আফগানিস্তান -স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়ার নির্বাচন by রবার্ট ফিস্ক

জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচিত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। অথচ ফিলিস্তিনিরা ২০০৬ সালের একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে হামাসের পক্ষে রায় দেয়; এর জন্য তাদের ভয়াবহ শাস্তি পেতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসে ইরানে জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে আরেক মেয়াদের জন্য ক্ষমতাসীন হন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। ইরানের বাইরে সবাই (ইরানের ভেতরও অনেকে) তাঁকে স্বৈরাচারী শাসক গণ্য করে। এবার দেখা গেল, ইরানের চেয়ে ব্যাপক মাত্রার কারচুপির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্থলোলুপ, দুর্নীতিবাজ ও উপদলীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী কারজাই ক্ষমতায় ফিরলেন। আর পশ্চিমারা তাঁকে অভিনন্দিত করল। এতে স্পষ্ট যে পশ্চিমারা তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে এবং এই আগাগোড়া জালিয়াতির নির্বাচন মেনে নিচ্ছে।
নির্বাচনে তাঁর প্রতিপক্ষ ছদ্ম-পশতুন নেতা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহকে জাতীয় মতৈক্যের সরকারে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টা পশ্চিমারা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ কারজাইয়ের ভোট-কারচুপির কারণেই আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ দ্বিতীয় দফা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান আর কারজাই পান ওবামা-ব্রাউন যুগলের বন্ধুত্বসুলভ অভিনন্দন। ঠিক আছে, এখন আরও ৪০ হাজার মার্কিন সেনা পাঠানো হোক। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অষ্টম বছরে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার জন্য এ সেনা দরকার। মার্কিন সেনাপতির এ কথা তোলার এই তো মোক্ষম সময়।
বারবারা টাচম্যান দ্য মার্চ অব ফলি বইতে ট্রয় থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধকালীন আমেরিকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের যেসব সরকার নিজস্ব স্বার্থবিরোধী নীতিমালা অনুসরণ করেছিল, তাদের ওপর আলোকপাত করেছেন। ভিয়েতনামের স্মৃতিও আমরা একটু হাতড়ে দেখতে পারি। কারণ আফতান যুদ্ধে ভিয়েতনাম খুবই প্রাসঙ্গিক।
১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে মার্কিনরা ‘গণতান্ত্রিক’ এক নির্বাচন তত্ত্বাবধান করে, যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন দুর্নীতিবাজ সাবেক জেনারেল নগুয়েন ভান থিওমান। জালিয়াতির নির্বাচনকেও আমেরিকা ‘সাধারণভাবে স্বচ্ছ’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাথমিক নির্বাচনে নগুয়েন পান ৩৮ শতাংশ ভোট। তাঁর প্রতিপক্ষ তখন প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৬৭ সালে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক দখলদারিকে ন্যায্যতা দিতে এই স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়া ওয়াশিংটনের জন্য জরুরি ছিল। সায়গন যেমন সারা দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিযুক্ত নিষ্ঠুর শাসনের এক রাজ্য ছিল, তেমনি কারজাইও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একই ধরনের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শাসক। তাঁর সরকারকে রক্ষা করছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত ভাড়াটে সেনারা। মার্কিনরা আবারও স্বৈরাচারকে পৃষ্ঠপোষকতার সুপরিচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া সাবেক ব্রিটিশ সেনাসদস্য প্যাট্রিক বেরি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘আফগান যুদ্ধ ১৯ শতকের ঔপনিবেশিক সেনাদল নিয়ে অজেয়কে জয়ের চেষ্টার মতো। এ দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পেছনে কী কৌশল ছিল, এখনই বা কী আছে?’ ষাটের দশকে লাওস, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড কমিউনিস্টদের আওতায় চলে যেতে পারত। আর এখন পশতুনিস্তান, বেলুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তানে যুদ্ধের কারণ পশ্চিমাদের সুউচ্চ দালানগুলো আর যেন তালেবান বা আল-কায়েদার আক্রমণের শিকার না হয়। যদিও ২০০১ সালের হামলাকারী খুনিদের অনেকে বেড়ে উঠেছে সৌদি আরবে। কিন্তু সৌদি আরব তো বন্ধুপ্রতিম, মধ্যপন্থী, অভিজাত রাজতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র চালায়, নির্বাচনের বালাই নেই সেখানে।
জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে বৈধতার ধরনটি উদ্বেগজনক। ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে মার্কিন সেনাসদস্যরা অংশ নেওয়ার সময় দাবি করেছিলেন, ভিয়েতনামের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বকে তাঁরা সহায়তা করছেন। ১৯৮২ সালে লেবাননে ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আমিন গেমায়েলকে সহায়তার দাবি করে তাঁরা ক্রিস্টিয়ান মেরোনাইটের পক্ষে গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। আর এখন আফগানিস্তানের নির্বাচনের পর, এখন কারজাই সরকারের পক্ষ নিয়ে মার্কিন সেনারা দক্ষিণ আফগানিস্তানের পশতুন গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এসব গ্রামবাসীর মধ্যে তালেবানের বসতি। কোন গ্রাম হবে পরের মাই লাই? সাংবাদিকদের উচিত ভবিষ্যদ্বাণী করা থেকে বিরত থাকা। এ ক্ষেত্রে আমিও ভাবষ্যদ্বাণী করব না। তবে বর্তমান বাস্তবতা হলো আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের মিশন ব্যর্থ হতে চলেছে।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.