মহাজোট সরকারের ৩ বছর-শেয়ার মার্কেট চিত্র by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

জানুয়ারি বর্তমান মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পূর্ণ হবে। সালতামামি করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতর হিসাব নেওয়া হবে। কোনো সরকারই একচ্ছত্র সাফল্য অর্জন করতে পারে না বা সম্ভবও নয়। অতএব সার্থকতা বা ব্যর্থতা নিয়ে কথা হবেই, বিশেষ করে প্রত্যক্ষভাবে যেসব কাজকর্মের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এই সরকারকে তীব্র সমালোচনা এবং আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছিল শেয়ার মার্কেট নিয়ে; অথচ শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে সরকারের
সরাসরি কোনো বন্ধন নেই। শেয়ার মার্কেট ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা দেখার দায়িত্ব সরকারি প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি)। শেয়ার কারা কিনবেন বা বিক্রি করবেন, এ ব্যাপারে সরকারি তরফ থেকে নির্দেশ বা পরামর্শ দেওয়া হয় না। সরকার শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে থাকে, যা অন্য ক্ষেত্রেও করা হয়; যেমন রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শেয়ারবাজারে ধস নামার ফলে বিনিয়োগকারীদের যে লোকসান হয়েছে, তার জন্য প্রায় এককভাবে সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে অতিকথন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর এ ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করে। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই শেয়ারবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর যে অঘটনটি ঘটল, তা হলো-শেয়ারবাজারে নেতৃত্বদানকারী কিছু সরকারদলীয় সমর্থক অর্থমন্ত্রী তথা সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেন। শেয়ারবাজার যেকোনো সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি মার্কেট, যেখানে শেয়ার লেনদেন হবে। এটির কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করার ক্ষমতা নেই। বেকারত্ব দূর করার জন্য তেমন একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। অথচ এমন একটা ধারণা দেওয়া হলো যে শেয়ারবাজার থেকে লাখো-কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে প্রবাহিত হবে এবং এখানে যাঁরাই বিনিয়োগ করতে আসবেন, তাঁরা প্রভূত মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসা কাল হয়েছে। ইতিমধ্যে আরো কিছু অনুঘটকের সৃষ্টি হয়েছে, যেমন-স্টক এক্সচেঞ্জের অনেক সদস্য ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তাঁদের অফিসের শাখা খুলে বসেন। এসব শাখায় প্রকৃত উপদেশ দেওয়ার তেমন কেউ ছিল না। শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হলে যে হিসাব-নিকাশ করতে হবে, কম্পানির এবং তাদের পরিচালকদের জন্ম-ইতিহাস জানতে হবে-এ ধরনের কোনো ধারণা পাওয়ার সুযোগ এসব শাখায় মোটেই নেই। ফলে বিভ্রান্তিকর প্রচার এবং শেয়ারবাজার সম্পর্কে ভুল চিত্র দেওয়ার ফলে যে ইউফোবিয়ার সৃষ্টি হলো তা আরো জোরদার হলো এসব শাখার মাধ্যমে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে তাদের পক্ষ থেকে কিছু ভুল হয়েছে। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়, কেননা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই কালচার দেখা যায় না। এখন আমরা কিছু তথ্য উপস্থাপন করলে বুঝতে পারব যে এসব কর্মকাণ্ডের ফলে শেয়ারবাজার কিভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর এ ধরনের উত্থান হলে পতন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ২০০৯ সালে নির্বাচিত সরকার আসার আগমুহূর্তে মূল্যসূচক ছিল ২৭০৬। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে তা এসে দাঁড়ায় ৪৪১৫ পয়েন্টে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সূচক আর কখনো তেমন একটা কমেনি এবং অব্যাহতভাবে বাড়তে বাড়তে ৫ ডিসেম্বর ২০১০-এ এসে দাঁড়ায় ৮৯১৮ পয়েন্টে। এবার দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০৯-এর ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৫১ কোটি টাকা। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে দৈনিক লেনদেনে সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এদিন লেনদেন হয়েছিল ৩১৮০ কোটি টাকা। ওপরের তথ্য দেখার পর আর এ কথা বলার প্রয়োজন হয় না যে একটা উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। এর পরে যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। শেয়ারবাজারে ধস নামতে শুরু করল। নিরীহ বিনিয়োগকারী কাম শেয়ার ব্যবসায়ী-যাঁরা অতি উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে আসছিলেন, তাঁরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করলেন। আজকাল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক-দুই মিডিয়াই শেয়ারবাজারের রিপোর্ট কাভার করতে সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রচারেরও সুযোগ রয়েছে। প্রথম যেদিন খুব বড় ধরনের ধস নামে, সেদিন আমি একটি টেলিভিশনকেন্দ্রে একটি প্রোগ্রামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাদের বোধ হয় মধ্যপ্রাচ্যের টেলিভিশন আলজাজিরার সঙ্গে একটা সংযোগ রয়েছে। তাদের কাউকে বলতে শুনলাম, আলজাজিরা টিভিতে এই বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিবিসি টিভিতেও তা দেখানো হয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। তাদের এটা করা স্বাভাবিক। কিন্তু মহাজোটেরও কিছু কিছু শরিক দল বিক্ষোভকারীদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। সরকার