পোশাক শিল্পের জিএসপি সুবিধা ও টিকফা চুক্তি by শেখ মাসুদ কামাল
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি
সুবিধা হারাতে পারে- এ রকম একটা আশঙ্কা রয়েছে। তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডে
শতাধিক শ্রমিক আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট, বিশেষত
এখানকার শ্রমিকদের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ বৃদ্ধি
পেয়েছে।
একই সঙ্গে আলোচনা-সমালোচনাও অনেক হয়েছে। তারপর এই
ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় ঘটে গেল বিশ্বের ইতিহাসে গার্মেন্ট কারখানার
সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়। তাজরীনের পর সবার একটা ধারণা ছিল, গার্মেন্ট শিল্পের
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ অর্থাৎ সরকার, বিজিএমইএ, মালিক, বায়ার ও ব্রান্ড-
সবারই সতর্কতা তৈরি হবে; কিন্তু বিধিবাম। সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে
সমগ্র বিশ্বকে কাঁপিয়ে, সারা দেশকে কাঁদিয়ে আবারও রানা প্লাজাধসের ঘটনায়
বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প বিশ্বের সব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠল।
এখন দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, সভা, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি (জেনারেল সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা প্রত্যাহারের আশঙ্কা; কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা প্রদানের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত? মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যবিষয়ক অফিশিয়াল ওযেবসাইটে স্পষ্টভাবে বলা আছে, 'বিশ্বের ১২৭টি সুবিধাভোগী দেশ থেকে আমদানি করা প্রায় ৫০০০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য এই জিএসপি। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি করা পণ্যে মার্কিন সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করে মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জিএসপির অধীনে যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, তার মধ্যে আছে বহু ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, বিল্ডিং স্টোন, জুয়েলারি, বহু ধরনের কার্পেট এবং কিছু কৃষি ও মৎস্যজাত দ্রব্য। যেসব পণ্য জিএসপি শুল্কমুক্ত সুবিধা-বহির্ভূত, সেগুলোর মধ্যে আছে বস্ত্র ও পোশাক সামগ্রী, বেশির ভাগ জুতা, হাতব্যাগ ও ব্যাগসামগ্রী।' সে কারণে মার্কিন নীতির অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য তাদের প্রদত্ত এই বিশেষ সুবিধার বাইরে। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ শতাংশের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ শতাংশ, কোনো কোনো পণ্যে আরো বেশি। গত বছর বাংলাদেশে উৎপাদিত গার্মেন্ট পণ্যের ২৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ হয়েছে, আর এর শুল্ক বাবদ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রদান করেছে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ঋণ-অনুদানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশির ভাগ পণ্যের শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, শ্রমঘন পণ্য অর্থাৎ যেগুলো গরিব দেশ থেকে আসে, তার অনেকগুলোর ওপরই মার্কিন শুল্কহার অস্বাভাবিকরূপে বেশি, যা গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনো ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আরোপিত আমদানি শুল্কহার ১১ থেকে ৪৮ শতাংশ। আইএমএফ প্রদত্ত একটি সমীক্ষা থেকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনামূলক চিত্রটি স্পষ্ট বোঝা যায়। এ সমীক্ষায় প্রতিফলিত হয়েছে যে এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তিন হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে ফ্রান্সের শুল্ক দিতে হয়েছে ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। সেই একই বছরে ২৫০ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে সমপরিমাণ শুল্ক দিতে হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ফ্রান্সের তুলনায় ১২ ভাগের ১ শতাংশ পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে ফ্রান্সের তুলনায় ১২ গুণ। আর এটাই হচ্ছে বাংলাদেশকে প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার নমুনা।
