রাজনীতি-মহাজোট সরকারের সালতামামি by আবদুল মান্নান

জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছর পূর্ণ হবে এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা মহলে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা হবে। যথারীতি সরকারবিরোধীরা বিগত তিন বা গত এক বছরে সরকারের কোনো সাফল্য খুঁজে পাবেন না এবং সরকারি দল চাইবে যাঁরাই এই আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিক, তাঁরা যেন সরকারের স্তুতি গাওয়ার প্রতিই বেশি মনোযোগী হন। আমাদের দেশে রাজনীতিতে একধরনের নেতা-নেত্রী


আছেন, তাঁরা সব সময় স্তাবক পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করেন। এ-ও বলে রাখা ভালো আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অনেকটা পান থেকে চুন খসলেই রক্ষা না পাওয়ার অবস্থা। এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে এ দেশের জনগণের প্রত্যাশা অন্য যেকোনো দলের চেয়ে বেশি ।
এই মুহূর্তে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। নানা কারণে তা একটি ভয়াবহ দুঃসময়, যা আজকের প্রজন্মকে ঠিক বোঝানো যাবে না। এ সময় এটি অস্বাভাবিক ছিল না যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীর দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৫০-৫৫ টাকা মণ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত উঠল। তখনো দেশে বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় তা তেমন একটা ছিল না। সরকারের একমাত্র প্রকাশ্য সমালোচক মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু আবার মওলানাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাসানী তাঁর দলের কর্মীদের নিয়ে এক ভুখা মিছিল বের করলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে সম্ভবত এটাই প্রথম কোনো একটি রাজনৈতিক দলের মিছিল। স্বাধীনতার পর মুহূর্ত থেকেই আওয়ামী লীগের ওপর চাহিদার চাপ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগ ছাড়া এ দেশে সঠিক অর্থে গণমানুষের রাজনৈতিক দল বলতে যা বোঝায় সে রকম আর একটি দলও গড়ে ওঠেনি (এ ব্যাপারে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে)। সুতরাং আওয়ামী লীগ কোনো কিছু অঙ্গীকার করে তা যদি দিতে না পারে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা বহুগুণ বেড়ে যায়।
২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ২৩ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। এ নির্বাচনটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই নির্বাচন হওয়ার নির্দিষ্ট সময় ছিল ২০০৬ সালের শেষের দিকে। সময়মতো সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণ পাঠকদের না জানার কথা নয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হবে তা মোটামুটি প্রত্যাশিত ছিল। দেশের সাধারণ জনগণ প্রত্যাশা করেছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক অংশ নেওয়া দলগুলো তা মেনে নেবে এবং পরাজিত দলগুলো নিজেদের পরাজয়ের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে আর বিজয়ী দল বা মোর্চা জনগণকে ইশতেহারে দেওয়া তাদের ওয়াদাগুলো পূরণের চেষ্টা চালাবে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে গত তিন বছরে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ই এ কাজগুলো করতে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমেই সরকারি দল প্রসঙ্গে বলি। পত্রপত্রিকা আর টিভির টক শো শুনলে মনে হবে মহাজোট সরকার গত তিন বছরে দেশকে রসাতলে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার তার সবকিছু করে এনেছে । এরই প্রেক্ষাপটে যদি বলি সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা খুব হালকা নয়, তার পরও তাদের অর্জনও তো কম নয়। এতে অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে বলবেন, ‘বেটা, আওয়ামী লীগের দালাল কোথাকার। নিশ্চয় কিছু একটা পাওয়ার বদমতলব আছে।’ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে হয় সবকিছু সাদা অথবা সবকিছু কালো। মাঝামাঝি কিছু থাকতে নেই। পাঠকদের সামনে একটি মজার উদাহরণ উল্লেখ করতে চাই। যে কেউ (যাঁরা সব কালো দেখতে অভ্যস্ত তারা ছাড়া) স্বীকার করবেন, সাফল্যের দিক থেকে বাংলাদেশে দুটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড অন্য মন্ত্রণালয়কে ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমটি কৃষি আর দ্বিতীয়টা শিক্ষা। ১ জানুয়ারি সারা দেশের সব স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হলো। এটি বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে আরেকটি নতুন পার্বণ যোগ হওয়ার মতোই ঘটনা। বিষয়টি মোটামুটি সব গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বসহকারে পরিবেশিত হয়েছে। তবে একটি জাতীয় দৈনিকে এই সংবাদের সঙ্গে দুই কলামের আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে; যার শিরোনাম, ‘সব বই যায়নি, অনেকে জানেই না।’ সংবাদদাতা এই সংবাদের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন বান্দরবান শহর থেকে ১০ কিলোমািটার দূরের একটি স্কুলকে। পাঠককে বলে দিতে হবে না এমন সংবাদ প্রকাশের উদ্দেশ্য আর যা-ই হোক সৎ ছিল না।
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতিগুলো মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক. রাজনৈতিক, দুই. অর্থনৈতিক এবং তিন. সামাজিক। যেকোনো রকমের শাসনব্যবস্থায় সে দেশের রাজনীতি অনেকাংশে বাকি দুটিকে প্রভাবিত করে। আর বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশ এককভাবে তার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। যুক্তারাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা হলে বাংলাদেশে কয়েক শ পোশাক কারখানা বন্ধ হয় এবং লাখ খানেক মানুষ বেকার হয়। মন্দার কারণে আমেরিকার মানুষ গাড়ি কম চালালে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর তেল বিক্রি কমে যায়। ফলে সে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয় আর তাতে সে দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকেরা বেকার হন এবং দেশে ফিরে আসেন।
তবে অর্থনীতির কিছু বিষয় থাকে, যা সরকার চাইলে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে। যেমন, দ্রব্যমূল্য। বিশ্ববাজারে সব পণ্যের মূল্য বেড়েছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বেড়েছে ডলারের মূল্য। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো টিভি টক শোতে শুনি, সঞ্চালক প্রশ্ন করেন, সারা দুনিয়ায় ডলারের দাম কমছে, বাংলাদেশে কেন বাড়বে? তাঁরা কথাটা একেবারেই ঠিক বলেন না। দু-একটি দেশে ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেশির ভাগ দেশে তা কমবেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে বর্তমানে এক ডলার সমান ৫৩.৭ রুপি, যা এক বছর আগে ছিল ৪৫.৪। পাকিস্তানে ৮৫.৭ রুপি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৯.৫-এ দাঁড়িয়েছে। মালয়েশিয়া ৩.১৩ থেকে ৩.১৮-এ ঠেকেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬.৮২ থেকে ৮.৪৪-এ উন্নীত হয়েছে। সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব বা ব্রিটেনে তা মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে (সব তথ্য ডিসেম্বর মাসের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট থেকে নেওয়া)।
বাংলাদেশে একটি আমদানিনির্ভর দেশ। সুতরাং দেশে যা কিছু আমদানি করা হয়, তা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তার দাম বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তবে আমাদের বাজারে যেসব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়, তার একটি বড় কারণ বাজার কারসাজি এবং অত্যন্ত অদক্ষ ও নিম্নমানের সরবরাহব্যবস্থা। এর জন্য সরকারের যে একটি দায়িত্ব আছে, তা তো সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না। এই দায়িত্ব যদি সরকার সঠিকভাবে পালন করতে পারত, তাহলে যে চিনির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ৪২-৪৫ টাকা, তা খুচরা বাজারে আসতে আসতে ৬৮-৭২ টাকা হতো না। এটি স্রেফ একটি উদহারণ। সব দিতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে নিতে হবে, যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য তা তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।
বর্তমান সরকারের কৃষি, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যনিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ দমন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট সাফল্য আছে। সাফল্য আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও। তিন বছরে জাতীয় গ্রিডে দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হয়েছে। আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাঁচ শ মেগাওয়াট উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এখন সমালোচনা শুরু হয়েছে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে এই বিদ্যুৎ ক্রয় করা সমীচীন হয়েছে কি না এ নিয়ে। এ ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ডিজেল ও ফার্নেস তেল ব্যবহার করে, যার মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। যাঁরা এই সমালোচনা করছেন, তাঁরাই কিন্তু এক বছর আগে বলেছেন, মানুষ বিদ্যুৎ চায়। কীভাবে, কোথা থেকে তা পাওয়া যাবে, তা জানতে চায় না। তবে হ্যাঁ, মধ্য ও নিম্নবিত্তের আয় সব সময় সীমিত। সে কারণে বিদ্যুৎ বা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে তাদের পকেটের তলানিতেও হাত পড়ে। আবার জ্বালানি বা বিদ্যুতের মূল্য শুধু যে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে হচ্ছে, তাও নয় । অদক্ষ সরবরাহব্যবস্থা পরিচালনা এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সরকারের একটি বড় অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। দেরিতে হলেও তা শুরু হয়েছে। তবে যারা প্রসিকিউশনে আছেন, তাঁদের সার্বিক কর্মকাণ্ড দেখে সাধারণ মানুষের হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
চার বছরের শুরুতে ব্যর্থতার কথা বলতে হলে উল্লেক করতে হয় রাজনীতির তেমন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। ২০০৬ সালের শেষে রাজনীতি যেমনটি সাংঘর্ষিক ছিল ২০১২ সালেও তা বজায় থাকার সম্ভাবনা আছে; যার আলামত ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ অনেকটা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যার ফলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগে আওয়ামী লীগ চাইত আর বিএনপির অবস্থা ছিল ঠিক বিপরীত। ‘জান দেব তো এ রকম একটা আত্মঘাতী ব্যবস্থা দেব না।’ এখন অবস্থা ঠিক উল্টো। বিএনপি বলছে, এই ব্যবস্থা পুনরায় চালু না হলে তারা আগামী নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ বলছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং সেই সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে। বিএনপির আবার সংসদে যাওয়াটা খুব পছন্দ নয়। তারা সবকিছু রাজপথেই ফায়সালা করতে চায়। এই তিন বছরে বিএনপি অনেক সুযোগ পেয়েও একটি কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি, গণতন্ত্রের স্বার্থে যা একান্ত প্রয়োজন ছিল। তার ওপর যুদ্ধাপরাধীদেরে পক্ষাবলম্বন করে তারা নিজেরা পায়ে কুড়াল মেরেছে। আগামী দুই বছরে সরকার আর বিরোধী দল উভয়েকে তাদের রাজনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন করতে হবে। সরকারকে আরও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আরেকটা কথা মনে রাখা ভালো, যাঁরা সরকারের কাজের সমালোচনা করেন, তাঁরা সবাই সরকারের প্রতিপক্ষ নন। অনেক বস্তুনিষ্ঠ সমালোচক আছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সাফল্য দেখতে চান। তাঁরা আবার লুটপাটের রাজত্বে ফিরে যেতে চান না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.