গন্তব্য ঢাকা-সবই সয়ে গেছে
শীতের স্নিগ্ধ বিকেল। রোদের আমেজ তখনো মিলিয়ে যায়নি। শীতের মিষ্টি রোদটা লুকোচুরির খেলা খেলছে মহাখালী ওভারব্রিজের গা বেয়ে। এমন বিকেলে নিজের কাজ নিয়ে মগ্ন এক লোক। পাশ দিয়ে যে যাচ্ছে, তার দিকেই একটু হালকা মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছেন তিনি। দৃষ্টিটা পড়ে মনে হচ্ছিল, যেন নিজের দ্রব্যাদির জন্য ক্রেতার খোঁজ করছেন তিনি। আলাপ জমাতে হলে কথা বলতে হবে। দায়িত্বটা নিলাম আমিই। সামনে বেশ কিছু জিনিসের স্তূপ। ‘এগুলো কী?’ তিনি
বলেন, ‘এসব বিভিন্ন ধরনের মসলা।’ ‘কী নাম এগুলোর?’ ‘এগুলোর তো একেকটার একেক নাম—জায়ফল, জয়ত্রী, কিশমিশ, এলাচ, কাউনের চাল, জিরা, কালিজিরা আরও কত কী?’ ‘আপনার নাম কী?’ ‘আমার নাম সোহরাবউদ্দীন।’ মহাখালী ওভারব্রিজের নিচে নিজের জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। নিজের কাজের প্রতি সবারই একটা মনোযোগ থাকে। তাই সামনে দিয়ে যে যাচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি খোঁজেন নিজের পণ্যের ক্রেতাকে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানা। সেখানে জাবরাবাদ নামে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামেই নিজেদের একটা বাড়ি আছে সোহরাবউদ্দীনের। হোক না সেটা অনেক ছোট, তবে ভালোবাসায় গড়া। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন সোহরাবউদ্দীন। দিনগুলোও কেটে যাচ্ছিল বেশ ভালোই। কিন্তু সময় তো আর সব সময় এক রকম থাকে না। প্রতিনিয়ত সেখানে আসে পরিবর্তন। ‘কাইলকার দিনের সাথে তো আইজকারই মিল নাই। এত বছরে কি আর সব একই থাকে!’
আজ অনেক বছর হলো ঢাকায় এসেছেন সোহরাবউদ্দীন। কিন্তু ঢাকা আর গ্রামের পার্থক্যটা নিশ্চয়ই এখনো দূর হয়নি। এখনো বাড়ির টান বেশ ভালোই বোঝেন তিনি। তাই ছয় মাস পর পর ছোটেন বাড়ির দিকে। তিনি বলেন, ‘ভালো-খারাপ মিলাইয়া থাকে সবকিছু। ঢাকায় কিছু আছে ভালো লাগে, আবার কিছু আছে গ্রামে ভালো লাগে।’ গ্রামে ধানের ব্যবসা করতেন সোহরাবউদ্দীন। কিন্তু সেই ব্যবসা দিয়ে আর সংসার চলত না। গ্রাম এলাকায় তখন যেন ঢাকায় আসার ধুম পড়েছে। সবাই আসছে, কাজ করছে, টাকা আয় করছে। আগামী জীবনে পরিবর্তনের আশায় সোহরাবউদ্দীনও ছুটে এসেছিলেন ঢাকায়। তখন হাতে ছিল মাত্র ৩০০ টাকা। কষ্ট করে চলার প্রায় এক বছর পর নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ঢাকায় নিয়ে এলেন সোহরাবউদ্দীন।
জীবনে অনেক রকমের কাজই করেছেন সোহরাবউদ্দীন। কখনো ফলের ব্যবসা করেছেন, আবার গাড়ির কন্ডাক্টরও ছিলেন। গত বছরের রোজার ঈদ থেকে করছেন মসলার ব্যবসা। ‘ঢাকাতেই কি থাকতে চান?’ প্রশ্নের জবাব দেন তিনি, ‘চাই না, কিন্তু উপায় তো দেখি না। এখনো পরিস্থিতি হয় নাই গ্রামে যাবার। আমি একবার একটা ট্রাক কিনেছিলাম। পরে সেটা আমার অবস্থা আরও খারাপ করেছে। এখন আর ট্রাকটাও নাই।’
