লেক উন্নয়নের নামে সাগরচুরি
অভিজাত
এলাকায় লেক উন্নয়নের নামে চলছে সাগরচুরি। অর্থ লুট করার জন্যই কিছু কিছু
উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত এবং বছরের পর বছর চলমান রাখা হচ্ছে। এর আগে
খাল কাটার নামে পুকুরচুরির পর এখন লেক উন্নয়নের নামে সাগরচুরির প্রক্রিয়া
হচ্ছে। তিন বছরের কাজ ছয় বছরেও শেষ করতে না পেরে এখন ব্যয় বাড়ছে ছয় গুণেরও
বেশি। নতুন করে তিন একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি
টাকা। নতুন নতুন অঙ্গ যুক্ত করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। অনুমোদিত মেয়াদে কাজ
শেষ না করে এখন ঠিকাদারের জন্য নতুন রেট শিডিউলের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে
আপত্তি এবং সমীক্ষা না করায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয় ও রাজউক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে ময়লা-আবর্জনা ও
জৈবমাটি জমা হওয়ায় লেকের পানির ধারণক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। অবৈধ দখল
থেকে লেক উদ্ধার, উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ২০১০ সালের ৬ জুলাই ৪১০
কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় একনেক থেকে, যা ২০১৩ সালে
শেষ করার কথা। তা না হওয়ায় সময় বাড়ানো হয় আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের
জুন পর্যন্ত। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী
সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এখন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সাল
পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াচ্ছে ২
হাজার ৮৯৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকায়। নতুন করে ব্যয় ও সময় বাড়ানোর জন্য রাজউকের
প্রস্তাবে দেখা যায়, প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যয় প্রায় ছয় গুণ পর্যন্ত
বাড়ছে। এমনকি কাজের পরিমাণ বিভিন্ন অঙ্গে কমলেও ব্যয় বাড়ানোর কথা বলা
হয়েছে। সংশোধিত প্রকল্পে নতুন করে ১৯টি অঙ্গ যুক্ত করা হয়েছে। মূল প্রকল্পে
৮০ দশমিক ১ একর জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল। এখন সংশোধনীতে ৮৩ দশমিক শূন্য ৩
একর অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ৩১৪ কোটি ৬৩
লাখ ৮ হাজার টাকা ধরা হয়। এখন সেই ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ৮৮২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা
হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন করে অধিগ্রহণকৃত তিন একর জমির জন্য ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার
৫৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
এ ক্ষেত্রে প্রায় ছয় গুণ বা ৬০০ শতাংশ ব্যয় প্রস্তাব
করা হয়েছে। হিসাবে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য পড়ছে ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। মূল
প্রস্তাবে ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৪৩ ঘনমিটার লেক খননে ব্যয় ধরা ছিল ৩৯ কোটি ৯৬
লাখ টাকা; কিন্তু নতুন প্রস্তাবে ৯ লাখ ৭ হাজার ৬১১ ঘনমিটারের খননব্যয় ধরা
হয়েছে ৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। খননের পরিমাণ ৪৪ হাজার ঘনমিটার কমলেও ব্যয়
বাড়ছে ৭ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পে ১২ হাজার ৭২৬ ঘনমিটার তীর সংরক্ষণের (সফট
আরমারিং) ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এখন নতুন প্রস্তাবে ১০ হাজার
ঘনমিটার কাজ কমিয়ে ব্যয় কমছে মাত্র ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। রাজউকের দাবি,
চূড়ান্ত নকশার ভিত্তিতে লেকের পাশে ৮৩ দশমিক ৪২ একর ভূমি অধিগ্রহণ, মাটি
ভরাট, পানির গুণগত মান রক্ষা এবং কড়াইল বস্তির বাসিন্দাদের পুনর্বাসন
কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। লেক এলাকায় আটটি সেতু নির্মাণ ও চারটি ওভারপাস
নির্মাণ করা হবে। এর ফলে এটি প্রায় হাতিরঝিলের রূপ পাবে। এসব কারণে
প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, বিশাল সংশোধিত এ প্রকল্পে
কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়নি। যথাযথ সমীক্ষা
ছাড়া এবং বিভিন্ন ভৌতকাজের পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন না করে বেশির ভাগ কাজের ব্যয়
প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাই প্রস্তাবিত কাজের যথার্থতা নিরূপণে সমীক্ষা ও
ডিটেইল ডিজাইন করে ব্যয় পুনঃপ্রাক্কলন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মূল
প্রকল্পে শুধু জমি অধিগ্রহণ ব্যয় সরকারের তহবিল থেকে মেটানোর কথা ছিল।
অন্যান্য ভৌতকাজে রাজউকের তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা। কিন্তু সংশোধনীতে
প্রায় সব ব্যয় সরকারি কোষাগার থেকে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে
শুধু জমির ব্যয় জিওবি থেকে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত ৮৩ একর
জমির মালিকানার ধরন জানতে চেয়ে কমিশন বলছে, তাতে সরকারি জমি থাকলে বুক
ট্রান্সফার করে নেয়া যেতে পারে। প্রকল্প এলাকায় ৪৩ একর জমি বাংলাদেশ
টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) রয়েছে তা এ প্রকল্পে
হস্তান্তর করা উচিত। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে মামলা এড়িয়ে
সমঝোতার মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে
প্রায় ১৩টি মামলা চলমান রয়েছে এগুলোর অগ্রগতি জানা প্রয়োজন। খোঁজ নিয়ে
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে তদানীন্তন ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) গুলশান মডেল টাউন
প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। একই সময়ে প্রায় এক হাজার একর জমি
(বনানী-বারিধারা) আবাসিক ব্যবহারের জন্য উন্নয়নকার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯২ সাল
নাগাদ গুলশান মডেল টাউন এবং আংশিক বানানী ও বারিধারা আবাসিক কার্যক্রম এক
হাজার একর ভূমি উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় শেষ হয়। তবে দুই শ’ একর
এলাকাজুড়ে বিদ্যমান বনানী মডেল ও গুলশান মডেল টাউনের মধ্যে একটি লেক এবং
গুলশান মডেল টাউন ও বারিধারা মডেল টাউনের মধ্যে একটি লেকের উন্নয়নকাজ আজ
পর্যন্ত হয়নি। এ প্রকল্পের আওতায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবৈধ দখল থেকে লেক
পুনরুদ্ধার, লেকে পানি ধারণ ও সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক পরিবেশ
সংরক্ষণের মাধ্যমে ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, লেক এলাকায় বিনোদনমূলক
কার্যক্রমের ব্যবস্থা ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন এবং পানির গুণগত মান
রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়ে বলা
হয়েছে, সংশোধিত প্রকল্পটির কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। যথাযথ
সমীক্ষা ব্যতীত এবং বিভিন্ন কাজের পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত নকশা না করে নতুন
করে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কাজগুলো যথাযথভাবে করার জন্য সমীক্ষা করতে
কমিশন থেকে বলা হয়েছে। এমনকি কড়াইল বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের আদৌ প্রয়োজন
আছে কি না সেটাও পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। এখানে বিটিসিএল যে দরে
জমিঅধিগ্রহণ করেছিল, সেই মূল্য ধরতে বলা হয়েছে। এক শ’ ফুট দীর্ঘ সেতু
নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।
পাশাপাশি আটটি সেতু নির্মাণে ২৬৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ের বিষয়টিও
পর্যালোচনা করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির
ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান
এম হাফিজউদ্দিন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, এগুলো হলো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে
অর্থ লুটপাট। আজ পর্যন্ত— প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি আমি দেখিনি। তিনি বলেন,
৪১০ কোটি টাকার প্রকল্প কিভাবে ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা হয়, এটা
কোনোভাবে বোধগম্য নয়। এভাবেই সরকারি অর্থ লুটপাট হচ্ছে।
No comments