকে হেয়প্রতিপন্ন করার, জনমানুষের বিপুল প্রত্যাশা ও গণম্যান্ডেটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থেকে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়েই গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক চতুর প্রয়াস এ সমাজে বারবারই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গেল বছরের শেষ দিকেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব দাবিকারী কিছু চেনামুখ তেমনিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে নতুন এক নাগরিক সংগঠনের পত্তন করেছে। অনেকে তার মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। খুব একটা জনসমর্থন না পেলেও তারা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহতই রেখেছে। গেল বছরের শেষপ্রান্তে তারা ফতোয়া দিয়েছে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রধান বাধা হচ্ছে প্রধান দুই দলের দ্বন্দ্ব-বিরোধ। আপাতনির্দোষ এ বক্তব্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। প্রধান দুই দলকেই নতুন বছরে সতর্ক থেকে কোনো অরাজনৈতিক-অনির্বাচিত শক্তির ছায়াপাত যেন রাজনীতিকে আবার রাহুগ্রস্ত না করে, তা রুখতে হবে।
তারপর যুদ্ধাপরাধের বিচার, অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শৃঙ্খলা আর সুস্থ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ধারা শাসক মহাজোটের অবশিষ্ট মেয়াদকে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সব দেশহিতৈষী কার্যক্রমকে গৌরবমণ্ডিত করে তুলুক।
০৪.০১.২০১২
No comments