সাদাকালো-আতাতুর্কের তুরস্কেও নয়া গণজাগরণ by আহমদ রফিক
বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তির
শিকড় ধরে টান দিয়েছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাসমর। উপনিবেশগুলোতে
মুক্তিসংগ্রামের ঢেউ ওঠে। এশিয়া ও আফ্রিকায়। পরে দক্ষিণ আমেরিকাতেও সে
ঢেউয়ের বিস্তার।
কবির ভাষায়- 'পশ্চিমে সূর্যাস্তের
আবীর/দেশে দেশে পড়ন্ত প্রাচীর।' যুদ্ধবিধ্বস্ত উপনিবেশবাদ উঠে দাঁড়াতে
সচেষ্ট। এ সুযোগে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বমহিমায়
আবির্ভূত। 'পশ্চিমা গণতন্ত্র তার নাম'। তবে তার ধরন-ধারণ আধুনিক। কৌশল
ভিন্ন। গণতন্ত্রের নামে, আপন স্বার্থ উদ্ধারে দুর্বল সাগরেদদের 'সঙ্গোপনে
রসদ জোগায়'।
বিশের দশকে রাজতন্ত্রের শিকড় উপড়ে সেক্যুলার আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। শুধু নজরুলের কামাল বন্দনাই নয়, রবীন্দ্রনাথও তরুণ তুর্কি ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক কামাল পাশার জয়গান গেয়েছিলেন। মুসলিম জাহানের জন্য গণতান্ত্রিক বিস্ময় তৎকালীন তরুণ তুরস্ক। তবু সেক্যুলার তুর্কি জাতীয়তাবাদ মুসলিম রাজনৈতিক বিশ্বে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, ধর্মীয় সংস্কার তখন এতই প্রবল। তবে তুর্কি সমাজে ও তাদের সেনাবাহিনীতে সংঘটিত পরিবর্তন ওপরতলীয় ছিল না।
তাই দীর্ঘকাল পর শাসকদের ভুল-ভ্রান্তি, অর্থনৈতিক সমস্যা, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব সেক্যুলার তুরস্কের আদর্শগত বিচ্যুতি ঘটানোর পর চাপাপড়া ধর্মীয় রাজনীতির নমনীয় উত্থান ঘটানোও সাম্রাজ্যবাদ তোষণ সত্ত্বেও তুর্কি সমাজ ও সেনাবাহিনী সর্বাংশে বিকিয়ে যায়নি। তবে কুর্দি জাতীয়তাবাদীদের অব্যাহত মুক্তিসংগ্রামের চাপ ঠেকাতে বিব্রত তুর্কি সরকার মিত্র হিসেবে কাছে টেনেছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। কামাল পাশার রাজনৈতিক আদর্শ এভাবে তুরস্কে প্রবল টানাপড়েনের সম্মুখীন- মূলত সুশাসনের অভাব এর কারণ।
সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক তুর্কি জাতীয়তাবাদের প্রভাব কতটা ছিল বলা কঠিন, তবে কয়েক দশক পর আরব বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আরব জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠায় পথিকৃৎ নাসেরের গণতান্ত্রিক মিসর। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নব্য মিসরের প্রতিষ্ঠা। রাজা ফারুক নির্বাসনে। এরপর ইরাকে বাথ-সোশ্যালিস্টদের হাতে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ। সংলগ্ন সিরিয়ায়ও একইভাবে বাথ পার্টির রাষ্ট্র শাসন কায়েম। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কারণে এরা ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল। একই ধারায় লিবিয়া।
একসময় তিউনিসিয়া, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া রক্ষণশীল আরব দুনিয়ায় আরব জাতীয়তাবাদের যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে স্বপ্ন তাদেরই শাসনগত ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে টিকে থাকেনি। আরো দুঃখজনক যে কুর্দি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে ইরাক-তুরস্ক প্রচণ্ড নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল। কুর্দিদের জন্য ভাগ্যের পরিহাস যে বুশ-ব্লেয়ারের অন্যায়ভাবে ইরাক জবরদখলের পর প্রাথমিক পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন একজন কুর্দি রাজনীতিক। কিন্তু তাতেও কুর্দিদের ভাগ্যে বিশ্বাসেরও শিকে ছিঁড়েনি। সাদ্দাম হত্যা তাদের জন্য কোনো শুভবার্তা বয়ে আনেনি।