বেআইনি অভিবাসীদের ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টার কোনো ঠিক নেই। কম্পানি সস্তা মজুরি ও মুনাফার লোভে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। ফলে দেশে তাদের বেকারত্ব বাড়ছে ও কর্মের স্থায়িত্ব বা নিরাপত্তা হ্রাস পাচ্ছে। মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। মার্কিন শ্রমিক সংস্থা (AFL-CEO) তাদের শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমদানি কমাতে চেষ্টা করছে। আর তার সুযোগ নিয়ে মার্কিন প্রশাসন টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্কিং অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ দিচ্ছে। প্রকাশ, এ চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বঙ্গোপসাগরসহ সব ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণের সুবিধা ভোগ করবে। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন 'ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের' গবেষণা থেকে হিসাব করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয় তার ৬০ শতাংশই পায় সে দেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্রান্ড বিক্রেতারা। অথচ উৎপাদনের সঙ্গে তাদের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহন খরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, ১ শতাংশেরও কম। মূলত বিশ্বে বিরাজমান গ্লোবাল মার্কেটে মুনাফার হার খুবই উঁচু।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশ মেধা স্বত্বাধিকারী প্রয়োগের চাপ থেকে কিছুদিন যাবৎ মুক্তি পেয়েছে। আমাদের ওষুধ শিল্প যেমন তারই সুবিধাভোগী, তেমনি আমাদের কম্পিউটার ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন যেহেতু টিকফা চুক্তি অন্য সব আইন-বিধির ঊর্ধ্বে, সুতরাং আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত মেধাস্বত্বের এই ছাড় চাপিয়ে মার্কিন কম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অনেকটা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো থাবা মেলার সুযোগ পেয়ে যাবে এবং এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ, আইটি ও কম্পিউটার সেন্টারগুলো বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে। আমাদের এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো- প্রথমত গার্মেন্ট শিল্পের স্বেচ্ছাচারী মুনাফাখোর শাইলক তথা দানবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। নিহত-আহত ও নিখোঁজ পরিবারকে একটি গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকের জীবনমান ও কর্মপরিবেশের প্রমিত (Standard) মান নির্ধারণ ও নিশ্চিত করতে হবে। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিএসপি সুবিধা আদায় নয়, বরং আমাদের পোশাক শিল্পের সার্বিক পরিবেশ একটি গ্রহণযোগ্য মানে উন্নীত করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিএসপি সুবিধা আদায় করতে হবে এবং এ দাবি নিয়ে আমাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোচ্চার ও সক্রিয় থাকতে হবে। আর এ লক্ষ্যে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো দক্ষ, শক্তিশালী ও বেগবান করতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের রপ্তানি কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আফ্রো-এশিয়ার সম্ভাবনাময় বাজারের দিকে এটাকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
এখন দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, সভা, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি (জেনারেল সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা প্রত্যাহারের আশঙ্কা; কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা প্রদানের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত? মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যবিষয়ক অফিশিয়াল ওযেবসাইটে স্পষ্টভাবে বলা আছে, 'বিশ্বের ১২৭টি সুবিধাভোগী দেশ থেকে আমদানি করা প্রায় ৫০০০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য এই জিএসপি। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি করা পণ্যে মার্কিন সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করে মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জিএসপির অধীনে যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, তার মধ্যে আছে বহু ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, বিল্ডিং স্টোন, জুয়েলারি, বহু ধরনের কার্পেট এবং কিছু কৃষি ও মৎস্যজাত দ্রব্য। যেসব পণ্য জিএসপি শুল্কমুক্ত সুবিধা-বহির্ভূত, সেগুলোর মধ্যে আছে বস্ত্র ও পোশাক সামগ্রী, বেশির ভাগ জুতা, হাতব্যাগ ও ব্যাগসামগ্রী।' সে কারণে মার্কিন নীতির অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য তাদের প্রদত্ত এই বিশেষ সুবিধার বাইরে। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ শতাংশের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ শতাংশ, কোনো কোনো পণ্যে আরো বেশি। গত বছর বাংলাদেশে উৎপাদিত গার্মেন্ট পণ্যের ২৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ হয়েছে, আর এর শুল্ক বাবদ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রদান করেছে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ঋণ-অনুদানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশির ভাগ পণ্যের শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, শ্রমঘন পণ্য অর্থাৎ যেগুলো গরিব দেশ থেকে আসে, তার অনেকগুলোর ওপরই মার্কিন শুল্কহার অস্বাভাবিকরূপে বেশি, যা গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনো ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আরোপিত আমদানি শুল্কহার ১১ থেকে ৪৮ শতাংশ। আইএমএফ প্রদত্ত একটি সমীক্ষা থেকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনামূলক চিত্রটি স্পষ্ট বোঝা যায়। এ সমীক্ষায় প্রতিফলিত হয়েছে যে এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তিন হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে ফ্রান্সের শুল্ক দিতে হয়েছে ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। সেই একই বছরে ২৫০ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে সমপরিমাণ শুল্ক দিতে হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ফ্রান্সের তুলনায় ১২ ভাগের ১ শতাংশ পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে ফ্রান্সের তুলনায় ১২ গুণ। আর এটাই হচ্ছে বাংলাদেশকে প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার নমুনা।
বেআইনি অভিবাসীদের ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টার কোনো ঠিক নেই। কম্পানি সস্তা মজুরি ও মুনাফার লোভে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। ফলে দেশে তাদের বেকারত্ব বাড়ছে ও কর্মের স্থায়িত্ব বা নিরাপত্তা হ্রাস পাচ্ছে। মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। মার্কিন শ্রমিক সংস্থা (AFL-CEO) তাদের শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমদানি কমাতে চেষ্টা করছে। আর তার সুযোগ নিয়ে মার্কিন প্রশাসন টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্কিং অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ দিচ্ছে। প্রকাশ, এ চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বঙ্গোপসাগরসহ সব ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণের সুবিধা ভোগ করবে। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন 'ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের' গবেষণা থেকে হিসাব করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয় তার ৬০ শতাংশই পায় সে দেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্রান্ড বিক্রেতারা। অথচ উৎপাদনের সঙ্গে তাদের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহন খরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, ১ শতাংশেরও কম। মূলত বিশ্বে বিরাজমান গ্লোবাল মার্কেটে মুনাফার হার খুবই উঁচু।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশ মেধা স্বত্বাধিকারী প্রয়োগের চাপ থেকে কিছুদিন যাবৎ মুক্তি পেয়েছে। আমাদের ওষুধ শিল্প যেমন তারই সুবিধাভোগী, তেমনি আমাদের কম্পিউটার ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন যেহেতু টিকফা চুক্তি অন্য সব আইন-বিধির ঊর্ধ্বে, সুতরাং আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত মেধাস্বত্বের এই ছাড় চাপিয়ে মার্কিন কম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অনেকটা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো থাবা মেলার সুযোগ পেয়ে যাবে এবং এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ, আইটি ও কম্পিউটার সেন্টারগুলো বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে। আমাদের এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো- প্রথমত গার্মেন্ট শিল্পের স্বেচ্ছাচারী মুনাফাখোর শাইলক তথা দানবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। নিহত-আহত ও নিখোঁজ পরিবারকে একটি গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকের জীবনমান ও কর্মপরিবেশের প্রমিত (Standard) মান নির্ধারণ ও নিশ্চিত করতে হবে। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিএসপি সুবিধা আদায় নয়, বরং আমাদের পোশাক শিল্পের সার্বিক পরিবেশ একটি গ্রহণযোগ্য মানে উন্নীত করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিএসপি সুবিধা আদায় করতে হবে এবং এ দাবি নিয়ে আমাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোচ্চার ও সক্রিয় থাকতে হবে। আর এ লক্ষ্যে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো দক্ষ, শক্তিশালী ও বেগবান করতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের রপ্তানি কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আফ্রো-এশিয়ার সম্ভাবনাময় বাজারের দিকে এটাকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
No comments