যোগাযোগ-রেল নিয়ে বিভ্রান্তির অবসান হোক by সৈয়দ মাহবুবুল আলম
রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো। প্রতিষ্ঠানটি প্রসারের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন রেল মন্ত্রণালয় বহুদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রত্যাশার ফসল। নবগঠিত মন্ত্রণালয় রেলের সম্প্রসারণে সম্প্রতি একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনা রেলের প্রসারে
ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুচিন্তিত ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি। কেননা, কয়েক দশক ধরে ঋণ প্রদানকারী গোষ্ঠীর প্ররোচনা, পরামর্শ, সড়ক-সংশ্লিষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা, সর্বোপরি সরকারিভাবে অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে রেলের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। বিভিন্ন অহেতুক প্রকল্প আর নানা অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ব্যক্তিগোষ্ঠী এখনও বিদ্যমান। তাই রেলের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও সংস্থাটিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। পরিকল্পনা ও বাজেটবঞ্চিত, লোকবল ও রেলিং স্টক সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা।
নীতিনির্ধারকদের অবজ্ঞা, রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে সড়ক পরিবহন মালিকদের চতুরতা, ভ্রান্ত প্রচার, দীর্ঘদিনের বঞ্চিত জনগণের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। রেলের প্রসারের ্েক্ষত্রে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে_ রেল পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাবে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। ধনীদের বিলাসী বাহন আর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরিকল্পনায় দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
দেশে তথাকথিত উন্নয়নের নামে কৃষি জমি এবং দেশের নদ-নদী ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকার সড়ক ব্যবস্থার প্রসার করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে নৌপথ ও রেলপথের মতো সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম। শুধু তাই নয়, সড়কনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্ঘটনা, মৃত্যু; বাড়ছে যোগাযোগ ব্যয়।
পরিকল্পনা, বাজেট বঞ্চনা, অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রেল ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পেছনে কাজ করেছে ভ্রান্ত প্রচার। উদাহরণস্বরূপ রেলগেটে কোনো দুর্ঘটনা হলে রেলগেটে লোক না থাকার দায় চাপানো হয়। অথচ অধিকাংশ রেলক্রসিং রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত সড়ক কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে। রেলের দুর্নীতি হয়ে থাকে ক্রয় এবং অবকাঠামো তৈরি খাতে, যা ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত। অথচ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতি হিসেবে তুলে ধরে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। রেলওয়ে জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হলেও এটি পরিচালনার জন্য প্রদত্ত বরাদ্দকে (ভর্তুকি) জনসেবায় বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত না করে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে সড়ক খাত থেকে ব্যয়ের প্রেক্ষিতে কত টাকা আয় হয়_ এ প্রশ্ন কেউ করে না। অথচ রেলের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রেলের লাভ শুধু টাকার অঙ্ক দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। সামাজিক পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে রেলের অবদানকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বিদেশি ঋণ প্রদানকারী গোষ্ঠীর অহেতুক ঋণ, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অব্যবস্থাপনার কারণে রেলের আয়-ব্যয় বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। তবু রেলের লাভকে শুধু আয়-ব্যয় দ্বারা বিবেচনা করলে চলবে না। রেল জনগণের অর্থে সরকার পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। জনগণের যাতায়াত চাহিদা পূরণ করা এবং সেবা প্রদান করাই এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে লাভ আর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বেসরকারিকরণ বা বেসরকারি খাতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত টিঅ্যান্ডটি এবং টেলিটকের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
রেল পরিবেশবান্ধব, ভাড়া কম, জ্বালানি ও অর্থ সাশ্রয়ী। রেল যোগাযোগে ভূমির পরিমিত ব্যবহার হয়। একটি রেলে অনেক লোক যাতায়াত করতে পারে, দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম হয়। এ ছাড়া রেলের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অনেক ছোট ছোট ব্যবসা। একইভাবে কর্মসংস্থান করছে অনেক মানুষের। আর এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, রেল সামাজিক, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
রেল প্রসঙ্গে একটু ভিন্ন চিন্তা প্রয়োজন। রেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একমাত্র মাধ্যম, যা সরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিমান, সড়ক আর নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেসরকারি গোষ্ঠীর প্রভাব আর অন্যায্য দাবির কাছে প্রতিনিয়ত জনগণ জিম্মি জীবনযাপন করছে। সড়ক, নৌপথে দীর্ঘদিন ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে ত্যক্তবিরক্ত দেশের জনগণ। প্রতিনিয়ত কতিপয় বেসরকারি পরিবহন মালিকদের অন্যায্য নানা দাবির চাপ মেটাতে পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত দেশের জনগণ। এ অবস্থায় রেলের মতো একটি শক্তিশালী মাধ্যম যোগাযোগ ব্যবস্থায় সরকারের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার কথা আমাদের সবারই স্মরণ আছে। এই দুটি বন্যায় যাত্রী ও মালপত্র এবং দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পরিবহনের ক্ষেত্রে রেল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। ওই সময় একমাত্র রেলই ছিল দেশের যোগাযোগ রক্ষার কাণ্ডারি। এ ছাড়াও জরুরি ডাক পরিবহন, আইন-শৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীর মালপত্র পরিবহনে রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। হরতাল, ধর্মঘট বা অন্য যে কোনো মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বাংলাদেশ রেল সরকারের একমাত্র ভরসা। প্রতিটি উৎসব-পার্বণে বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীদের বিশেষ সেবা প্রদানের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলের ভূমিকা সরকার তথা জনগণের একটি শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যম। রেলের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য পরিবহন মানুষকে জিম্মি করতে পারে না।
সরকার প্রতিনিয়ত দরিদ্র শ্রেণীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিনিয়ত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য পাচ্ছে না পরিবহন সংকট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। পাশাপাশি পরিবহনের কারণে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। রেল যোগাযোগ উন্নত এবং ট্রেনে মালপত্র পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে গ্রামীণ মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটবে। দ্রব্যমূল্য বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
মহানগরগুলোর আশপাশের এলাকার সঙ্গে রেলের যোগাযোগ সাশ্রয়ী এবং দ্রুত করা সম্ভব হলে বড় বড় নগরে জনগণের বসবাসের চাপ কমবে, যা যানজট, পরিবেশ দূষণ, বিকেন্দ্রীকরণ, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
রেল সম্প্রসারণ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ বিগত দিনে রেলের উন্নয়নের নামে শুধু রেলস্টেশনের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। লোকবল ছাঁটাই এবং রেললাইন তুলে ফেলে দিন দিন নিঃস্ব করা হয়েছে রেল ব্যবস্থাকে। আর এসব কাজ করা হয়েছে উন্নয়ন নামে রিফর্মেশন কর্মকাণ্ডের আওতায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ে। অথচ রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, লোকবল নিয়োগের মতো বিষয় এ কার্যক্রমে গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়নের নামে যেন রেল মন্ত্রণালয় এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রমে লিপ্ত না হয়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে সেসব ব্যক্তি থেকে যারা বিগত দিনে এসব প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের উপদেশ বা পরামর্শ গ্রহণে। অন্যদিকে রেলকে বেসরকারি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের যোগাযোগ খাত অনিরাপদ করার চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদের অপচেষ্টাকে ব্যাহত করতে জনগণকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানই নয়, এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো। আমাদের ঐতিহ্যগত এ প্রতিষ্ঠানটি প্রসারের লক্ষ্যে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম :আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
নীতিনির্ধারকদের অবজ্ঞা, রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে সড়ক পরিবহন মালিকদের চতুরতা, ভ্রান্ত প্রচার, দীর্ঘদিনের বঞ্চিত জনগণের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। রেলের প্রসারের ্েক্ষত্রে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে_ রেল পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাবে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। ধনীদের বিলাসী বাহন আর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরিকল্পনায় দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
দেশে তথাকথিত উন্নয়নের নামে কৃষি জমি এবং দেশের নদ-নদী ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকার সড়ক ব্যবস্থার প্রসার করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে নৌপথ ও রেলপথের মতো সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম। শুধু তাই নয়, সড়কনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্ঘটনা, মৃত্যু; বাড়ছে যোগাযোগ ব্যয়।
পরিকল্পনা, বাজেট বঞ্চনা, অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রেল ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পেছনে কাজ করেছে ভ্রান্ত প্রচার। উদাহরণস্বরূপ রেলগেটে কোনো দুর্ঘটনা হলে রেলগেটে লোক না থাকার দায় চাপানো হয়। অথচ অধিকাংশ রেলক্রসিং রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত সড়ক কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে। রেলের দুর্নীতি হয়ে থাকে ক্রয় এবং অবকাঠামো তৈরি খাতে, যা ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত। অথচ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতি হিসেবে তুলে ধরে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। রেলওয়ে জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হলেও এটি পরিচালনার জন্য প্রদত্ত বরাদ্দকে (ভর্তুকি) জনসেবায় বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত না করে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে সড়ক খাত থেকে ব্যয়ের প্রেক্ষিতে কত টাকা আয় হয়_ এ প্রশ্ন কেউ করে না। অথচ রেলের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রেলের