এ অঞ্চলে রাজনীতির এ-জাতীয় দাবাখেলায় সর্বাধিক লাভবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এবং সহচর ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী। কিছুটা স্বস্তি তুরস্কেরও তাদের রাজনৈতিক বিষফোঁড়া কুর্দিদের সঙ্গে সম্প্রতি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর। কাজেই গণতন্ত্রের, ইসলামীতন্ত্রের নিয়ম-কানুন বিসর্জন দিয়ে বিনা প্ররোচনায় সিরিয়ার বিরুদ্ধে তৎপর তুরস্ক, বলাই বাহুল্য প্রভুর নির্দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাস সদস্য হওয়ার প্রবল খায়েশে সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে অনেক দিন থেকে তৎপর তুরস্ক। আতাতুর্কের যোগ্য উত্তর-শাসক বটে। আর এখন ইসলামপন্থী এরদোয়ানের মূল লক্ষ্য তাঁর শাসনক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা মূলত ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুদের সহায়তায়। বিনিময়ে মার্কিনি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ করে মার্কিন করপোরেট পুঁজির কাছে দেশীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে দেশে ইসলামী আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চিরাচরিত পন্থাই গ্রহণ করেছে এরদোয়ানের সরকার। কিন্তু দুই দিক সামাল দেওয়ার চেষ্টা মোটেই সহজ নয়। কারণ এখনো তুরস্কের মূল সেক্যুলার রাজনৈতিক পার্টি বেশ শক্তিশালী, যদিও বিরোধী রেঞ্চে তাদের ঠাঁই।
দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকার ফলে অনেক ক্ষেত্রে জনস্বার্থের প্রতি যে উদাসীনতার প্রকাশ ঘটে, যাকে বলা যায় 'ক্ষমতাসীন সিনড্রোম' তার টানে তাদের রাজনৈতিক পতন রোধ করতে পারেনি সেক্যুলার তুর্কি সামরিক বাহিনী। সময়ের ধারায় সেখানেও ঘটে সংমিশ্রণ। আমলাতন্ত্র বরাবরই সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক, সমর্থক বিদেশি করপোরেট পুঁজির। এরদোয়ান সরকারের কল্যাণে তুর্কি সমাজে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। জন্ম নিয়েছে শক্তিশালী রক্ষণশীল পুঁজিবাদী শ্রেণী, যাদের প্রতিনিধি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী।
দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার যে সমস্যা, সেই সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী সামাজিক পরিবর্তনের ফলে অনিবার্য জনবিচ্ছিন্নতা প্রতিবাদী শক্তির গোকুলে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা শাসকশ্রেণী কখনো হিসাবে আনে না, আনেননি এরদোয়ান। আশপাশে বিদ্যুৎ ঝলকানি দেখেও বিপদের কথা মনে হয়নি। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়া, সর্বশেষ সিরিয়া তারুণ্যপ্রধান গণ-অভ্যুত্থান তথা আরব বসন্তের ঘটনাবলি দেখে দেখে বেশ খোশ মেজাজেই ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। পেছনে বিশাল মোটা খুঁটি, সেখানে বাঁধা দড়ি, ভয়ের কিছু নেই।
