ভারত-না ঘরকা না ঘাটকা লোকপাল বিল by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
লোকপালের হাতে দুর্নীতি দমনের ভার চলে গেলে সব দলের ক্ষতি। কারণ লোকপালকে সরকার নিয়োগ করবে না। তবু যেমন-তেমন একটি দুর্বল লোকপাল বিল আনা হয়েছিল মুখ রক্ষার জন্য। যে নবজাতকের আঁতুড়ঘরে মৃত্যু হলো সে তো কারও শিশু ছিল না। তাই কারও চোখে জল নেই। এমনকি আন্না হাজারেও ওই শিশুর পিতৃত্ব নিতে রাজি নন। তিনি আপাতত অসুস্থ এবং রণে ভঙ্গ দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে এটি রুদ্ধশ্বাস নাটক। এটি তখন কমার্শিয়াল ব্রেক
২০১২ সাল ভারতবর্ষের ইউপিএ সরকারকে শুধু নয়, আগামীদিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এই অশনিসংকেতটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। বিরোধী দলের প্রবল প্রতিবন্ধকতার মুখে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যখন গভীর দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করেন, সভায় যেমন হট্টগোল চলছে তাতে সভা চালানো অচল হয়ে উঠেছে। এভাবে সভা চালানো যায় না। এর চেয়ে বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। তখনই বোঝা যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সংসদীয় রাজনীতির ওপর এক কালো রাত নেবে আসছে।
এই অচল অবস্থার ফলে একাট্টা বিরোধীরা এক চোট হেসেছেন। কারণ তারাই ২০১১ সালে যতবার সংসদের অধিবেশনে বসেছেন তার বেশিরভাগ সময় সংসদের কাজ ভণ্ডুল করার ব্যাপারে একাট্টা হয়েছেন। কিন্তু গত ২৯ ডিসেম্বর সভা পণ্ডের নাটকে শেষ হাসিটি হাসলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপ্যাধায়। রাজ্যসভায় ইউপিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই; কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস ছিল তাদের দুই বড় শরিক তৃণমূল আর ডিএমকে রাজ্যসভায় সরকারের পক্ষে ভোট দিয়ে লোকপাল বিলটি পাস করাবেন। লোকসভায় একদিনের মধ্যেই বিলটি পাস হয়েছে। তখন শুধু রাজ্যসভার সম্মতির অপেক্ষায় ছিল। আন্না হাজারের অনশন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ শীতকালীন অধিবেশনের মধ্যেই লোকপাল বিলটি পাস করিয়ে নিতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এমনই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন আন্না হাজারের কাছে। কিন্তু শেষমেশ তার সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে তো পারলেনই না বরং এ বিলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিরোধী দলের রাজনৈতিক অভিসন্ধিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। উঁকি মারতে লাগল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি গেম প্লান। সেটি হলো কেন্দ্র বিরোধিতার পুরনো যে খেলা খেলে একদা আঞ্চলিক দলগুলোও বিশেষ করে বামরা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন, সেই কেন্দ্র বিরোধিতার পালের হাওয়া বিরোধীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চান মমতা। যিনি নাকি খাতা-কলমে কেন্দ্রে মাইনরিটি কংগ্রেস সরকারের শরিকও। ইতিমধ্যেই ইউপিএতে থেকে ইউপিএ সরকারের (মনমোহন সিংয়ের সরকার) সব গুরুত্বপূর্ণ নীতির বিরোধিতা করে এসেছেন মমতা। যেমন খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্ন, তিস্তার জল বাংলাদেশকে বণ্টন, জমি অধিকার সংক্রান্ত সরকারি বিলও তৈরি হয়েছে মমতার আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই। রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরটিও তৃণমূল মন্ত্রী স্বাধীনভাবে চালাচ্ছেন এবং মনমোহন তাতে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করছেন না। যদিও রেলের নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ আছে। অভিযোগ আছে, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য হ্রাস পাওয়ার। কিন্তু এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। রেলের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে হস্তক্ষেপও করেননি। এককথায় তৃণমূলের সমর্থন হারানোর ভয়ে মনমোহন যথেষ্ট তটস্থ। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেও কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও দু'বছর টিকিয়ে রাখার জন্য (২০১৪ সালের লোকসভার নির্বাচন) ইউপিএর সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মমতাকে চটাতে চান না। মমতা যা চান, যেমনটি চান তাকে তাই দিতে চান। যার জন্য খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্নর বিল তিনি বাতিলই করে দিয়েছেন। কিন্তু লোকপাল বিল? মনমোহন বা সোনিয়া একদম বুঝতে পারেননি যে, একদিন আগে লোকসভায় যে বিল তৃণমূল এমপিরা সমর্থন করলেন_ একদিন পরে রাজ্যসভায় কী করে বদলে গেল মতটা? আর লোকপাল বিল? কংগ্রেসই-বা কী সাধ করে এনেছে বিলটা? সংবিধানে নির্দেশ আছে, দুর্নীতি দমনের জন্য একজন নিরপেক্ষ ওমবুডসম্যান নিয়োগ করবে সরকার। যিনি শুধু সরকারের নন, সরকারি স্তরের নেতাদের দুর্নীতির ওপরও নজর রাখবেন। এখন যেমন প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি তদন্ত করার মতো কোনো এজেন্সি নেই। হাইকোর্টেও বিচারপতিদের দুর্নীতির অভিযোগে তাদের ইমপিচ করা যায় সংসদে। কিন্তু সে বড় জটিল পদ্ধতি। সে জন্য কেন্দ্রের জন্য 'লোকপাল' ও রাজ্যগুলোর জন্য 'লোকায়ুুক্ত' নিয়োগের প্রস্তাব উঠেছিল সেই ১৯৬০ সালে। তখন থেকে শুধু সরকারি সদিচ্ছার অভাবেই এ বিল সংসদে ওঠেনি। সবশেষে আন্না হাজারের আমরণ অনশনের ফলে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার তড়িঘড়ি করে বিলটি আনে। তাও আন্না হাজারে যা চেয়েছিলেন তা থেকে অনেক বাদসাদ দিয়ে বিলটি আনা হয়। কারণ আন্না হুমকি দিয়েছিলেন লোকপাল বিল পাস না হলে তিনি আসন্ন ইউপিএ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট না দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেইন চালাবেন। তাছাড়া আন্নার পেছনে বিজেপি ও আরএসএস (উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন) আছে বলে মনে করে কংগ্রেস। তাই আন্নাকে আশ্বস্ত করতে লোকপাল বিলটি লোকসভায় পাস করিয়ে নেয় ইউপিএ। কিন্তু তীরে এসে যে তরী ডুববে তা কি জানতেন মনমোহন, না জানতেন সোনিয়া?
লোকসভায় যখন ধ্বনি ভোটে বিলটি পাস হয়ে যায়, তখন ডিভিশন চাননি বিরোধী দলের কেউ। তৃণমূলও নয়। কিন্তু পরে মমতার খেয়াল হয় যে, ওই বিলে কেন্দ্রে লোকপালের ধাঁচে রাজ্যে লোকায়ুক্ত গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মমতার এখানেই আপত্তি। তিনি মনে করেন, রাজ্য দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে রাজ্য সরকার কী করবে না করবে তা রাজ্যের ব্যাপার। কেন্দ্রের রাজ্যের ওপর লোকায়ুক্ত চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। প্রয়োজন হলে কেন্দ্র নিজের মতো করে লোকায়ুক্ত গঠন করবে। মমতা এ জন্য তার দলের সাংসদদের নির্দেশ দেন সংশোধনী আনতে। সংশোধনী পাস না হলে বিলটির বিরুদ্ধে ভোট দিতে। রাজ্যের ওপর কেন্দ্রের এ খবরদারির বিরুদ্ধে অন্য দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়। কারণ এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন করে পুনর্বিন্যাস ঘটাতে এবং দুর্বল কেন্দ্র ও সবল যুক্তরাজ্য গড়ে তোলার দাবিতে ষাটের দশকের শেষে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রথম সচেষ্ট হয়। তারাই তখন কংগ্রেসবিরোধী রাজ্য সরকারগুলোকে নিয়ে কলকাতায় একটি সম্মেলনও করেন। এরপর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের নানা সুপারিশ করে সারকবরিয়া কমিশন গঠন করা হয়। তারপর দীর্ঘদিন ইস্যুটি থিতিয়ে ছিল। 'কেন্দ্রের বঞ্চনা' ও রাজ্যের যা কিছু অনগ্রসরতা তার পেছনে কেন্দ্রের 'ষড়যন্ত্র' দেখার নীতিকে মূলধন করে একদা বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো স্ফীত হতে থাকে। মমতা আবার বামদের অনুকরণে রাজ্যের এই ভাবাবেগকে জাগিয়ে তুলতে চান। ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ূ, অন্ধ্র, বিহার ও উত্তর প্রদেশে এই আঞ্চলিক মনোভাব ভীষণ শক্তিশালী। কেন্দ্রে একক কোনো দল ১৯৭৭ সাল থেকে ক্ষমতায় নেই। আঞ্চলিক দলগুলো এনডিএ বা ইউপিএ কোনো না কোনো সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অর্থাৎ কেন্দ্রে আঞ্চলিক দলগুলোও ক্ষমতার শরিক হওয়ায় কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন সব রাজ্যেই স্তিমিত প্রায়। মমতা আবার সেটাকেই জাগিয়ে তুলতে চান। তিনি ক্রমেই তার পাখা বিস্তার করে সর্বভারতীয় নেত্রী হিসেবে তার প্রভাব খাটাতে চাইছেন। তার অভিপ্রায় কেন্দ্রীয় সরকারে থেকে যতটা পারা যায় বড় শরিকের কাছ থেকে চাপ দিয়ে অর্থানুকূল্য লাভ করা। অন্যদিকে মূল্য বৃদ্ধি না ঘটিয়ে রাজ্যবাসীর কাছে তার পপুলার ইমেজ বজায় রাখা। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। মমতা জানেন, ইউপিএর সংকট মানে তৃণমূলের সুযোগ। ফলে লোকপাল বিলের সলিলসমাধি। সব রাজনৈতিক দলই এতে মনে মনে খুশি। কারণ সব দলেই দুর্নীতি আছে। সরকারের হাতে দুর্নীতি দমনের ভার থাকলে সব দলেরই ভালো।
লোকপালের হাতে দুর্নীতি দমনের ভার চলে গেলে সব দলের ক্ষতি। কারণ লোকপালকে সরকার নিয়োগ করবে না। তবু যেমন-তেমন একটি দুর্বল লোকপাল বিল আনা হয়েছিল মুখ রক্ষার জন্য। যে নবজাতকের আঁতুড়ঘরে মৃত্যু হলো সে তো কারও শিশু ছিল না। তাই কারও চোখে জল নেই। এমনকি আন্না হাজারেও ওই শিশুর পিতৃত্ব নিতে রাজি নন। তিনি আপাতত অসুস্থ এবং রণে ভঙ্গ দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে এটি রুদ্ধশ্বাস নাটক। এটি তখন কমার্শিয়াল ব্রেক। সঙ্গে থাকুন।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
এই অশনিসংকেতটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। বিরোধী দলের প্রবল প্রতিবন্ধকতার মুখে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যখন গভীর দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করেন, সভায় যেমন হট্টগোল চলছে তাতে সভা চালানো অচল হয়ে উঠেছে। এভাবে সভা চালানো যায় না। এর চেয়ে বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। তখনই বোঝা যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সংসদীয় রাজনীতির ওপর এক কালো রাত নেবে আসছে।
এই অচল অবস্থার ফলে একাট্টা বিরোধীরা এক চোট হেসেছেন। কারণ তারাই ২০১১ সালে যতবার সংসদের অধিবেশনে বসেছেন তার বেশিরভাগ সময় সংসদের কাজ ভণ্ডুল করার ব্যাপারে একাট্টা হয়েছেন। কিন্তু গত ২৯ ডিসেম্বর সভা পণ্ডের নাটকে শেষ হাসিটি হাসলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপ্যাধায়। রাজ্যসভায় ইউপিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই; কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস ছিল তাদের দুই বড় শরিক তৃণমূল আর ডিএমকে রাজ্যসভায় সরকারের পক্ষে ভোট দিয়ে লোকপাল বিলটি পাস করাবেন। লোকসভায় একদিনের মধ্যেই বিলটি পাস হয়েছে। তখন শুধু রাজ্যসভার সম্মতির অপেক্ষায় ছিল। আন্না হাজারের অনশন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ শীতকালীন অধিবেশনের মধ্যেই লোকপাল বিলটি পাস করিয়ে নিতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এমনই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন আন্না হাজারের কাছে। কিন্তু শেষমেশ তার সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে তো পারলেনই না বরং এ বিলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিরোধী দলের রাজনৈতিক অভিসন্ধিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। উঁকি মারতে লাগল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি গেম প্লান। সেটি হলো কেন্দ্র বিরোধিতার পুরনো যে খেলা খেলে একদা আঞ্চলিক দলগুলোও বিশেষ করে বামরা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন, সেই কেন্দ্র বিরোধিতার পালের হাওয়া বিরোধীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চান মমতা। যিনি নাকি খাতা-কলমে কেন্দ্রে মাইনরিটি কংগ্রেস সরকারের শরিকও। ইতিমধ্যেই ইউপিএতে থেকে ইউপিএ সরকারের (মনমোহন সিংয়ের সরকার) সব গুরুত্বপূর্ণ নীতির বিরোধিতা করে এসেছেন মমতা। যেমন খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্ন, তিস্তার জল বাংলাদেশকে বণ্টন, জমি অধিকার সংক্রান্ত সরকারি বিলও তৈরি হয়েছে মমতার আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই। রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরটিও তৃণমূল মন্ত্রী স্বাধীনভাবে চালাচ্ছেন এবং মনমোহন তাতে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করছেন না। যদিও রেলের নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ আছে। অভিযোগ আছে, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য হ্রাস পাওয়ার। কিন্তু এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। রেলের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে হস্তক্ষেপও করেননি। এককথায় তৃণমূলের সমর্থন হারানোর ভয়ে মনমোহন যথেষ্ট তটস্থ। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেও কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও দু'বছর টিকিয়ে রাখার জন্য (২০১৪ সালের লোকসভার নির্বাচন) ইউপিএর সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মমতাকে চটাতে চান না। মমতা যা চান, যেমনটি চান তাকে তাই দিতে চান। যার জন্য খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্নর বিল তিনি বাতিলই করে দিয়েছেন। কিন্তু লোকপাল বিল? মনমোহন বা সোনিয়া একদম বুঝতে পারেননি যে, একদিন আগে লোকসভায় যে বিল তৃণমূল এমপিরা সমর্থন করলেন_ একদিন পরে রাজ্যসভায় কী করে বদলে গেল মতটা? আর লোকপাল বিল? কংগ্রেসই-বা কী সাধ করে এনেছে বিলটা? সংবিধানে নির্দেশ আছে, দুর্নীতি দমনের জন্য একজন নিরপেক্ষ ওমবুডসম্যান নিয়োগ করবে সরকার। যিনি শুধু সরকারের নন, সরকারি স্তরের নেতাদের দুর্নীতির ওপরও নজর রাখবেন। এখন যেমন প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি তদন্ত করার মতো কোনো এজেন্সি নেই। হাইকোর্টেও বিচারপতিদের দুর্নীতির অভিযোগে তাদের ইমপিচ করা যায় সংসদে। কিন্তু সে বড় জটিল পদ্ধতি। সে জন্য কেন্দ্রের জন্য 'লোকপাল' ও রাজ্যগুলোর জন্য 'লোকায়ুুক্ত' নিয়োগের প্রস্তাব উঠেছিল সেই ১৯৬০ সালে। তখন থেকে শুধু সরকারি সদিচ্ছার অভাবেই এ বিল সংসদে ওঠেনি। সবশেষে আন্না হাজারের আমরণ অনশনের ফলে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার তড়িঘড়ি করে বিলটি আনে। তাও আন্না হাজারে যা চেয়েছিলেন তা থেকে অনেক বাদসাদ দিয়ে বিলটি আনা হয়। কারণ আন্না হুমকি দিয়েছিলেন লোকপাল বিল পাস না হলে তিনি আসন্ন ইউপিএ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট না দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেইন চালাবেন। তাছাড়া আন্নার পেছনে বিজেপি ও আরএসএস (উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন) আছে বলে মনে করে কংগ্রেস। তাই আন্নাকে আশ্বস্ত করতে লোকপাল বিলটি লোকসভায় পাস করিয়ে নেয় ইউপিএ। কিন্তু তীরে এসে যে তরী ডুববে তা কি জানতেন মনমোহন, না জানতেন সোনিয়া?
লোকসভায় যখন ধ্বনি ভোটে বিলটি পাস হয়ে যায়, তখন ডিভিশন চাননি বিরোধী দলের কেউ। তৃণমূলও নয়। কিন্তু পরে মমতার খেয়াল হয় যে, ওই বিলে কেন্দ্রে লোকপালের ধাঁচে রাজ্যে লোকায়ুক্ত গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মমতার এখানেই আপত্তি। তিনি মনে করেন, রাজ্য দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে রাজ্য সরকার কী করবে না করবে তা রাজ্যের ব্যাপার। কেন্দ্রের রাজ্যের ওপর লোকায়ুক্ত চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। প্রয়োজন হলে কেন্দ্র নিজের মতো করে লোকায়ুক্ত গঠন করবে। মমতা এ জন্য তার দলের সাংসদদের নির্দেশ দেন সংশোধনী আনতে। সংশোধনী পাস না হলে বিলটির বিরুদ্ধে ভোট দিতে। রাজ্যের ওপর কেন্দ্রের এ খবরদারির বিরুদ্ধে অন্য দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়। কারণ এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন করে পুনর্বিন্যাস ঘটাতে এবং দুর্বল কেন্দ্র ও সবল যুক্তরাজ্য গড়ে তোলার দাবিতে ষাটের দশকের শেষে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রথম সচেষ্ট হয়। তারাই তখন কংগ্রেসবিরোধী রাজ্য সরকারগুলোকে নিয়ে কলকাতায় একটি সম্মেলনও করেন। এরপর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের নানা সুপারিশ করে সারকবরিয়া কমিশন গঠন করা হয়। তারপর দীর্ঘদিন ইস্যুটি থিতিয়ে ছিল। 'কেন্দ্রের বঞ্চনা' ও রাজ্যের যা কিছু অনগ্রসরতা তার পেছনে কেন্দ্রের 'ষড়যন্ত্র' দেখার নীতিকে মূলধন করে একদা বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো স্ফীত হতে থাকে। মমতা আবার বামদের অনুকরণে রাজ্যের এই ভাবাবেগকে জাগিয়ে তুলতে চান। ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ূ, অন্ধ্র, বিহার ও উত্তর প্রদেশে এই আঞ্চলিক মনোভাব ভীষণ শক্তিশালী। কেন্দ্রে একক কোনো দল ১৯৭৭ সাল থেকে ক্ষমতায় নেই। আঞ্চলিক দলগুলো এনডিএ বা ইউপিএ কোনো না কোনো সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অর্থাৎ কেন্দ্রে আঞ্চলিক দলগুলোও ক্ষমতার শরিক হওয়ায় কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন সব রাজ্যেই স্তিমিত প্রায়। মমতা আবার সেটাকেই জাগিয়ে তুলতে চান। তিনি ক্রমেই তার পাখা বিস্তার করে সর্বভারতীয় নেত্রী হিসেবে তার প্রভাব খাটাতে চাইছেন। তার অভিপ্রায় কেন্দ্রীয় সরকারে থেকে যতটা পারা যায় বড় শরিকের কাছ থেকে চাপ দিয়ে অর্থানুকূল্য লাভ করা। অন্যদিকে মূল্য বৃদ্ধি না ঘটিয়ে রাজ্যবাসীর কাছে তার পপুলার ইমেজ বজায় রাখা। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। মমতা জানেন, ইউপিএর সংকট মানে তৃণমূলের সুযোগ। ফলে লোকপাল বিলের সলিলসমাধি। সব রাজনৈতিক দলই এতে মনে মনে খুশি। কারণ সব দলেই দুর্নীতি আছে। সরকারের হাতে দুর্নীতি দমনের ভার থাকলে সব দলেরই ভালো।
লোকপালের হাতে দুর্নীতি দমনের ভার চলে গেলে সব দলের ক্ষতি। কারণ লোকপালকে সরকার নিয়োগ করবে না। তবু যেমন-তেমন একটি দুর্বল লোকপাল বিল আনা হয়েছিল মুখ রক্ষার জন্য। যে নবজাতকের আঁতুড়ঘরে মৃত্যু হলো সে তো কারও শিশু ছিল না। তাই কারও চোখে জল নেই। এমনকি আন্না হাজারেও ওই শিশুর পিতৃত্ব নিতে রাজি নন। তিনি আপাতত অসুস্থ এবং রণে ভঙ্গ দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে এটি রুদ্ধশ্বাস নাটক। এটি তখন কমার্শিয়াল ব্রেক। সঙ্গে থাকুন।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
No comments