সমুদ্র বিজয় ও পরবর্তী পদক্ষে by পডা. মো. ফজলুল হক
বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে বহু
দিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে প্রথম চিঠি চালাচালি শুরু হয় ১৯৭৪
সালের ১৬ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। প্রয়োজনীয় অর্থ, দক্ষ জনবল ও
সঠিক প্রযুক্তির অভাবে এ কাজটি বন্ধ থাকে প্রায় ৩৫ বছর।
বর্তমান
সরকার ২০০০ সালে ফরাসি সরকারের অর্থায়নে নৌবাহিনী চট্টগ্রামে
হাইড্রোগ্রাফিক ও ওশানগ্রাফি সেন্টার স্থাপন করলে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে
কাজের গতি সঞ্চারিত হয় এবং ২০০৯ সালে যথারীতি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ
পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। স্বল্পতম সময়ে সমুদ্র জরিপের জন্য বর্তমান সরকার ৮০
কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। নৌবাহিনী সততা ও দক্ষতার সঙ্গে মাত্র ২৫ কোটি টাকা
ব্যয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জরিপের কাজটি শেষ করে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে
হাইড্রোগ্রাফিক জাহাজ দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করে ব্রিটেন। ২০১০ সালের
সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমান সরকার নৌবাহিনীকে একটি আধুনিক হাইড্রোগ্রাফার
অনুসন্ধান জাহাজ হস্তান্তর করলে দ্রুতগতিতে সমুদ্র জরিপের কাজ চলতে থাকে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট তথ্যাদিসহ নথিপত্র জমাদানের শেষ সময়
নির্ধারিত থাকলেও প্রায় ছয় মাস আগেই আবেদনটি জমা পড়ে। ২৬ আগস্ট ২০১১
তারিখের মধ্যে আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হলে এ অর্জন কোনো দিনই সম্ভব হতো না।
আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদনের ক্ষেত্রে, দেশের অবস্থান, সমুদ্রসৈকতের
দৈর্ঘ্য, সমুদ্রের তলদেশের ভূতাত্তি্বক অবস্থা ইত্যাদি পর্যালোচনা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত
সমুদ্র আইনের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ বাংলাদেশের
পক্ষে আবেদন করা হয়। ফলে গত ১৪ মার্চ ২০১২ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ২০০
নটিক্যাল মাইল অর্থাৎ এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব
সীমানা এবং মহিসোপানে প্রবেশের পথসহ বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেন। এ বিশাল
অর্জন স্বাধীনতার ৪২ বছরে আর দ্বিতীয়টি হয়নি। এ অর্জন ধরে রাখতে প্রয়োজন
দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে উন্নয়নে সহযোগিতা করা। তেল, গ্যাস, মাছসহ
প্রয়োজনীয় সম্পদ রক্ষা ও এর আহরণে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে সৎ ও
দক্ষ জনবল অপরিহার্য। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, কোনো খনিজ সম্পদ উত্তোলনে
সিংহভাগ দিতে হয় বিদেশি কম্পানিকে। সুতরাং খনিজ সম্পদ উত্তোলনে বিদেশি
নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তবেই তেল-গ্যাসের অভাবমুক্ত হবে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ঘনকিলোমিটার সমুদ্রের পানিতে স্বর্ণ রয়েছে ৩৭ কেজি।
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে মৎস্য বিজ্ঞানীর অভিমত) লবণ সংগৃহীত হয়
বছরে তিন লাখ ৫০ হাজার টন। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ৪৭৫ প্রজাতির মাছের
মধ্যে চিংড়ি রয়েছে ৩৬ প্রজাতির। বছরে ইলিশ মাছ আহরিত হবে প্রায় চার লাখ টন,
যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য মাছের
বাজারমূল্য এর চেয়েও অনেক বেশি। এ ছাড়া রয়েছে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, শৈবাল,
ক্লোরিন, ফ্লোরিন, আয়োডিনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পদার্থ, যা প্রাকৃতিক নিয়মেই
উৎপন্ন হতে থাকবে। শুধু আহরণ, প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ ও বিপণন করতে হবে
মাত্র। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ
মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। কারণ এর আগে ২৮টি ব্লকের মধ্যে
মিয়ানমারের দাবি ছিল ১৭টি ও ভারতের ১০টি। বাংলাদেশের মধ্যে ছিল মাত্র একটি
এবং অন্যটির অংশবিশেষ। আনন্দের বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক রায়ে বাংলাদেশ পেয়েছে
১২টি ব্লক ও মিয়ানমার পাঁচটি। ১৪ ই মার্চ দিবসটি আমাদের সবার জন্যই অমর
হয়ে থাকবে 'সমুদ্র বিজয় দিবস' হিসেবে। বিশাল এ অর্জনের ক্ষেত্রে বর্তমান
সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। কয়েকটি
দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নৌবাহিনীর
হাইড্রোগ্রাফিক বিষয়ে দক্ষতা প্রশংসিত হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রকাশিত
হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট ও প্রকাশনাগুলো আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় তা বিশ্বের
অন্যান্য দেশে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে নাবিকদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের ও আনন্দের। আমাদের এ অর্জন অনেক বড়,
অপ্রত্যাশিত। সমুদ্র জয়ে বাংলাদেশের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি
পেয়েছে কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিধি। তেল-গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও এর উত্তোলনে
প্রয়োজন দেশি-বিদেশি দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও
মেশিনারিজ। সমুদ্র জলসীমানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উদ্ধারকাজে ব্যবহারের
বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই এ বছর প্রথমবারের মতো আমদানি করা হলো জার্মানির
তৈরি অত্যাধুনিক ডর্নিয়ার ২২৮ এনজি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট বা সমুদ্র
টহল বিমান। আরো একটি সমুদ্র টহল বিমান এ বছরই সংযুক্ত হবে বলেও আভাস পাওয়া
গেছে। এ বিমানটি ট্যাংকভর্তি জ্বালানি নিয়ে ৯৫২ নটিক্যাল মাইল পথ অতিক্রম
এবং একটানা ১০ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। হাইড্রোগ্রাফিক বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির
লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে বর্তমান সরকার। সমুদ্র
সম্পদ দেশি প্রযুক্তিতে সৎ ও দক্ষ জনবল দ্বারা আহরিত হলে রাষ্ট্রীয়
কোষাগারও ভারী হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত জলজপ্রাণী
এবং খনিজ সম্পদ আহরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ অচিরেই মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত
হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, পাশের দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বহু
দিনের বৈরিতার অবসান হয়েছে এবং আমাদের পাওনা সঠিক ও স্থায়ীভাবে হস্তগত
হয়েছে।
লেখক : প্রফেসর, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
fhoque.hstu@gmail.com
লেখক : প্রফেসর, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
fhoque.hstu@gmail.com
No comments