লাভ শুধু টাকার অঙ্ক দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। সামাজিক পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে রেলের অবদানকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বিদেশি ঋণ প্রদানকারী গোষ্ঠীর অহেতুক ঋণ, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অব্যবস্থাপনার কারণে রেলের আয়-ব্যয় বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। তবু রেলের লাভকে শুধু আয়-ব্যয় দ্বারা বিবেচনা করলে চলবে না। রেল জনগণের অর্থে সরকার পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। জনগণের যাতায়াত চাহিদা পূরণ করা এবং সেবা প্রদান করাই এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে লাভ আর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বেসরকারিকরণ বা বেসরকারি খাতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত টিঅ্যান্ডটি এবং টেলিটকের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
রেল পরিবেশবান্ধব, ভাড়া কম, জ্বালানি ও অর্থ সাশ্রয়ী। রেল যোগাযোগে ভূমির পরিমিত ব্যবহার হয়। একটি রেলে অনেক লোক যাতায়াত করতে পারে, দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম হয়। এ ছাড়া রেলের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অনেক ছোট ছোট ব্যবসা। একইভাবে কর্মসংস্থান করছে অনেক মানুষের। আর এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, রেল সামাজিক, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
রেল প্রসঙ্গে একটু ভিন্ন চিন্তা প্রয়োজন। রেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একমাত্র মাধ্যম, যা সরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিমান, সড়ক আর নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেসরকারি গোষ্ঠীর প্রভাব আর অন্যায্য দাবির কাছে প্রতিনিয়ত জনগণ জিম্মি জীবনযাপন করছে। সড়ক, নৌপথে দীর্ঘদিন ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে ত্যক্তবিরক্ত দেশের জনগণ। প্রতিনিয়ত কতিপয় বেসরকারি পরিবহন মালিকদের অন্যায্য নানা দাবির চাপ মেটাতে পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত দেশের জনগণ। এ অবস্থায় রেলের মতো একটি শক্তিশালী মাধ্যম যোগাযোগ ব্যবস্থায় সরকারের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার কথা আমাদের সবারই স্মরণ আছে। এই দুটি বন্যায় যাত্রী ও মালপত্র এবং দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পরিবহনের ক্ষেত্রে রেল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। ওই সময় একমাত্র রেলই ছিল দেশের যোগাযোগ রক্ষার কাণ্ডারি। এ ছাড়াও জরুরি ডাক পরিবহন, আইন-শৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীর মালপত্র পরিবহনে রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। হরতাল, ধর্মঘট বা অন্য যে কোনো মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বাংলাদেশ রেল সরকারের একমাত্র ভরসা। প্রতিটি উৎসব-পার্বণে বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীদের বিশেষ সেবা প্রদানের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলের ভূমিকা সরকার তথা জনগণের একটি শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যম। রেলের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য পরিবহন মানুষকে জিম্মি করতে পারে না।
সরকার প্রতিনিয়ত দরিদ্র শ্রেণীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিনিয়ত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য পাচ্ছে না পরিবহন সংকট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। পাশাপাশি পরিবহনের কারণে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। রেল যোগাযোগ উন্নত এবং ট্রেনে মালপত্র পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে গ্রামীণ মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটবে। দ্রব্যমূল্য বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
মহানগরগুলোর আশপাশের এলাকার সঙ্গে রেলের যোগাযোগ সাশ্রয়ী এবং দ্রুত করা সম্ভব হলে বড় বড় নগরে জনগণের বসবাসের চাপ কমবে, যা যানজট, পরিবেশ দূষণ, বিকেন্দ্রীকরণ, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
রেল সম্প্রসারণ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ বিগত দিনে রেলের উন্নয়নের নামে শুধু রেলস্টেশনের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। লোকবল ছাঁটাই এবং রেললাইন তুলে ফেলে দিন দিন নিঃস্ব করা হয়েছে রেল ব্যবস্থাকে। আর এসব কাজ করা হয়েছে উন্নয়ন নামে রিফর্মেশন কর্মকাণ্ডের আওতায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ে। অথচ রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, লোকবল নিয়োগের মতো বিষয় এ কার্যক্রমে গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়নের নামে যেন রেল মন্ত্রণালয় এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রমে লিপ্ত না হয়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে সেসব ব্যক্তি থেকে যারা বিগত দিনে এসব প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের উপদেশ বা পরামর্শ গ্রহণে। অন্যদিকে রেলকে বেসরকারি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের যোগাযোগ খাত অনিরাপদ করার চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদের অপচেষ্টাকে ব্যাহত করতে জনগণকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানই নয়, এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো। আমাদের ঐতিহ্যগত এ প্রতিষ্ঠানটি প্রসারের লক্ষ্যে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম :আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
No comments