হোসনি মুবারকের সহায়ক দড়িও ছিল যথেষ্ট মোটা ও শক্তিমান। কিন্তু তাহ্রির স্কয়ারের গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি ও চরিত্র লক্ষ করেই বোধ হয় দীর্ঘদিনের মিত্রকে ছেড়ে দিতে সেই পরাশক্তির নীতিতে বাধেনি। ডুবন্ত জাহাজকে ডুবতে দেওয়া বরাবরই মার্কিন রণকৌশল। নতুন মিত্র বানিয়ে নেওয়া তাদের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। মার্কিন বিদেশনীতির বিশ্বকোষে এ-জাতীয় তথ্যাবলিতে ভরপুর। তবে যেখানে স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব সেখানে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপস্থিত থাকে। যেমন লিবিয়া, বর্তমানে সিরিয়া। আর সিরিয়ার ক্ষেত্রে তাদের অন্যতম হাতিয়ার তুর্কি সরকার। কিন্তু তুর্কি সরকারের মাথাব্যথা নেই তুর্কি জনগণ বাইরের ঝগড়া ঘরে টেনে আনা পছন্দ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার।
সম্প্রতি একনায়কী অর্থাৎ একক শক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বে ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতির উত্থান দেখা দিচ্ছে। ক্লাসিক্যাল শ্রেণী-সংগ্রামের পিছু হটার কারণেও এমনটা ঘটে থাকতে পারে। শূন্যতার পূরণ কোনো না কোনোভাবে ঘটে, তা বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত যে পথেই হোক। আকস্মিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এর বৈশিষ্ট্য। এরা কোথাও সফল, কোথাও ব্যর্থ। আবার কখনো এদের সাফল্য ছিনতাই করে চতুর পার্শ্বশক্তি। মিসরীয় আরব বসন্তের গণ-অভ্যুত্থানে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতা দখল এর পরোক্ষ উদাহরণ।
এ প্রতিবাদী ব্যতিক্রমী শক্তি মূলত তারুণ্য। তাদের অপ্রাপ্তি, তাদের ক্ষোভ, তাদের বেকারত্ব, তাদের হতাশা কোনো না কোনো রাজনৈতিক উপলক্ষ ঘিরে স্ফুলিঙ্গপাত ঘটায়, জ্বলে ওঠে আগুন। চলে শাসকপক্ষে চরম দমননীতি। প্রতিক্রিয়ায় ছুটে আসে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষও। এরপর প্রতিবাদী বিক্ষোভ পার্ক বা চত্বর ঘিরে ক্রমে তা উপচে জনসমুদ্র- দিনরাত্রি একাকার ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে থাকে খেয়ে, না খেয়ে। পুলিশ বা সেনাবাহিনী কখনো কাজে আসে, কখনো আসে না।
মিসর থেকে লিবিয়া- চরিত্রটা একটু ভিন্ন। এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে বিদেশি মদদে সমৃদ্ধ করে তোলা হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে। ঠিক একই ঘটনা সিরিয়ায়। দুই মার্কিনবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে তাঁবেদার শক্তি বসিয়ে গোটা অঞ্চল নিরুপদ্রব করতে হবে। কিন্তু সিরিয়ার বেলায় বিধিবাম, যদিও সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বলেই ফেলেছেন, 'সিরিয়ায় পশ্চিমারা যুদ্ধ করছে।' বিধিবাম, কারণ চীন, রাশিয়া বিশেষ করে রাশিয়া। লিবিয়ায় ঘটে যাওয়া ভুলটার পুনরাবৃত্তি বোধ হয় ওরা চায় না। তাই সিরিয়া যুদ্ধ পশ্চিমাদের এত সাহায্য সত্ত্বেও শেষ হচ্ছে না।
এর মধ্যে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাত। আবার সেই তারুণ্যের বসন্ত নির্ঘোষের মতো একই চরিত্রের প্রতিবাদ ইস্তাম্বুলে পার্ক ও প্রাকৃত পরিবেশ রক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে। আসলে এটা উপলক্ষ। সঞ্চিত নানা মাত্রিক সরকারবিরোধী ক্ষোভের বিস্ফোরণে লাখো মানুষের জমায়েত। অবস্থা বুঝে পিছু হটেছে তুরস্ক সরকার। কিন্তু হুজুগ মিটছে না। বেকায়দা অবস্থায় এরদোয়ান। এ অবস্থা চলতে থাকলে ইঙ্গ-মার্কিন, ব্রিটিশ-ফরাসি