‘গ্রামে কি আপনাদের নিজেদের যায়গাজমি নেই? থাকলে তো সেটুকু চাষ করে সংসার চালাতে পারেন?’ বুকের মধ্যে জমানো ব্যথাটা প্রকাশ করেন তিনি, ‘আরে, আমার গ্রামে কেবল থাকার মতো একটা বাড়ি আছে। চাষ করার মতো জমি নাই। সব রাঘববোয়ালরা খাইছে। রাঘববোয়াল বোঝেন না, রাঘববোয়াল। এরা আমার সবকিছু নষ্ট করছে। অনেক কষ্ট দিছে।’
মনের মধ্যে একগাদা কষ্ট নিয়ে ঢাকার পথে পা দিয়েছিলেন সোহরাবউদ্দীন। মনের কোণে আশা ছিল, হয়তো একটা কিছু পরিবর্তন হবে। তা না হলেও জীবনটা কাটবে একটু স্বচ্ছন্দে। কতটা পূরণ হয়েছে সেটা? দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি, ‘নাহ! স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি। খুব ইচ্ছা ছিল বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকব, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে টাকা কামাই করবে। কেউরেই তো পড়াইতে পারলাম না। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে আমার। এখন কেবল চাই, ওরা যেভাবেই হোক মোটামুটি আয় করে খাক।’
চার বোন তিন ভাই সোহরাবউদ্দীনরা। বোনগুলোর বিয়ে হয়েছে, আর ভাইদের একজন মারা গেছেন। বাকি দুজন ঢাকায় থাকেন। তীর্থের কাকের মতো একাকী বসে বাড়িটি পাহারা দেন বৃদ্ধা মা। আর পথ চেয়ে থাকেন কখন ঢাকা থেকে ছেলেরা যাবে। ‘আমরা সবাই বাড়িতে গেলে মা খুব খুশি হয়। কিন্তু তাকে ঢাকায় আনতে চাইলেও সে আসে না। একা একা ওখানে থাকে, তাই আমাগো মন খারাপ লাগে। কষ্ট তো তারও হয়।’
এই ওভারব্রিজের নিচেই সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মসলা নিয়ে বসেন সোহরাবউদ্দীন। সকালের দিকে ব্যস্ততা একটু কম থাকে। বিকেল হলেই ঘরে ফেরা মানুষগুলো টুকটাক কিনতে থাকে জিনিসপত্র। মসলা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়, কিন্তু গ্রামে ফেরার সেই স্বপ্নটা দূরেই থেকে যায়। মসলা শেষ হয়ে গেলে আবার কারওয়ান বাজার থেকে নিয়ে আসেন তিনি। এখানেই প্রতিটি দিন কাটে তাঁর। বলেন, ‘সবই সয়ে গেছে। কেবল এত বেশি শব্দ অনেক খারাপ লাগে। সেটা তো গ্রামে নাই।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানা। সেখানে জাবরাবাদ নামে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামেই নিজেদের একটা বাড়ি আছে সোহরাবউদ্দীনের। হোক না সেটা অনেক ছোট, তবে ভালোবাসায় গড়া। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন সোহরাবউদ্দীন। দিনগুলোও কেটে যাচ্ছিল বেশ ভালোই। কিন্তু সময় তো আর সব সময় এক রকম থাকে না। প্রতিনিয়ত সেখানে আসে পরিবর্তন। ‘কাইলকার দিনের সাথে তো আইজকারই মিল নাই। এত বছরে কি আর সব একই থাকে!’
