প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কী পেল দেশবাসী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফরকালে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন, যার কিছু বিবরণ পত্র-পত্রিকায় এসেছে। স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষাবিষয়ক ৪টি সমঝোতা স্মারক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব সমঝোতা স্মারকে এমন কোনো বক্তব্য বা শর্ত আছে কিনা যা নিন্মলিখিত ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটিই আমাদের দেখার বিষয়, যেমন- এক. বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক, দুই. বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর অস্ত্র সম্ভারের মান, তিন. বাংলাদেশের অস্ত্র সম্ভারকে এমন একটি সরবরাহ-উৎসের ওপর নির্ভরশীল করা হচ্ছে কিনা, যেটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে, চার. এমন কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে কিনা যেটি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবলকে নিন্মমুখী করতে পারে, পাঁচ. এমন কোনো বন্দোবস্ত বা কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে কিনা যেটি আগামী দুই-চার-দশ বছর চললে বাংলাদেশের ভেতরে এমন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি হবে যারা বলবে, আমাদের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন কী?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেরূপ সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে, সেটি সমসাময়িক কূটনৈতিক রেওয়াজের মানদণ্ডে অভাবনীয়। যেমন, প্রথা ভঙ্গ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিমানবন্দরে এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং প্রথা ভঙ্গ করে শেখ হাসিনাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আবাসিক সুবিধা ও মেহমানদারি করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশীরা সম্মান করবে এটি দেশের জন্য গর্বের বিষয়। তবে অতিরিক্ত যে কোনো কিছুই সন্দেহের উদ্রেক করে। ৩-৪ মাস আগে চীনের প্রেসিডেন্ট যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন থেকেই ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে উষ্মা ও উদ্বেগ দেখা যাচ্ছিল। এর পরপরই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর অতি জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফর করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ৭ দিন আগেও ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। হঠাৎ করেই এত হাই প্রোফাইল ভিজিট কেন? ফেসবুক, পত্র-পত্রিকার কলাম ও সংবাদ ভাষ্য পড়ে এবং টেলিভিশনে টকশোর আলোচনা শুনে আমাদের মনে উদ্বেগ ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ৭ তারিখের আগে থেকেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, কিছু না কিছু একটা স্বাক্ষরিত হবে এবং সেটা স্বাক্ষর করানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত উদগ্রীব। প্রশ্ন দাঁড়ায়, এত খাতির যত্নের কারণ কি তাহলে এটাই অর্থাৎ, তিস্তা নিয়ে চুক্তি হবে না এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতা হবে? প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর উপলক্ষে ফেসবুকে এক ব্যক্তি একটি সুন্দর স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি এরূপ, ‘আমরা ভারতের প্রতি রেখেছি বিশ্বাস, মাননীয় নরেন্দ্র মোদি আমাদের দিয়েছেন আশ্বাস।’
কথাটি তিনি যথার্থই বলেছেন। এখন প্রশ্ন হল, আমাদের বিশ্বাস কি আমরা সঠিক জায়গায় রেখেছি এবং নরেন্দ্র মোদি আমাদের যে আশ্বাস দিয়েছেন সেটি কি সৎ আশ্বাস? এবং এ আশ্বাস নিয়ে আমাদের কতকাল অপেক্ষা করতে হবে সেটিও অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অনেক বিষয়েই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তিস্তার বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। তিস্তার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে তোর্সা নদীকে সামনে আনা হয়েছে, যাতে করে তিস্তার বিষয়টি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না হয়। ১৯৭৪ সালে বেরুবাড়ি ও তিনবিঘা করিডোর নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে আমরা সংসদে সেই চুক্তি অনুমোদন করে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ভারত ৩৯ বছর পর সেই চুক্তি অনুমোদন করে তিনবিঘা দিয়েছে। আমরা ছয় মাসের মধ্যে যেটা দিতে পেরেছি, ভারত সেটি দিতে কেন ৩৯ বছর সময় নিল? ৩৯ বছরের প্রতীক্ষা বড় দীর্ঘ সময় বৈকি। ভারতীয় সংবিধানে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে, কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে কোনো প্রদেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাহলে তিস্তার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি মমতা ব্যানার্জির দ্বারস্থ কেন হবেন? কেন্দ্রীয় সরকারপ্রধান হিসেবে তিস্তার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি তো সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। তাহলে তিনি কেন সেটি করছেন না? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষয়টির পেছনে কাজ করেছে দুই বছর পরের ভারতীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ, অথবা নিছক টালবাহানা ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। সেই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষাবিষয়ক যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হল তার প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা? শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বর্তমান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সার্ক নামক একটি সংস্থা গড়ে ওঠে, যাতে করে একটি ফোরামে ছোট-বড় সব দেশ কথা বলতে পারে এবং একে অপরের প্রতি আঞ্চলিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে।
গত দেড়-দুই বছর ধরে ভারত চেষ্টা করছে সার্ককে সম্পূর্ণভাবে মার্জিনালাইজড বা প্রান্তিকরণ করে ফেলতে, যেটা মোটেই কাম্য নয়। দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে ভারত আমাদের প্রতি সর্বাবস্থায়ই বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করে আসছে। কাজেই আমরা তার সঙ্গে সমান ব্যবহার যেন পাই এমন একটি পরিবেশ ও প্লাটফর্ম প্রয়োজন। এ প্লাটফর্মটি তৈরির জন্যই সার্ক গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সার্কের অবস্থা এখন অনেকটাই ম্লান। সার্কে পাকিস্তানও আছে, ভারতও আছে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। মাঝখানে আমরা যারা তুলনায় ক্ষুদ্র, তাদের উপকার হতো। এখন সার্ককে ভারত একপেশে করে ফেলেছে, আরও একপেশে করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে চায়। মনে হয়, এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে সফলভাবে প্রতিরক্ষাবিষয়ক সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে। দেশের সড়কপথগুলোতে চলাচলকারী আনুমানিক ৭০ ভাগ ট্রাকই ভারত থেকে আমদানি করা এবং আনুমানিক ৭০ ভাগ প্রাইভেট কার জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা। এর অর্থ দাঁড়ায়, ভারত ট্রাক ভালো বানায় এবং দামে কম; অপরদিকে ভারত প্রাইভেট কার ভালো বানায় না। এ কথার মাধ্যমে বোঝাতে চাইছি, পৃথিবীর সব দেশ সবকিছু ভালো বানায় না। ভারত থেকে আমরা ট্রেনের বগি আমদানি করেছি। পরে পত্রিকায় সংবাদ দেখা গেল, বগিগুলো বাজে কাঁচামাল দিয়ে বানানো। সৈয়দপুরে আমাদের রেলওয়ে ওয়ার্কশপে অনেক টাকা খরচ করে সেগুলোকে সংস্কার করতে হয়েছে। তাহলে প্রতিরক্ষা বিষয়ে আমরা তাদের কাছ থেকে যে সরঞ্জাম কিনব, সেগুলোর গুণাগুণ কী হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভারত তো নিজেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের একটি বড় আমদানিকারক। যদি পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের নাম নেয়া হয় যারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানিকারক, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত। সেই দেশ কী করে, বা অন্ততপক্ষে কেনইবা বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করতে চায়! পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর পেছাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন পেছাতে পারেননি। তিনি এপ্রিলেই গিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন তিস্তার বিষয়ে ফলপ্রসূ কিছু নিয়ে আসতে। তিস্তার বিষয়টি যৌথ ঘোষণায় না এলেও নরেন্দ্র মোদির মুখ থেকে মৌখিকভাবে এসেছে। নরেন্দ্র মোদি দারুণ একজন বক্তা। শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে রাখার মতো ক্ষমতা রয়েছে তার। তিনি বলেছেন, আমাদের দুই সরকারের জীবদ্দশায় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। বিষয়টি অনেকটা এ রকম, মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একজন ক্যান্সার রোগী যদি বলেন, আমার জীবদ্দশায় আমি আর এ ফল খাব না। কেননা তাকে তো কোনো ফলই খেতে দেয় না ডাক্তার। যদি তিনি বলতেন, পশ্চিমবঙ্গকে আমি সময় দিলাম ৬ মাস বা ৯ মাস, পশ্চিমবঙ্গ আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলবে, নয়তো আমি কেন্দ্রীয় সরকার হিসেবে স্বাক্ষর করেই ফেলব। সেটাই হতো যুগপৎ সৌজন্য এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন। আর এটা করা নরেন্দ্র মোদির জন্য তেমন একটা কঠিন ছিল না। এমনটা হলে আমরা ১৬ কোটি বাঙালি হয়তো দুরাশার দীর্ঘশ্বাস থেকে রেহাই পেতাম।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.