আইনের বাস্তবায়ন কত দূর -তথ্য অধিকার by মশিউল আলম
রাজধানীর কল্যাণপুরে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ভবনের তৃতীয় তলায় পাঁচটি কক্ষ নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ তথ্য কমিশন। এ বছর ২৯ মার্চ তথ্য অধিকার আইন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাত্ ১ জুলাই থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে। সাবেক সচিব এম আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তথ্য কমিশনও গঠিত হয়েছে আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে। আরেকজন তথ্য কমিশনারও একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব—মোহাম্মদ আবু তাহের। আইনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী, কমিশনের একজন সদস্য নারী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
প্রধান তথ্য কমিশনার (সিআইসি) এম আজিজুর রহমান জানালেন, তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্য কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার একটি বিধির খসড়া তৈরি করেছে। সেটি অল্পদিনের মধ্যেই অনুমোদন পাবে। এর পর তথ্য কমিশন নিজে একটি প্রবিধানমালা তৈরি করবে। ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগে তথ্য প্রদানের জন্য একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তথ্য কমিশন এখনো পুরো মাত্রায় কাজ শুরু করতে পারেনি, কারণ তার লোকবল নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। তথ্য কমিশন ৭৮ জন লোকবলবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কাঠামো সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে। কমিশনের নিজস্ব কার্যালয়ের জন্যও জায়গা খোঁজা হচ্ছে। সিআইসি জানালেন, আগারগাঁওয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি তলায় আট হাজার বর্গফুটের একটি কার্যালয় সাজানোর প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু হবে। সেখানে কমিশন অস্থায়ীভাবে কিছু সময় কাজ করবে, তারপর আগারগাঁওয়েই দুই বিঘার জমির ওপর স্থায়ী কার্যালয়ের ভবন নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে।
তথ্য কমিশনের অবকাঠামোগত ভিতগুলো গড়ে তুলতে কিছুটা সময় লাগবে; তাই বলে কমিশন নিষ্ক্রিয় বসে নেই, জানালেন প্রধান তথ্য কমিশনার। জানতে চাইলাম, কী ধরনের কাজ তাঁরা এখন করছেন। তিনি জানালেন, তথ্য অধিকার আইনটি সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক, আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় ইত্যাদি চলছে। গত মাসে তথ্য কমিশনাররা দেশের চারটি জেলায় এ ধরনের বৈঠক করেছেন। এ মাসে আরও ১২টি জেলা তাঁদের সফর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ওদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা বেশ কয়েক বছর ধরে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও পাসের জন্য জনমত সংগঠনসহ নানা ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি চালিয়ে এসেছে, তাদের আয়োজনে ও ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের আর্থিক সহযোগিতায় ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। ভারতের তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলো জানা-বোঝা ছিল তাঁদের এই সফরের উদ্দেশ্য। তথ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের মোট ছয়জন কর্মকর্তা ভারতের তথ্য কমিশনের প্রধান কার্যালয়, কয়েকটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ঘুরে দেখেছেন, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছেন। আমাদের প্রধান তথ্য কমিশনার জানালেন, সফরকার ওই সরকারি কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা জানার জন্য তাঁরা তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসার উদ্যোগ নেবেন। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের কাজে নানা পর্যায়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে বলেও জানা গেল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্থা, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজ্ঞ, এনজিও-কর্মীদের সমন্বয়ে ‘তথ্য অধিকার ফোরাম’ নামে একটি নাগরিক প্ল্যাটফরম রয়েছে। তথ্য অধিকার আইন পাসের ক্ষেত্রে তারা জনমত সৃষ্টিসহ নানামুখী ভূমিকা রেখেছে। আইনটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেও তারা কিছু উদ্যোগ নেবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য সম্প্রতি কিছু সভা-বৈঠক করেছে। এই সংস্থাটি তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এবং যাঁরা তথ্যের জন্য আবেদন করবেন, সেসব নাগরিকদের মধ্যে ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ বা সামর্থ্য সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচির উদ্যোগ নেবে। এ ছাড়া তথ্য কমিশনকে কার্যকর করায়, এর প্রবিধানমালা প্রণয়নে সহযোগিতা দিতেও টিআইবি কিছু উদ্যোগ নেবে বলে জানালেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তথ্য অধিকার আইন একটি সর্বজনীন আইন। এ আইনের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। একমাত্র প্রতিপক্ষ বলে মনে করা হয় যে আমলাতন্ত্রকে, সৌভাগ্যক্রমে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সময়ে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে সেই আমলাতন্ত্রের দিক থেকেও বেশ ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। তথ্য গোপন রাখার মধ্য দিয়ে প্রশ্নাতীতভাবে ক্ষমতা ভোগের দিন শেষ হয়ে গেছে—এই উপলব্ধি কমবেশি সবার মধ্যেই সঞ্চারিত হচ্ছে। সবাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে জনগণকে তথ্য জানতে দিতে হবে।
কিন্তু তথ্য অধিকার আইনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক নাগরিক যে একটি বড় আইনি হাতিয়ারের মালিক হয়েছে—এই সচেতনতার অভাব প্রকটভাবে রয়ে গেছে। কী কাজে, কী পদ্ধতিতে আইনটিকে ব্যবহার করা যায় এটি অনেকেই জানেন না। তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ আবু তাহের বললেন, আইনটি সম্পর্কে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও পুরোপুরি স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে।
তথ্য অধিকার আইনের খবরটি পৌঁছেছে জেলা পর্যায়ের শিক্ষিত শ্রেণী পর্যন্ত। তৃণমূল পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষ এ সম্পর্কে বস্তুত কিছুই জানে না। রাষ্ট্র ও সরকার কীভাবে চলছে, জনগণের অর্থ কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য কত অর্থ বরাদ্দ আসছে, কীভাবে সেগুলো ব্যয় হচ্ছে—এসব তথ্য জানার অধিকার যে তাদের আছে, এ ধারণাটিই তাদের নেই।
আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইনের আন্দোলন চলেছে শিক্ষিত নাগরিক-সমাজের নেতৃত্বে। এই আইনটি পেতে খুব বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে, এমনও নয়। আসলে ২০০২ সালে আইন কমিশন যখন তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া কার্যপত্র তৈরি করে, তখন এর পক্ষে নাগরিক-সমাজে কোনো আন্দোলন ছিল না। বলা চলে, সরকার নিজে থেকেই এমন একটি আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে শুরু করেছিল (সম্ভবত আমাদের বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের তাগাদায়)। তার পরে অবশ্য সরকারের গড়িমসি চলেছে বেশ কয়েক বছর। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদিচ্ছা এবং সেই সদিচ্ছার প্রতি বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সমর্থনের ফলে আমরা আইনটি পেয়েছি। প্রতিবেশী ভারত, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে খ্যাত, যেখানে গণতন্ত্রের বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে, সেখানে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরিণতিতে। ভারতে তথ্য অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিল একদম তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষেরা। যেসব দরিদ্র মানুষ বছরের একটা বড় সময় ধরে বেকার থাকে, কোনো কাজ পায় না, কাজ পেলেও ঠিকমতো মজুরি পায় না, যাদের নামে মজুরির টাকা তুলে নিয়ে যায় পঞ্চায়েতের মেম্বার-চেয়ারম্যান, যাদের রেশনের চিনি বিক্রি করে দেয় চিনির ডিলার, সেই সব মানুষ বুঝতে পেরেছিল এসব অন্যায়-অনাচার বন্ধ করতে হলে, জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন তথ্য জানার অধিকার। রাজস্থানের দরিদ্র মানুষদের সেই তথ্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল; তারই চূড়ান্ত ফসল তাদের তথ্য অধিকার আইন।
ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার ওজাহাত হাবিবুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের কিছু সময় পরে বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তথ্য কমিশনের কাজে তাঁরা কী কী অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, নাগরিকদের আপিলের শুনানি করতে তাঁরা পাঁচজন তথ্য কমিশনার হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। কারণ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে আপিল করতে আসছে তথ্য কমিশনের কাছে। অর্থাত্ ভারতে তথ্য অধিকার আইন বলবত্ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের নাগরিকেরা ব্যাপক সংখ্যায় সে আইন ব্যবহার শুরু করে।
আমাদের তথ্য কমিশন বিধিমালা অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। খুব শিগগিরই তা অনুমোদিত হবে। কিন্তু সেটা হলেই যে মানুষ দলে দলে তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত নিয়ে যাবে, এমন আলামত নেই। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য বা ভারত যে সমস্যার মুখোমুখি খুব বেশি হয়নি, আমাদের সামনে প্রধান সমস্যাই সেটা: আইন সম্পর্কে ধারণার অভাব। তাই এখন আমাদের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত এ আইন সম্পর্কে সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের উপায় অন্বেষণ করা। তথ্য কমিশনের তিনজন সদস্যের পক্ষে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে মানুষকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে অবহিত করা সম্ভব হবে না। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়, বেতার-টিভি, বেসরকারি তথ্যমাধ্যম, এনজিওসহ সবাই মিলে এখন শুরু করা উচিত তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে অবহিতকরণের এক জাতীয় পর্যায়ের অভিযান।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রধান তথ্য কমিশনার (সিআইসি) এম আজিজুর রহমান জানালেন, তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্য কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার একটি বিধির খসড়া তৈরি করেছে। সেটি অল্পদিনের মধ্যেই অনুমোদন পাবে। এর পর তথ্য কমিশন নিজে একটি প্রবিধানমালা তৈরি করবে। ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগে তথ্য প্রদানের জন্য একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তথ্য কমিশন এখনো পুরো মাত্রায় কাজ শুরু করতে পারেনি, কারণ তার লোকবল নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। তথ্য কমিশন ৭৮ জন লোকবলবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কাঠামো সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে। কমিশনের নিজস্ব কার্যালয়ের জন্যও জায়গা খোঁজা হচ্ছে। সিআইসি জানালেন, আগারগাঁওয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি তলায় আট হাজার বর্গফুটের একটি কার্যালয় সাজানোর প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু হবে। সেখানে কমিশন অস্থায়ীভাবে কিছু সময় কাজ করবে, তারপর আগারগাঁওয়েই দুই বিঘার জমির ওপর স্থায়ী কার্যালয়ের ভবন নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে।
তথ্য কমিশনের অবকাঠামোগত ভিতগুলো গড়ে তুলতে কিছুটা সময় লাগবে; তাই বলে কমিশন নিষ্ক্রিয় বসে নেই, জানালেন প্রধান তথ্য কমিশনার। জানতে চাইলাম, কী ধরনের কাজ তাঁরা এখন করছেন। তিনি জানালেন, তথ্য অধিকার আইনটি সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক, আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় ইত্যাদি চলছে। গত মাসে তথ্য কমিশনাররা দেশের চারটি জেলায় এ ধরনের বৈঠক করেছেন। এ মাসে আরও ১২টি জেলা তাঁদের সফর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ওদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা বেশ কয়েক বছর ধরে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও পাসের জন্য জনমত সংগঠনসহ নানা ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি চালিয়ে এসেছে, তাদের আয়োজনে ও ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের আর্থিক সহযোগিতায় ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। ভারতের তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলো জানা-বোঝা ছিল তাঁদের এই সফরের উদ্দেশ্য। তথ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের মোট ছয়জন কর্মকর্তা ভারতের তথ্য কমিশনের প্রধান কার্যালয়, কয়েকটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ঘুরে দেখেছেন, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছেন। আমাদের প্রধান তথ্য কমিশনার জানালেন, সফরকার ওই সরকারি কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা জানার জন্য তাঁরা তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসার উদ্যোগ নেবেন। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের কাজে নানা পর্যায়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে বলেও জানা গেল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্থা, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজ্ঞ, এনজিও-কর্মীদের সমন্বয়ে ‘তথ্য অধিকার ফোরাম’ নামে একটি নাগরিক প্ল্যাটফরম রয়েছে। তথ্য অধিকার আইন পাসের ক্ষেত্রে তারা জনমত সৃষ্টিসহ নানামুখী ভূমিকা রেখেছে। আইনটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেও তারা কিছু উদ্যোগ নেবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য সম্প্রতি কিছু সভা-বৈঠক করেছে। এই সংস্থাটি তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এবং যাঁরা তথ্যের জন্য আবেদন করবেন, সেসব নাগরিকদের মধ্যে ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ বা সামর্থ্য সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচির উদ্যোগ নেবে। এ ছাড়া তথ্য কমিশনকে কার্যকর করায়, এর প্রবিধানমালা প্রণয়নে সহযোগিতা দিতেও টিআইবি কিছু উদ্যোগ নেবে বলে জানালেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তথ্য অধিকার আইন একটি সর্বজনীন আইন। এ আইনের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। একমাত্র প্রতিপক্ষ বলে মনে করা হয় যে আমলাতন্ত্রকে, সৌভাগ্যক্রমে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সময়ে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে সেই আমলাতন্ত্রের দিক থেকেও বেশ ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। তথ্য গোপন রাখার মধ্য দিয়ে প্রশ্নাতীতভাবে ক্ষমতা ভোগের দিন শেষ হয়ে গেছে—এই উপলব্ধি কমবেশি সবার মধ্যেই সঞ্চারিত হচ্ছে। সবাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে জনগণকে তথ্য জানতে দিতে হবে।