প্রভুদের পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র, রণসম্ভার, খাদ্যসামগ্রী তুরস্কের মাধ্যমে সিরীয় বিদ্রোহীদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে বিষয়টা স্পষ্ট হতে থাকবে প্রধানমন্ত্রী তারুণ্যের এ জাগরণ স্তব্ধ করে দিতে পারবেন কি না। তারুণ্য তাদের তাৎক্ষণিক দাবি পূরণের পর ঘরে ফিরে যেতে চাইবে কি না। তবে ঘটনা বলে, বামপন্থী দলগুলোসহ সরকারবিরোধী সবাই এখন তারুণ্যের সঙ্গে একাত্ম। শোনা যাচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষও তাদের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসছে। সবারই লক্ষ্য বর্তমান শাসনক্ষমতার রদবদল। আর নয় ইঙ্গ-মার্কিন-বশংবদ সরকার। এখন অপেক্ষা এর পরিণতি লক্ষ করার। এর প্রভাব কতটা পড়বে সিরীয় যুদ্ধের ওপর, তা দেখার।
মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দুনিয়ার দেশগুলোকে ঘিরে এতকাল পর তারুণ্যের এই আকস্মিক প্রতিবাদী জাগরণ কি বিশেষ ক্ষেত্রে থেমে যাবে, নাকি প্রতিবাদী নবধারার জন্ম দেবে- ধীরে ধীরে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করে রাজতন্ত্রী বাদ বাকি দেশগুলোকে পরিবর্তনের জোয়ারে টেনে আনবে এবং শাহী মসনদে গণতান্ত্রিক শাসনের পতাকা উড়বে। বিষয়টা নির্ভর করবে বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ওপর। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অনেক সময় প্রচণ্ড সম্ভাবনাও ব্যর্থতায় শেষ হয়, ইতিহাসে নজির কম নেই। তবু এই বিশেষ ধারার জাগরণ যা বাংলাদেশেও দেখা গেছে, হতে পারে এই আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য, যেখানে ইতিবাচক ভবিষ্যৎই হয়তো প্রধান হয়ে দাঁড়াবে। আমরা অপেক্ষায় বাস্তব দর্শনের। প্রগতিশীল গণতন্ত্রী-উত্থান সব সময় বাঁধাধরা পথে চলে না। আরব বসন্তে তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বড় দরকার একে সংহত রূপ দেওয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্ব।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
বিশের দশকে রাজতন্ত্রের শিকড় উপড়ে সেক্যুলার আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। শুধু নজরুলের কামাল বন্দনাই নয়, রবীন্দ্রনাথও তরুণ তুর্কি ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক কামাল পাশার জয়গান গেয়েছিলেন। মুসলিম জাহানের জন্য গণতান্ত্রিক বিস্ময় তৎকালীন তরুণ তুরস্ক। তবু সেক্যুলার তুর্কি জাতীয়তাবাদ মুসলিম রাজনৈতিক বিশ্বে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, ধর্মীয় সংস্কার তখন এতই প্রবল। তবে তুর্কি সমাজে ও তাদের সেনাবাহিনীতে সংঘটিত পরিবর্তন ওপরতলীয় ছিল না।
তাই দীর্ঘকাল পর শাসকদের ভুল-ভ্রান্তি, অর্থনৈতিক সমস্যা, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব সেক্যুলার তুরস্কের আদর্শগত বিচ্যুতি ঘটানোর পর চাপাপড়া ধর্মীয় রাজনীতির নমনীয় উত্থান ঘটানোও সাম্রাজ্যবাদ তোষণ সত্ত্বেও তুর্কি সমাজ ও সেনাবাহিনী সর্বাংশে বিকিয়ে যায়নি। তবে কুর্দি জাতীয়তাবাদীদের অব্যাহত মুক্তিসংগ্রামের চাপ ঠেকাতে বিব্রত তুর্কি সরকার মিত্র হিসেবে কাছে টেনেছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। কামাল পাশার রাজনৈতিক আদর্শ এভাবে তুরস্কে প্রবল টানাপড়েনের সম্মুখীন- মূলত সুশাসনের অভাব এর কারণ।
সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক তুর্কি জাতীয়তাবাদের প্রভাব কতটা ছিল বলা কঠিন, তবে কয়েক দশক পর আরব বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আরব জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠায় পথিকৃৎ নাসেরের গণতান্ত্রিক মিসর। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নব্য মিসরের প্রতিষ্ঠা। রাজা ফারুক নির্বাসনে। এরপর ইরাকে বাথ-সোশ্যালিস্টদের হাতে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ। সংলগ্ন সিরিয়ায়ও একইভাবে বাথ পার্টির রাষ্ট্র শাসন কায়েম। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কারণে এরা ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল। একই ধারায় লিবিয়া।
একসময় তিউনিসিয়া, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া রক্ষণশীল আরব দুনিয়ায় আরব জাতীয়তাবাদের যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে স্বপ্ন তাদেরই শাসনগত ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে টিকে থাকেনি। আরো দুঃখজনক যে কুর্দি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে ইরাক-তুরস্ক প্রচণ্ড নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল। কুর্দিদের জন্য ভাগ্যের পরিহাস যে বুশ-ব্লেয়ারের অন্যায়ভাবে ইরাক জবরদখলের পর প্রাথমিক পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন একজন কুর্দি রাজনীতিক। কিন্তু তাতেও কুর্দিদের ভাগ্যে বিশ্বাসেরও শিকে ছিঁড়েনি। সাদ্দাম হত্যা তাদের জন্য কোনো শুভবার্তা বয়ে আনেনি।
এ অঞ্চলে রাজনীতির এ-জাতীয় দাবাখেলায় সর্বাধিক লাভবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এবং সহচর ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী। কিছুটা স্বস্তি তুরস্কেরও তাদের রাজনৈতিক বিষফোঁড়া কুর্দিদের সঙ্গে সম্প্রতি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর। কাজেই গণতন্ত্রের, ইসলামীতন্ত্রের নিয়ম-কানুন বিসর্জন দিয়ে বিনা প্ররোচনায় সিরিয়ার বিরুদ্ধে তৎপর তুরস্ক, বলাই বাহুল্য প্রভুর নির্দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাস সদস্য হওয়ার প্রবল খায়েশে সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে অনেক দিন থেকে তৎপর তুরস্ক। আতাতুর্কের যোগ্য উত্তর-শাসক বটে। আর এখন ইসলামপন্থী এরদোয়ানের মূল লক্ষ্য তাঁর শাসনক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা মূলত ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুদের সহায়তায়। বিনিময়ে মার্কিনি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ করে মার্কিন করপোরেট পুঁজির কাছে দেশীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে দেশে ইসলামী আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চিরাচরিত পন্থাই গ্রহণ করেছে এরদোয়ানের সরকার। কিন্তু দুই দিক সামাল দেওয়ার চেষ্টা মোটেই সহজ নয়। কারণ এখনো তুরস্কের মূল সেক্যুলার রাজনৈতিক পার্টি বেশ শক্তিশালী, যদিও বিরোধী রেঞ্চে তাদের ঠাঁই।
দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকার ফলে অনেক ক্ষেত্রে জনস্বার্থের প্রতি যে উদাসীনতার প্রকাশ ঘটে, যাকে বলা যায় 'ক্ষমতাসীন সিনড্রোম' তার টানে তাদের রাজনৈতিক পতন রোধ করতে পারেনি সেক্যুলার তুর্কি সামরিক বাহিনী। সময়ের ধারায় সেখানেও ঘটে সংমিশ্রণ। আমলাতন্ত্র বরাবরই সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক, সমর্থক বিদেশি করপোরেট পুঁজির। এরদোয়ান সরকারের কল্যাণে তুর্কি সমাজে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। জন্ম নিয়েছে শক্তিশালী রক্ষণশীল পুঁজিবাদী শ্রেণী, যাদের প্রতিনিধি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী।
দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার যে সমস্যা, সেই সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী সামাজিক পরিবর্তনের ফলে অনিবার্য জনবিচ্ছিন্নতা প্রতিবাদী শক্তির গোকুলে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা শাসকশ্রেণী কখনো হিসাবে আনে না, আনেননি এরদোয়ান। আশপাশে বিদ্যুৎ ঝলকানি দেখেও বিপদের কথা মনে হয়নি। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়া, সর্বশেষ সিরিয়া তারুণ্যপ্রধান গণ-অভ্যুত্থান তথা আরব বসন্তের ঘটনাবলি দেখে দেখে বেশ খোশ মেজাজেই ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। পেছনে বিশাল মোটা খুঁটি, সেখানে বাঁধা দড়ি, ভয়ের কিছু নেই।
হোসনি মুবারকের সহায়ক দড়িও ছিল যথেষ্ট মোটা ও শক্তিমান। কিন্তু তাহ্রির স্কয়ারের গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি ও চরিত্র লক্ষ করেই বোধ হয় দীর্ঘদিনের মিত্রকে ছেড়ে দিতে সেই পরাশক্তির নীতিতে বাধেনি। ডুবন্ত জাহাজকে ডুবতে দেওয়া বরাবরই মার্কিন রণকৌশল। নতুন মিত্র বানিয়ে নেওয়া তাদের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। মার্কিন বিদেশনীতির বিশ্বকোষে এ-জাতীয় তথ্যাবলিতে ভরপুর। তবে যেখানে স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব সেখানে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপস্থিত থাকে। যেমন লিবিয়া, বর্তমানে সিরিয়া। আর সিরিয়ার ক্ষেত্রে তাদের অন্যতম হাতিয়ার তুর্কি সরকার। কিন্তু তুর্কি সরকারের মাথাব্যথা নেই তুর্কি জনগণ বাইরের ঝগড়া ঘরে টেনে আনা পছন্দ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার।
সম্প্রতি একনায়কী অর্থাৎ একক শক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বে ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতির উত্থান দেখা দিচ্ছে। ক্লাসিক্যাল শ্রেণী-সংগ্রামের পিছু হটার কারণেও এমনটা ঘটে থাকতে পারে। শূন্যতার পূরণ কোনো না কোনোভাবে ঘটে, তা বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত যে পথেই হোক। আকস্মিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এর বৈশিষ্ট্য। এরা কোথাও সফল, কোথাও ব্যর্থ। আবার কখনো এদের সাফল্য ছিনতাই করে চতুর পার্শ্বশক্তি। মিসরীয় আরব বসন্তের গণ-অভ্যুত্থানে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতা দখল এর পরোক্ষ উদাহরণ।
এ প্রতিবাদী ব্যতিক্রমী শক্তি মূলত তারুণ্য। তাদের অপ্রাপ্তি, তাদের ক্ষোভ, তাদের বেকারত্ব, তাদের হতাশা কোনো না কোনো রাজনৈতিক উপলক্ষ ঘিরে স্ফুলিঙ্গপাত ঘটায়, জ্বলে ওঠে আগুন। চলে শাসকপক্ষে চরম দমননীতি। প্রতিক্রিয়ায় ছুটে আসে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষও। এরপর প্রতিবাদী বিক্ষোভ পার্ক বা চত্বর ঘিরে ক্রমে তা উপচে জনসমুদ্র- দিনরাত্রি একাকার ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে থাকে খেয়ে, না খেয়ে। পুলিশ বা সেনাবাহিনী কখনো কাজে আসে, কখনো আসে না।
মিসর থেকে লিবিয়া- চরিত্রটা একটু ভিন্ন। এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে বিদেশি মদদে সমৃদ্ধ করে তোলা হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে। ঠিক একই ঘটনা সিরিয়ায়। দুই মার্কিনবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে তাঁবেদার শক্তি বসিয়ে গোটা অঞ্চল নিরুপদ্রব করতে হবে। কিন্তু সিরিয়ার বেলায় বিধিবাম, যদিও সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বলেই ফেলেছেন, 'সিরিয়ায় পশ্চিমারা যুদ্ধ করছে।' বিধিবাম, কারণ চীন, রাশিয়া বিশেষ করে রাশিয়া। লিবিয়ায় ঘটে যাওয়া ভুলটার পুনরাবৃত্তি বোধ হয় ওরা চায় না। তাই সিরিয়া যুদ্ধ পশ্চিমাদের এত সাহায্য সত্ত্বেও শেষ হচ্ছে না।
এর মধ্যে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাত। আবার সেই তারুণ্যের বসন্ত নির্ঘোষের মতো একই চরিত্রের প্রতিবাদ ইস্তাম্বুলে পার্ক ও প্রাকৃত পরিবেশ রক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে। আসলে এটা উপলক্ষ। সঞ্চিত নানা মাত্রিক সরকারবিরোধী ক্ষোভের বিস্ফোরণে লাখো মানুষের জমায়েত। অবস্থা বুঝে পিছু হটেছে তুরস্ক সরকার। কিন্তু হুজুগ মিটছে না। বেকায়দা অবস্থায় এরদোয়ান। এ অবস্থা চলতে থাকলে ইঙ্গ-মার্কিন, ব্রিটিশ-ফরাসি প্রভুদের পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র, রণসম্ভার, খাদ্যসামগ্রী তুরস্কের মাধ্যমে সিরীয় বিদ্রোহীদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে বিষয়টা স্পষ্ট হতে থাকবে প্রধানমন্ত্রী তারুণ্যের এ জাগরণ স্তব্ধ করে দিতে পারবেন কি না। তারুণ্য তাদের তাৎক্ষণিক দাবি পূরণের পর ঘরে ফিরে যেতে চাইবে কি না। তবে ঘটনা বলে, বামপন্থী দলগুলোসহ সরকারবিরোধী সবাই এখন তারুণ্যের সঙ্গে একাত্ম। শোনা যাচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষও তাদের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসছে। সবারই লক্ষ্য বর্তমান শাসনক্ষমতার রদবদল। আর নয় ইঙ্গ-মার্কিন-বশংবদ সরকার। এখন অপেক্ষা এর পরিণতি লক্ষ করার। এর প্রভাব কতটা পড়বে সিরীয় যুদ্ধের ওপর, তা দেখার।
মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দুনিয়ার দেশগুলোকে ঘিরে এতকাল পর তারুণ্যের এই আকস্মিক প্রতিবাদী জাগরণ কি বিশেষ ক্ষেত্রে থেমে যাবে, নাকি প্রতিবাদী নবধারার জন্ম দেবে- ধীরে ধীরে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করে রাজতন্ত্রী বাদ বাকি দেশগুলোকে পরিবর্তনের জোয়ারে টেনে আনবে এবং শাহী মসনদে গণতান্ত্রিক শাসনের পতাকা উড়বে। বিষয়টা নির্ভর করবে বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ওপর। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অনেক সময় প্রচণ্ড সম্ভাবনাও ব্যর্থতায় শেষ হয়, ইতিহাসে নজির কম নেই। তবু এই বিশেষ ধারার জাগরণ যা বাংলাদেশেও দেখা গেছে, হতে পারে এই আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য, যেখানে ইতিবাচক ভবিষ্যৎই হয়তো প্রধান হয়ে দাঁড়াবে। আমরা অপেক্ষায় বাস্তব দর্শনের। প্রগতিশীল গণতন্ত্রী-উত্থান সব সময় বাঁধাধরা পথে চলে না। আরব বসন্তে তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বড় দরকার একে সংহত রূপ দেওয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্ব।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments