সাদাকালো : মহাজোট সরকারের ৩ বছর-ভালোমন্দে কেটে গেল সময়টা by আহমদ রফিক
সমারোহে চলছে পত্রপত্রিকায় সালতামামি, চলছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আলোচনা (তাদের ভাষায় 'টকশো', কিন্তু আলোচনা বললে ক্ষতি কী। ঢাকা-কলকাতাজুড়ে টিভি উপস্থাপকদের কণ্ঠে শুনি 'একটা ব্রেক নিচ্ছি'-'বিরতি নিচ্ছি' বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়? ব্রেকের কর্কশতা থেকে 'বিরতি' শব্দটি তো অনেক নম্র ও সুশ্রী, তবুও...)। যাহোক, সব আলোচনারই মূল কথা, কেমন গেল বছরটা-রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বিচারে? আমাদের প্রতিটি বছরই তো যায়
ভালোমন্দে মিলে, হয়তো বিশ্বের সব দেশেই। আমার প্রথম আপত্তি বছরের হিসাবটা কেন বৈশাখ-চৈত্র ধরে হচ্ছে না, ক্রিশ্চীয় সাল থাকুক না দ্বিতীয় হয়ে। এদিক থেকে আমরা একটা নতুনত্ব তৈরি করি না কেন? আপাতত সে কথা যাক, জানি ওটা হওয়ার নয়। আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর একাংশই (সম্ভবত বড় অংশ) তাতে আপত্তি জানাবে, যদিও তারা বায়ান্ন থেকে একাত্তরের বাস্তবতা মেনে নিতে অস্বীকার করে না।
সালতামামির শুরুটা ইতিবাচকতায় বিচার করাই বোধ হয় সংগত। কারণ যুক্তিবাদীরা বলে থাকেন, আলোচনা-সমালোচনায় বিরূপতার বদলে ভিন্নমতের প্রকাশই উত্তম। সে হিসাবে বর্তমান সরকারের ইশতেহার-সূচির একটি বড় ঘোষণা ছিল প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার প্রত্যয়। এ খাতটিতে (হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব আগ্রহের কারণে) অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে ডিজিটাল তথ্যকোষ তৈরির প্রচেষ্টায়, এর প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে যেন আভাস পরিস্ফুট। দেশজ প্রযুক্তিতে তৈরি অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যে ল্যাপটপ নিঃসন্দেহে অগ্রসর পদক্ষেপ। এ দিকটায় নানা মাত্রায় ভালোই চলছে সরকারি তৎপরতা।
বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি (তা সত্ত্বেও ভোক্তাদের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ), কৃষি খাতে উন্নতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষা খাতে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি, সময়মতো পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের প্রত্যাশা পূরণ ইত্যাদি সন্দেহ নেই ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এর মধ্যেই সমস্যা তৈরি করেছে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন খাতে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা; যা গ্রাহক, ক্রেতা, ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার বলছে, ভর্তুকির চাপ এড়াতে এ মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু এ যুক্তি অর্থনীতিবিদ অনেকে মানতে নারাজ। এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা বারান্তরে করা যাবে। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দি্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে সর্বক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষ ধারায়। যদি ব্যক্তিগত পরিবহনের কথা বাদও দিই (এটাও গুরুত্বহীন নয়) তাহলেও সাধারণ পরিবহনে এর প্রভাব বহুমুখী, যেমন যাতায়াতে, তেমনি খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে, যা বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কারণ প্রতিদিনের জন্য দরকারি জিনিসপত্রের দাম যদি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে, তবে তা দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, সীমিত আয়ের মানুষ-সবার জন্য, আর বিত্তহীনদের তো কথাই নেই। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে ভোটদাতাদের বৃহত্তর অংশ এই শ্রেণীর মানুষ-বিত্তবান বা উচ্চবিত্তদের সংখ্যা কত শতাংশই বা। সরকার বিষয়টি আমলে আনছে না।
কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের মনোযোগের অভাব রয়েছে বলতে হয় এ কারণে যে আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির বাইরেও একেক সময় একেকটি বা একাধিক পণ্যের লাফিয়ে দাম বাড়ার পেছনে উচ্চশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফাবৃত্তির প্রবণতা ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা ওঠে-সয়াবিনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে একসময় কথাটা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীকুল মহানন্দে বণিজ্য করে চলেছে। এ ঘোড়দৌড়ের লাগামটা কী শক্ত হাতে ধরা যেত না? সরকারের ভবিষ্যৎ স্বার্থেই এটা নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার ছিল। এ বিষয়টা কিন্তু বরাবর সব সরকারের আমলেই ঘটেছে এবং কোনো সময়েই তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাহলে কি বুঝতে হবে যে ব্যবসায়ী শ্রেণী এ দেশের সরকার তথা শাসকশ্রেণীর চেয়ে শক্তিমান? কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে?
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সম্ভবত শেয়ারবাজারের ধস এবং যোগাযোগব্যবস্থার ভয়াবহতা, যা সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাহাকার এবং তারেক-মিশুকদের মৃত্যুর মতো প্রাত্যহিক সড়ক-মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে (কাগজে পড়েছি এমন কথাও যে এসব মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলা যাবে না)। অবশ্য জ্বালানি খাত নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।
আমি অর্থনীতিবিদ নই। তবু পত্রপত্রিকার লেখা এবং বিভিন্ন শেয়ার খাতের আলোচনায় যা বুঝেছি বা বুঝতে পারছি, তাতে মনে হয় সরকার বাজারের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিলে সমস্যার অনেকখানি সমাধান সম্ভব হতে পারত। ছোট বিনিয়োগের সাধারণ মানুষের কষ্ট দূর করা অসম্ভব হতো না। কিন্তু তা হয়নি। দুর্বোধ্য কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় এদিকটা নিয়ে ভাবতে নারাজ।
জনৈক অর্থনীতিবিদের লেখায় পড়ছি, 'সরকার শেয়ার বেচে ঘাটতি মেটাতে এবং নতুন প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে দুই বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা নিতে পারত, কিন্তু নেয়নি।' এ জন্য ওই লেখায় তিনি অংশত সরকারি আমলাদের দায়ী করেছেন এই বলে যে 'যাদের কারণে সরকার তার নিজের শেয়ারগুলো সময়মতো বেচতে পারল না, তাদের কারো শাস্তি হয়েছে কি?' অথচ শুনেছি, সত্য-মিথ্যা বলা কঠিন যে এই শেয়ারবাজারধসে সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীরা নাকি ফুলেফেঁপে বিশাল হয়েছে। অন্যদিকে ছোট সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কান্না এখনো থামছে না। এ জন্য অনেকে অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করছেন এ বিষয়ে তাঁর তৎপরতার অভাবের কারণে।
একই ধরনের জনক্ষোভ দেখা গেছে যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশার প্রতিক্রিয়ায়। পরিবহন সমস্যা তো ছিলই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। সব মৃত্যুই অনাকাঙ্ক্ষিত ও তা ক্ষোভের সংগত কারণ, বিশিষ্টজনদের কথা যদি নাও বলি। এ অবস্থার দুটো পার্শ্বমুখ।
এক. পরিবহনে সময় নষ্ট ও দুর্গতির কারণে মানুষের দুর্গতি, দ্বিতীয়ত অঘটন, যা মহামূল্যবান প্রাণনাশের কারণ। অথচ এত লেখালেখির পরও ঘাতক বাস-ট্রাকচালকদের হাতে মৃত্যুর শাস্তি নির্ধারিত হলো মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড। অনেকে লিখেছিলেন এবং অনেকে প্রতিবাদে দাবি করেছিলেন, অবহেলায় মৃত্যু ঘটানোর জন্য ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকা উচিত। কিন্তু তা হয়নি। শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, বিতর্কিত ও সমালোচিত যোগাযোগমন্ত্রীর বিদায় এবং নতুন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করব, বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যমাফিক যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে সমস্যার সমাধান করবেন।
আরো একটি বিষয় সম্ভবত জাতীয় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হলো মুদ্রাস্ফীতি। এর লাগামহীন ছুটে চলার যেন বিরাম নেই। বছরের পর বছর এর ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি পাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে অবাক হতে হয়। ফলে টাকার দাম কমছে, বাড়ছে রুপি, স্টার্লিং, পাউন্ড, ডলার ইত্যাদি মুদ্রার মান। আর বাংলাদেশি টাকার মান কেবল নিচের দিকে নামছে তো নামছেই, বলা যেতে পারে অধঃপতন। এক ডলারের আনুপাতিক মূল্য টাকার হিসাবে এখন আশির ওপরে (ষাটের দশকের শেষদিকে ছিল চার টাকা, আর এক গ্যালন পেট্রলের দামও চার টাকা)। তবু অর্থমন্ত্রী নিশ্চল!
এখানেও রয়েছে অর্থনীতির কেরামতি, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বিশ্লেষণের বিষয় নয়। তবে যখন কোনো বিষয় কাঁটার মতো গলায় আটকে শ্বাসকষ্টের কারণ হয়, তখন কিছুটা ভাবতেই হয়, না বুঝলেও অন্যদের আপ্তবাক্য বিবেচনায় আনতে হয়। আবারও পাশের দেশের তুলনা টানতে হয় এবং বলতে হয়, প্রতিবেশী দেশ বা অন্যরা পারলে আমরা পারব না কেন। এ ধরনের কথা নানা বিষয়ে অনেকের মুখে শোনা যায়। শোনাটা আকাঙ্ক্ষিত, সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষিত তা বাস্তবায়নের দিকটাও।
কারণ মূল্যস্ফীতি যখন আট-নয় থেকে দ্রুত সাড়ে এগারোর অঙ্ক ছুঁয়েও অস্থির হতেই থাকে এবং তার প্রতাপে যখন প্রাত্যহিক ভোগ্যপণ্য থেকে জ্বালানি এবং অন্য সব কিছুরই ঊর্ধ্বমূল্য জীবনযাপনের স্বস্তি নষ্ট করতে থাকে, তখন ভাবনা ও অস্থিরতা দুই-ই আমাদের সমান হারে আক্রমণ করতে থাকে, হোক না তা অর্থনীতির মতো পণ্ডিতি রাজ্যের বিষয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রভাবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। মুক্তবাজারের কথা নাই বা বলি।
কিন্তু কেন পারছি না। মেধা বা দক্ষতার অভাব নাকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা বিরোধী দলের যুক্তিহীন তৎপরতা, দুর্নীতি না সময়মতো সলতে পাকানোর ব্যর্থতা অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি অথবা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। প্রশাসনিক বিচক্ষণতার অভাবকেই অনেকে বড় কারণ বলে মনে করেন। সেই সঙ্গে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণও গুরুত্বহীন নয়, যে জন্য সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় হয়েও কূল পায় না। একাধিক ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়। তবু আমার ধারণা, সব কারণই কমবেশি দায়ী।
যেমন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে সময়মতো হাত লাগানো হলো না, এখনো হচ্ছে না। যেমন-পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা ও ঘোষণা মার খেল বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগের দায়ে। তবু ভালো যে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এমনকি ঘোষণা দিয়েছেন বেসরকারি খাত থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করার। আমার বিশ্বাস, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে হলেও এভাবে অর্থায়ন আমাদের পায়ের নিচের মাটি মজবুত হতে সাহায্য করবে। ভারত কিন্তু তার জন্মলগ্ন থেকেই অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেই নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর নীতি গ্রহণ করে, তাতে আখেরে যে লাভ হয়েছে তার প্রমাণ তাদের বর্তমান উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি।
দেরিতে হলেও আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে সততার সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় নির্বিশেষে আত্মনির্ভরতার এই নীতিতে ভর দিয়ে চলতে চেষ্টা করি, যথাসম্ভব নিজ স্বার্থ রক্ষা করে সীমিত পর্যায়ে বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করি, তাহলে সব ক্ষেত্রে না হোক, কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সাফল্য দেখা দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিদেশনীতি যেমন অপরিহার্য, তেমনি আবশ্যিক অভ্যন্তরীণ সুস্থ রাজনীতি। যে রাজনীতির মূলকথা দেশহিতৈষণা ('দেশপ্রেম' শব্দটা অকার্যকর ব্যবহারে বিবর্ণ), তা যেমন সত্য, ক্ষমতাসীন সরকারি দল ও জোটভুক্ত শরিক দলের ক্ষেত্রে তেমনি সত্য, বলা উচিত অধিকতর সত্য বিরোধী জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য।
বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বা নিছক পরাজয়ের ক্ষোভ ও প্রতিহিংসামূলক মনোভাব থেকে বিরোধিতা, জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে বিরোধিতা, এমনি হরেক রকম বিরোধিতায় দেশের স্বার্থ নষ্ট করা বিরোধী দলের যথার্থ ভূমিকা নয়। পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দলগত যত বিরোধই থাকুক না কেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তারা অনায়াসে ঐকমত্যে, এককাতারে দাঁড়িয়ে যায়। পশ্চিমের অনুসরণযোগ্য দিকগুলো আমরা গ্রহণ করি না, গ্রহণ করি তাদের মন্দ দিক, স্বার্থপরতার দিকগুলো।
তাই বিরোধী জোটভুক্ত দলগুলোর প্রতি আমাদের অনুরোধ, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হোন। একসময় আপনারাও ক্ষমতায় আসবেন, তখনো বর্তমানে প্রচলিত বিরোধীদলীয় ঐতিহ্য আপনাদের তাড়া করে ফিরবে। কাজেই যুক্তিহীন, দেশবিরোধী ঐতিহ্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে সুস্থ, সুষ্ঠু ও যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলুন। তাতে দেশের হয়তো কিছুটা লাভ অর্থাৎ স্বার্থ রক্ষিত হবে, কিন্তু দলীয় স্বার্থের অর্জন বেশিই হবে। এ ঐকমত্যে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ভূমিকাও কম নয়। তাদেরও দায়িত্ব আছে।
সব শেষে একটি কথা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী সরকার পক্ষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সন্দেহ নেই বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কথাটা বিশেষভাবে সত্য-যেমন বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী ইত্যাদি।
শেষের কথারও পরের কথা হচ্ছে যেমন দেশের বিবেচনায়, তেমনি দলের বিবেচনায়ও জনস্বার্থের সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে দূরদর্শী বিচক্ষণতা অতীব জরুরি। এ দায় কিন্তু সরকারের এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে তা পূরণ করা সম্ভব।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ভাষাসংগ্রামী
সালতামামির শুরুটা ইতিবাচকতায় বিচার করাই বোধ হয় সংগত। কারণ যুক্তিবাদীরা বলে থাকেন, আলোচনা-সমালোচনায় বিরূপতার বদলে ভিন্নমতের প্রকাশই উত্তম। সে হিসাবে বর্তমান সরকারের ইশতেহার-সূচির একটি বড় ঘোষণা ছিল প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার প্রত্যয়। এ খাতটিতে (হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব আগ্রহের কারণে) অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে ডিজিটাল তথ্যকোষ তৈরির প্রচেষ্টায়, এর প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে যেন আভাস পরিস্ফুট। দেশজ প্রযুক্তিতে তৈরি অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যে ল্যাপটপ নিঃসন্দেহে অগ্রসর পদক্ষেপ। এ দিকটায় নানা মাত্রায় ভালোই চলছে সরকারি তৎপরতা।
বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি (তা সত্ত্বেও ভোক্তাদের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ), কৃষি খাতে উন্নতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষা খাতে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি, সময়মতো পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের প্রত্যাশা পূরণ ইত্যাদি সন্দেহ নেই ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এর মধ্যেই সমস্যা তৈরি করেছে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন খাতে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা; যা গ্রাহক, ক্রেতা, ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার বলছে, ভর্তুকির চাপ এড়াতে এ মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু এ যুক্তি অর্থনীতিবিদ অনেকে মানতে নারাজ। এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা বারান্তরে করা যাবে। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দি্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে সর্বক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষ ধারায়। যদি ব্যক্তিগত পরিবহনের কথা বাদও দিই (এটাও গুরুত্বহীন নয়) তাহলেও সাধারণ পরিবহনে এর প্রভাব বহুমুখী, যেমন যাতায়াতে, তেমনি খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে, যা বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কারণ প্রতিদিনের জন্য দরকারি জিনিসপত্রের দাম যদি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে, তবে তা দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, সীমিত আয়ের মানুষ-সবার জন্য, আর বিত্তহীনদের তো কথাই নেই। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে ভোটদাতাদের বৃহত্তর অংশ এই শ্রেণীর মানুষ-বিত্তবান বা উচ্চবিত্তদের সংখ্যা কত শতাংশই বা। সরকার বিষয়টি আমলে আনছে না।
কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের মনোযোগের অভাব রয়েছে বলতে হয় এ কারণে যে আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির বাইরেও একেক সময় একেকটি বা একাধিক পণ্যের লাফিয়ে দাম বাড়ার পেছনে উচ্চশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফাবৃত্তির প্রবণতা ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা ওঠে-সয়াবিনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে একসময় কথাটা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীকুল মহানন্দে বণিজ্য করে চলেছে। এ ঘোড়দৌড়ের লাগামটা কী শক্ত হাতে ধরা যেত না? সরকারের ভবিষ্যৎ স্বার্থেই এটা নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার ছিল। এ বিষয়টা কিন্তু বরাবর সব সরকারের আমলেই ঘটেছে এবং কোনো সময়েই তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাহলে কি বুঝতে হবে যে ব্যবসায়ী শ্রেণী এ দেশের সরকার তথা শাসকশ্রেণীর চেয়ে শক্তিমান? কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে?
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সম্ভবত শেয়ারবাজারের ধস এবং যোগাযোগব্যবস্থার ভয়াবহতা, যা সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাহাকার এবং তারেক-মিশুকদের মৃত্যুর মতো প্রাত্যহিক সড়ক-মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে (কাগজে পড়েছি এমন কথাও যে এসব মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলা যাবে না)। অবশ্য জ্বালানি খাত নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।
আমি অর্থনীতিবিদ নই। তবু পত্রপত্রিকার লেখা এবং বিভিন্ন শেয়ার খাতের আলোচনায় যা বুঝেছি বা বুঝতে পারছি, তাতে মনে হয় সরকার বাজারের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিলে সমস্যার অনেকখানি সমাধান সম্ভব হতে পারত। ছোট বিনিয়োগের সাধারণ মানুষের কষ্ট দূর করা অসম্ভব হতো না। কিন্তু তা হয়নি। দুর্বোধ্য কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় এদিকটা নিয়ে ভাবতে নারাজ।
জনৈক অর্থনীতিবিদের লেখায় পড়ছি, 'সরকার শেয়ার বেচে ঘাটতি মেটাতে এবং নতুন প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে দুই বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা নিতে পারত, কিন্তু নেয়নি।' এ জন্য ওই লেখায় তিনি অংশত সরকারি আমলাদের দায়ী করেছেন এই বলে যে 'যাদের কারণে সরকার তার নিজের শেয়ারগুলো সময়মতো বেচতে পারল না, তাদের কারো শাস্তি হয়েছে কি?' অথচ শুনেছি, সত্য-মিথ্যা বলা কঠিন যে এই শেয়ারবাজারধসে সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীরা নাকি ফুলেফেঁপে বিশাল হয়েছে। অন্যদিকে ছোট সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কান্না এখনো থামছে না। এ জন্য অনেকে অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করছেন এ বিষয়ে তাঁর তৎপরতার অভাবের কারণে।
একই ধরনের জনক্ষোভ দেখা গেছে যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশার প্রতিক্রিয়ায়। পরিবহন সমস্যা তো ছিলই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। সব মৃত্যুই অনাকাঙ্ক্ষিত ও তা ক্ষোভের সংগত কারণ, বিশিষ্টজনদের কথা যদি নাও বলি। এ অবস্থার দুটো পার্শ্বমুখ।
এক. পরিবহনে সময় নষ্ট ও দুর্গতির কারণে মানুষের দুর্গতি, দ্বিতীয়ত অঘটন, যা মহামূল্যবান প্রাণনাশের কারণ। অথচ এত লেখালেখির পরও ঘাতক বাস-ট্রাকচালকদের হাতে মৃত্যুর শাস্তি নির্ধারিত হলো মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড। অনেকে লিখেছিলেন এবং অনেকে প্রতিবাদে দাবি করেছিলেন, অবহেলায় মৃত্যু ঘটানোর জন্য ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকা উচিত। কিন্তু তা হয়নি। শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, বিতর্কিত ও সমালোচিত যোগাযোগমন্ত্রীর বিদায় এবং নতুন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করব, বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যমাফিক যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে সমস্যার সমাধান করবেন।
আরো একটি বিষয় সম্ভবত জাতীয় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হলো মুদ্রাস্ফীতি। এর লাগামহীন ছুটে চলার যেন বিরাম নেই। বছরের পর বছর এর ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি পাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে অবাক হতে হয়। ফলে টাকার দাম কমছে, বাড়ছে রুপি, স্টার্লিং, পাউন্ড, ডলার ইত্যাদি মুদ্রার মান। আর বাংলাদেশি টাকার মান কেবল নিচের দিকে নামছে তো নামছেই, বলা যেতে পারে অধঃপতন। এক ডলারের আনুপাতিক মূল্য টাকার হিসাবে এখন আশির ওপরে (ষাটের দশকের শেষদিকে ছিল চার টাকা, আর এক গ্যালন পেট্রলের দামও চার টাকা)। তবু অর্থমন্ত্রী নিশ্চল!
এখানেও রয়েছে অর্থনীতির কেরামতি, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বিশ্লেষণের বিষয় নয়। তবে যখন কোনো বিষয় কাঁটার মতো গলায় আটকে শ্বাসকষ্টের কারণ হয়, তখন কিছুটা ভাবতেই হয়, না বুঝলেও অন্যদের আপ্তবাক্য বিবেচনায় আনতে হয়। আবারও পাশের দেশের তুলনা টানতে হয় এবং বলতে হয়, প্রতিবেশী দেশ বা অন্যরা পারলে আমরা পারব না কেন। এ ধরনের কথা নানা বিষয়ে অনেকের মুখে শোনা যায়। শোনাটা আকাঙ্ক্ষিত, সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষিত তা বাস্তবায়নের দিকটাও।
কারণ মূল্যস্ফীতি যখন আট-নয় থেকে দ্রুত সাড়ে এগারোর অঙ্ক ছুঁয়েও অস্থির হতেই থাকে এবং তার প্রতাপে যখন প্রাত্যহিক ভোগ্যপণ্য থেকে জ্বালানি এবং অন্য সব কিছুরই ঊর্ধ্বমূল্য জীবনযাপনের স্বস্তি নষ্ট করতে থাকে, তখন ভাবনা ও অস্থিরতা দুই-ই আমাদের সমান হারে আক্রমণ করতে থাকে, হোক না তা অর্থনীতির মতো পণ্ডিতি রাজ্যের বিষয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রভাবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। মুক্তবাজারের কথা নাই বা বলি।
কিন্তু কেন পারছি না। মেধা বা দক্ষতার অভাব নাকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা বিরোধী দলের যুক্তিহীন তৎপরতা, দুর্নীতি না সময়মতো সলতে পাকানোর ব্যর্থতা অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি অথবা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। প্রশাসনিক বিচক্ষণতার অভাবকেই অনেকে বড় কারণ বলে মনে করেন। সেই সঙ্গে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণও গুরুত্বহীন নয়, যে জন্য সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় হয়েও কূল পায় না। একাধিক ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়। তবু আমার ধারণা, সব কারণই কমবেশি দায়ী।
যেমন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে সময়মতো হাত লাগানো হলো না, এখনো হচ্ছে না। যেমন-পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা ও ঘোষণা মার খেল বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগের দায়ে। তবু ভালো যে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এমনকি ঘোষণা দিয়েছেন বেসরকারি খাত থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করার। আমার বিশ্বাস, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে হলেও এভাবে অর্থায়ন আমাদের পায়ের নিচের মাটি মজবুত হতে সাহায্য করবে। ভারত কিন্তু তার জন্মলগ্ন থেকেই অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেই নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর নীতি গ্রহণ করে, তাতে আখেরে যে লাভ হয়েছে তার প্রমাণ তাদের বর্তমান উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি।
দেরিতে হলেও আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে সততার সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় নির্বিশেষে আত্মনির্ভরতার এই নীতিতে ভর দিয়ে চলতে চেষ্টা করি, যথাসম্ভব নিজ স্বার্থ রক্ষা করে সীমিত পর্যায়ে বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করি, তাহলে সব ক্ষেত্রে না হোক, কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সাফল্য দেখা দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিদেশনীতি যেমন অপরিহার্য, তেমনি আবশ্যিক অভ্যন্তরীণ সুস্থ রাজনীতি। যে রাজনীতির মূলকথা দেশহিতৈষণা ('দেশপ্রেম' শব্দটা অকার্যকর ব্যবহারে বিবর্ণ), তা যেমন সত্য, ক্ষমতাসীন সরকারি দল ও জোটভুক্ত শরিক দলের ক্ষেত্রে তেমনি সত্য, বলা উচিত অধিকতর সত্য বিরোধী জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য।
বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বা নিছক পরাজয়ের ক্ষোভ ও প্রতিহিংসামূলক মনোভাব থেকে বিরোধিতা, জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে বিরোধিতা, এমনি হরেক রকম বিরোধিতায় দেশের স্বার্থ নষ্ট করা বিরোধী দলের যথার্থ ভূমিকা নয়। পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দলগত যত বিরোধই থাকুক না কেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তারা অনায়াসে ঐকমত্যে, এককাতারে দাঁড়িয়ে যায়। পশ্চিমের অনুসরণযোগ্য দিকগুলো আমরা গ্রহণ করি না, গ্রহণ করি তাদের মন্দ দিক, স্বার্থপরতার দিকগুলো।
তাই বিরোধী জোটভুক্ত দলগুলোর প্রতি আমাদের অনুরোধ, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হোন। একসময় আপনারাও ক্ষমতায় আসবেন, তখনো বর্তমানে প্রচলিত বিরোধীদলীয় ঐতিহ্য আপনাদের তাড়া করে ফিরবে। কাজেই যুক্তিহীন, দেশবিরোধী ঐতিহ্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে সুস্থ, সুষ্ঠু ও যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলুন। তাতে দেশের হয়তো কিছুটা লাভ অর্থাৎ স্বার্থ রক্ষিত হবে, কিন্তু দলীয় স্বার্থের অর্জন বেশিই হবে। এ ঐকমত্যে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ভূমিকাও কম নয়। তাদেরও দায়িত্ব আছে।
সব শেষে একটি কথা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী সরকার পক্ষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সন্দেহ নেই বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কথাটা বিশেষভাবে সত্য-যেমন বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী ইত্যাদি।
শেষের কথারও পরের কথা হচ্ছে যেমন দেশের বিবেচনায়, তেমনি দলের বিবেচনায়ও জনস্বার্থের সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে দূরদর্শী বিচক্ষণতা অতীব জরুরি। এ দায় কিন্তু সরকারের এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে তা পূরণ করা সম্ভব।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ভাষাসংগ্রামী
No comments