আজ অনেক বছর হলো ঢাকায় এসেছেন সোহরাবউদ্দীন। কিন্তু ঢাকা আর গ্রামের পার্থক্যটা নিশ্চয়ই এখনো দূর হয়নি। এখনো বাড়ির টান বেশ ভালোই বোঝেন তিনি। তাই ছয় মাস পর পর ছোটেন বাড়ির দিকে। তিনি বলেন, ‘ভালো-খারাপ মিলাইয়া থাকে সবকিছু। ঢাকায় কিছু আছে ভালো লাগে, আবার কিছু আছে গ্রামে ভালো লাগে।’ গ্রামে ধানের ব্যবসা করতেন সোহরাবউদ্দীন। কিন্তু সেই ব্যবসা দিয়ে আর সংসার চলত না। গ্রাম এলাকায় তখন যেন ঢাকায় আসার ধুম পড়েছে। সবাই আসছে, কাজ করছে, টাকা আয় করছে। আগামী জীবনে পরিবর্তনের আশায় সোহরাবউদ্দীনও ছুটে এসেছিলেন ঢাকায়। তখন হাতে ছিল মাত্র ৩০০ টাকা। কষ্ট করে চলার প্রায় এক বছর পর নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ঢাকায় নিয়ে এলেন সোহরাবউদ্দীন।
জীবনে অনেক রকমের কাজই করেছেন সোহরাবউদ্দীন। কখনো ফলের ব্যবসা করেছেন, আবার গাড়ির কন্ডাক্টরও ছিলেন। গত বছরের রোজার ঈদ থেকে করছেন মসলার ব্যবসা। ‘ঢাকাতেই কি থাকতে চান?’ প্রশ্নের জবাব দেন তিনি, ‘চাই না, কিন্তু উপায় তো দেখি না। এখনো পরিস্থিতি হয় নাই গ্রামে যাবার। আমি একবার একটা ট্রাক কিনেছিলাম। পরে সেটা আমার অবস্থা আরও খারাপ করেছে। এখন আর ট্রাকটাও নাই।’
‘গ্রামে কি আপনাদের নিজেদের যায়গাজমি নেই? থাকলে তো সেটুকু চাষ করে সংসার চালাতে পারেন?’ বুকের মধ্যে জমানো ব্যথাটা প্রকাশ করেন তিনি, ‘আরে, আমার গ্রামে কেবল থাকার মতো একটা বাড়ি আছে। চাষ করার মতো জমি নাই। সব রাঘববোয়ালরা খাইছে। রাঘববোয়াল বোঝেন না, রাঘববোয়াল। এরা আমার সবকিছু নষ্ট করছে। অনেক কষ্ট দিছে।’
মনের মধ্যে একগাদা কষ্ট নিয়ে ঢাকার পথে পা দিয়েছিলেন সোহরাবউদ্দীন। মনের কোণে আশা ছিল, হয়তো একটা কিছু পরিবর্তন হবে। তা না হলেও জীবনটা কাটবে একটু স্বচ্ছন্দে। কতটা পূরণ হয়েছে সেটা? দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি, ‘নাহ! স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি। খুব ইচ্ছা ছিল বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকব, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে টাকা কামাই করবে। কেউরেই তো পড়াইতে পারলাম না। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে আমার। এখন কেবল চাই, ওরা যেভাবেই হোক মোটামুটি আয় করে খাক।’
চার বোন তিন ভাই সোহরাবউদ্দীনরা। বোনগুলোর বিয়ে হয়েছে, আর ভাইদের একজন মারা গেছেন। বাকি দুজন ঢাকায় থাকেন। তীর্থের কাকের মতো একাকী বসে বাড়িটি পাহারা দেন বৃদ্ধা মা। আর পথ চেয়ে থাকেন কখন ঢাকা থেকে ছেলেরা যাবে। ‘আমরা সবাই বাড়িতে গেলে মা খুব খুশি হয়। কিন্তু তাকে ঢাকায় আনতে চাইলেও সে আসে না। একা একা ওখানে থাকে, তাই আমাগো মন খারাপ লাগে। কষ্ট তো তারও হয়।’
এই ওভারব্রিজের নিচেই সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মসলা নিয়ে বসেন সোহরাবউদ্দীন। সকালের দিকে ব্যস্ততা একটু কম থাকে। বিকেল হলেই ঘরে ফেরা মানুষগুলো টুকটাক কিনতে থাকে জিনিসপত্র। মসলা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়, কিন্তু গ্রামে ফেরার সেই স্বপ্নটা দূরেই থেকে যায়। মসলা শেষ হয়ে গেলে আবার কারওয়ান বাজার থেকে নিয়ে আসেন তিনি। এখানেই প্রতিটি দিন কাটে তাঁর। বলেন, ‘সবই সয়ে গেছে। কেবল এত বেশি শব্দ অনেক খারাপ লাগে। সেটা তো গ্রামে নাই।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments