সাংবাদিকতায় শব্দচয়ন -এবিএম মূসা

সারা বিশ্বে সাংবাদিকতার ব্যাপক প্রসার ও বিস্তারলাভ ঘটে এবং নতুন শব্দসম্ভার গড়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যুদ্ধ সমাপ্তির পরও সাংবাদিকতায় ভাষার বিস্তৃতি ও শব্দচয়ন অব্যাহত থাকে। সেই পরিবর্তনের ক্রমবিকাশে সংবাদপত্র নয়া প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, মুদ্রণকৌশল ও সংবাদ-মতামত প্রকাশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে ভাষা ও শব্দের ব্যবহারেও। ব্যাকরণিক আগলমুক্ত হয়ে সংবাদপত্র নিজস্ব ভাষা ও ভাব প্রকাশের রীতি আবিষ্কার করেছে। ইংরেজি ও বাংলা সাংবাদিকতা, উভয় ক্ষেত্রেই এ পরিবর্তন ঘটেছে। সর্বাধিক পরিবর্তন হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিজস্ব প্রয়োজনে এবং চাহিদার তাগিদে যেসব নতুন শব্দ আবিষ্কার করেছে, তার অনেকগুলো বহুদিন ইংরেজি অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে স্থান পায়নি। আবার অনুবাদকৃত শব্দাবলি সংসদ এবং সেকালের বহুল প্রচলিত এ টি দেবের অভিধানেও ঠাঁই পায়নি। তাই সাংবাদিকদের নিজেদেরই সংবাদ পরিবেশনের তাগিদে ভাষাবিদের ভূমিকা নিয়ে কতিপয় সংজ্ঞা ও শব্দ তৈরি করতে হয়েছে। আমি যখন বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্তির কয়েক বছর পর সাংবাদিকতা শুরু করি, তখনো চল্লিশের দশকের শব্দ আবিষ্কারপ্রক্রিয়া বহমান ছিল। প্রথম দিকে শব্দ ও প্রতিশব্দ ব্যবহারে এবং লিখিত অভিব্যক্তি প্রকাশে বিভিন্ন পত্রিকার মধ্যে সমন্বয় ছিল না। একসময়ে অবশ্য সব নতুন চয়ন সর্বজন গৃহীত হয়ে যায়।
আগেই বলেছি, শব্দচয়নপ্রক্রিয়া শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের নাম ও ব্যবহার পাঠকদের অপ্রচলিত শব্দ প্রয়োগে বোঝাতে হয়েছে। এই কাজটি ইংরেজি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সহজ হলেও বাংলায় প্রকাশে ভাষার জটিলতা দেখা দেয়। ট্যাংকের বাংলা প্রতিশব্দ না থাকলেও জঙ্গি বিমান আর সাঁজোয়া গাড়ি পত্রিকার রিপোর্টে স্থান পায়। বোমা থেকে বোমারু, বিশেষ ধরনের বিমানের ক্ষেত্রে বিশেষ্য থেকে বিশেষণে রূপান্তরে মেধার পরিচয় দিয়েছেন সাংবাদিকেরা। যুদ্ধের পর ইংরেজিতে ডিমিলিটারাইজেশন ও কোল্ড ওয়ার অভিধানে ছিল না, সংবাদপত্রের পাতায় ছিল। বাংলা প্রতিশব্দ ‘নিরস্ত্রীকরণ’, ঠান্ডা লড়াই তথা স্নায়ুযুদ্ধ শব্দগুলো ডিকশনারি আর অভিধানে পাওয়া যেত না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সারা বিশ্বে সাংবাদিকতার ভাষায় নতুন শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। তেমনি এই উপমহাদেশে, আরও সীমাবদ্ধ এলাকায় পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কতিপয় শব্দ আহরণে সাংবাদিকদের সহায়তা করেছেন রাজনীতিবিদেরা। রসদ জুগিয়েছে রাজনীতির ধারা পরিবর্তন। ধর্মঘট শব্দটি অভিধানে ছিল। হরতাল ছিল না। পরে ইংরেজি-বাংলা উভয়ে সাংবাদিকতায় ব্যবহূত হয়ে বনেদি অক্সফোর্ড কলিন্স ডিকশনারিতে জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে আমরা পেলাম ‘রাজাকার’ শব্দটি। হায়দরাবাদ রাজ্যটির ভারত-অন্তর্ভুক্তি ঠেকানোর নিষ্ফল প্রচেষ্টায় নবাব তথা নিজাম এই বাহিনী গঠন করেছিলেন। এর আগে বাংলায় ‘মীরজাফর’ ইংরেজিতে লিখতাম ‘ক্যুইসলিং’। দুটি নামই ঐতিহাসিক, একটি বাংলার কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক, অন্যজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে নাজি জার্মানিকে সাহায্যকারী নরওয়ের দেশদ্রোহী। সবই সংবাদপত্রে শব্দ সংযোজনের উদাহরণ।