যে দাবিটি করতে পারে এবং যা সত্য তা হলো, সঙ্গে সঙ্গে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এবং অবস্থার উন্নতির জন্য এগিয়ে এসেছে। গত ২০১০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকেই শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য বিশিষ্ট ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি মোটামুটি যুক্তিসংগত সময়ের ভেতর একটি মূল্যবান প্রতিবেদন দাখিল করে। এত কিছুর পরও যখন বাজারে স্থিতিশীলতা আসছিল না, তখন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন এবং প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ২৩ নভেম্বর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তিন রকমের প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে-স্বল্পমেয়াদি ও এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ (তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য) এবং দীর্ঘমেয়াদি, যা চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য। আশু বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলোর ভেতর যেগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে তার ভেতর রয়েছে-১. শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কম্পানির অনুকূলে ব্যাংক প্রদত্ত মূলধন ওই ব্যাংকের এঙ্পোজার টু ক্যাপিটাল মার্কেট হিসেবে গণ্য হবে না। ২. কোনো কম্পানির শেয়ারে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট ওই ব্যাংকের ক্যাপিটাল মার্কেট এঙ্পোজার হিসেবে গণ্য হবে না। ৩. বৈদেশিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে বিদেশি ব্রোকারেজ ফার্মকে প্রদেয় কমিশন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অথবা দলিলাদি দাখিল সাপেক্ষে দ্রুত প্রেরণের অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফলে বিদেশি পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপকরাও আরো বেশি তহবিল বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন। ৪. বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক এবং অনিবাসী (নন রেসিডেন্ট) বাংলাদেশিদের পুঁজিবাজারের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ ক্যাপিটাল গেইন ট্যাঙ্ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং বিদেশি তহবিলের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। ৫. শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত কোনো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি কম্পানির অনুকূলে প্রদত্ত ঋণ সিঙ্গেল বয়েজার এঙ্পোজার লিমিট অতিক্রম করে থাকলে সীমাতিরিক্ত ঋণ সমন্বয়ের জন্য দুই বছর সময় পাবে (২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত)। ৬. বীমা তহবিলের (লাইফ ও নন লাইফ) বিনিয়োগযোগ্য অর্থ অবিলম্বে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বীমা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া সরকার বীমা শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। ৭. শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সীমার নিচে রয়েছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসইসি কম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের ওই সীমা সব সময়ের জন্য নূ্যনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মধ্যমেয়াদি প্রস্তাবের ভেতর উল্লেখ করা হয়েছে যে করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন তৈরি করা হবে, যা দিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এখানে উল্লেখ্য, করপোরেট সুশাসন থাকলে তা সে তালিকাভুক্ত কম্পানি হোক কিংবা তালিকাবহির্ভূত হোক-সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অবশ্যই থাকবে। এখানে আরো বলা হয়েছে যে মার্চেন্ট ব্যাংক ও সাবসিডিয়ারি কম্পানিগুলোর নিজস্ব মূলধন বাড়াতে এসইসি সাহায্য করবে। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের ভেতর আইনের বিষয়গুলোর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে আইন যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনী আনা হবে। সেই সঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করতে হয়। তা হলো, কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যার জন্য কোনো কৈফিয়ত ও ব্যাখ্যা দিতে হবে না। এটি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। পরে সরকার অবস্থা বুঝে নতুন বাজেটে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। ইব্রাহিম খালেদের প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব করা হয়েছে। তা হলো, এসইসির উচ্চপর্যায়ে আমূল পরিবর্তন আনা। কেননা মনে করা হয় যে এসইসির সামগ্রিক অযোগ্যতা এবং কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। অবশ্য আমরাও লক্ষ করেছি যে এসইসি প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই ডিএসইর আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে এসেছে। ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টে কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী এবং তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। সরকার কালবিলম্ব না করে এসইসির আমূল পরিবর্তন এনেছে, নতুন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে জনগণ নতুন এসইসির যে ইমেজের প্রত্যাশা করেছিল, সে রকম হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত ছিল তাদের কেউ কেউ এখানে আছে। অর্থাৎ সেই সময় বিচার হলে আজ এ রকম হতো না।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.