এবার সংবাদপত্রের শব্দচয়ন নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যটি ব্যাখ্যা করছি। আমার সাংবাদিকতার আদিপর্বে কতগুলো শব্দ পাকিস্তান আমলে পত্রিকার পাতায় ছিল না। স্বাধীন দেশে রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডের বা অপকর্মের বিবরণ এবং রাজনৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় প্রকাশে এসব শব্দ ব্যবহূত হচ্ছে। এসবের অন্যতম হচ্ছে ‘বাজ তথা বাজি।’ পূর্ণাঙ্গ শব্দ নয়, অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষ অর্থ বোঝায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা একাডেমী সংবিধানে একটি মাত্র উদাহরণ খুঁজে পেয়েছি। তা হলো অতীত ও বর্তমান কালের ‘মামলাবাজ।’ বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত ‘রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির’ উদাহরণ প্রদানে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি হচ্ছে নতুন শব্দচয়ন। বাংলা একাডেমীর অভিধানে ‘বাজ’ শব্দটিকে ‘দক্ষ, অভ্যস্ত ইত্যাদি অর্থবাচক অব্যয়’ শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। দুটি শব্দই স্বাধীনতা-উত্তরকালে কতিপয় রাজনীতিবিদ ও তাঁদের দলীয় মদদপ্রাপ্ত পাতিনেতা-কর্মীদের অপকর্মের সংবাদ বিবরণীতে ব্যবহূত হচ্ছে।
তিন দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, অপসংস্কৃতি বিলুপ্ত করবেন। ‘বাজ’দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ যে দলেরই হোক, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সৈয়দ আশরাফের হুঁশিয়ারিতে দলবাজদের দৌরাত্ম্যের কতখানি অবসান ঘটবে, তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। কারণ, পত্রিকার পাতায় ‘যেকোনো দলের’ নয়, একটি দলীয় পরিচয়ধারীদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর ছাপা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই বাজিকরেরা ‘তত্ত্বাবধায়ক’ আমলে আবিষ্কৃত ভূমিদস্যু আর বনখেকোদের কাতারভুক্ত। শেষোক্ত দুই গোষ্ঠীর নামকরণের কৃতিত্বও সাংবাদিকদের। ইতিমধ্যে যোগ হয়েছে ‘নদী দস্যু’ ও ‘বনায়ন খেকো’ শব্দ দুটি।
প্রাথমিক আলোচনার সূত্র ধরে বলছি, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতিতে দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি বর্তমান সরকারের আমলে সদ্য আহরিত শব্দ নয়। অতীতের সরকারের অপরাজনীতির ধারাবাহিকতা মাত্র। কিন্তু দিন বদলের কালে বাজি ও বাজিকরির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধির পরিমাণ এত ব্যাপক যে শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের মন্ত্রী ও দলের মহাসচিবের টনক নড়েছে। তবে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিতে ‘যে দলেরই হোক না কেন’, না বলে সরাসরি ‘আমার দলের’ কথাটি বললেই অধিকতর আশ্বস্ত হতাম।
বাজ আর বাজি নিয়ে ‘গবেষণাভিত্তিক’ আলোচনার ইতি টানার আগে শাহদীন মালিককে ধন্যবাদ জানাই। তিনি বাজ ও বাজি অব্যয়ের সংযোজন করে মিডিয়াকে আরও একটি নতুন শব্দ ‘চ্যানেলবাজ’ উপহার দিয়েছেন (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর) অতি সম্প্রতি সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ১০টি নতুন বেসরকারি চ্যানেলের অনুমোদন প্রদানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তাকে তিনি ‘চ্যানেলবাজি’ বলেছেন।
কী অদ্ভুত ব্যাপার, ‘যেকোনো দলেরই হোক’ টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের অনেক খবরের পাশে স্বয়ং সরকারের ‘চ্যানেলবাজি’ সংবাদপত্রে ও বেসরকারি টেলিভিশনের টক-শোতে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। আশা করছি, সংসদ ও বাংলা একাডেমী অভিধানদ্বয়ের পরবর্তী সংস্করণে ‘বাজ’ শব্দের ব্যাখ্যায় ও উদাহরণ প্রদানে বর্তমান সরকারের অবদান ও শাহদীন মালিকের ‘চ্যানেলবাজ’ শব্দটি সংযুক্ত হবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.