কিন্তু তথ্য অধিকার আইনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক নাগরিক যে একটি বড় আইনি হাতিয়ারের মালিক হয়েছে—এই সচেতনতার অভাব প্রকটভাবে রয়ে গেছে। কী কাজে, কী পদ্ধতিতে আইনটিকে ব্যবহার করা যায় এটি অনেকেই জানেন না। তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ আবু তাহের বললেন, আইনটি সম্পর্কে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও পুরোপুরি স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে।
তথ্য অধিকার আইনের খবরটি পৌঁছেছে জেলা পর্যায়ের শিক্ষিত শ্রেণী পর্যন্ত। তৃণমূল পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষ এ সম্পর্কে বস্তুত কিছুই জানে না। রাষ্ট্র ও সরকার কীভাবে চলছে, জনগণের অর্থ কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য কত অর্থ বরাদ্দ আসছে, কীভাবে সেগুলো ব্যয় হচ্ছে—এসব তথ্য জানার অধিকার যে তাদের আছে, এ ধারণাটিই তাদের নেই।
আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইনের আন্দোলন চলেছে শিক্ষিত নাগরিক-সমাজের নেতৃত্বে। এই আইনটি পেতে খুব বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে, এমনও নয়। আসলে ২০০২ সালে আইন কমিশন যখন তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া কার্যপত্র তৈরি করে, তখন এর পক্ষে নাগরিক-সমাজে কোনো আন্দোলন ছিল না। বলা চলে, সরকার নিজে থেকেই এমন একটি আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে শুরু করেছিল (সম্ভবত আমাদের বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের তাগাদায়)। তার পরে অবশ্য সরকারের গড়িমসি চলেছে বেশ কয়েক বছর। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদিচ্ছা এবং সেই সদিচ্ছার প্রতি বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সমর্থনের ফলে আমরা আইনটি পেয়েছি। প্রতিবেশী ভারত, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে খ্যাত, যেখানে গণতন্ত্রের বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে, সেখানে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরিণতিতে। ভারতে তথ্য অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিল একদম তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষেরা। যেসব দরিদ্র মানুষ বছরের একটা বড় সময় ধরে বেকার থাকে, কোনো কাজ পায় না, কাজ পেলেও ঠিকমতো মজুরি পায় না, যাদের নামে মজুরির টাকা তুলে নিয়ে যায় পঞ্চায়েতের মেম্বার-চেয়ারম্যান, যাদের রেশনের চিনি বিক্রি করে দেয় চিনির ডিলার, সেই সব মানুষ বুঝতে পেরেছিল এসব অন্যায়-অনাচার বন্ধ করতে হলে, জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন তথ্য জানার অধিকার। রাজস্থানের দরিদ্র মানুষদের সেই তথ্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল; তারই চূড়ান্ত ফসল তাদের তথ্য অধিকার আইন।
ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার ওজাহাত হাবিবুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের কিছু সময় পরে বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তথ্য কমিশনের কাজে তাঁরা কী কী অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, নাগরিকদের আপিলের শুনানি করতে তাঁরা পাঁচজন তথ্য কমিশনার হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। কারণ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে আপিল করতে আসছে তথ্য কমিশনের কাছে। অর্থাত্ ভারতে তথ্য অধিকার আইন বলবত্ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের নাগরিকেরা ব্যাপক সংখ্যায় সে আইন ব্যবহার শুরু করে।
আমাদের তথ্য কমিশন বিধিমালা অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। খুব শিগগিরই তা অনুমোদিত হবে। কিন্তু সেটা হলেই যে মানুষ দলে দলে তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত নিয়ে যাবে, এমন আলামত নেই। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য বা ভারত যে সমস্যার মুখোমুখি খুব বেশি হয়নি, আমাদের সামনে প্রধান সমস্যাই সেটা: আইন সম্পর্কে ধারণার অভাব। তাই এখন আমাদের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত এ আইন সম্পর্কে সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের উপায় অন্বেষণ করা। তথ্য কমিশনের তিনজন সদস্যের পক্ষে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে মানুষকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে অবহিত করা সম্ভব হবে না। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়, বেতার-টিভি, বেসরকারি তথ্যমাধ্যম, এনজিওসহ সবাই মিলে এখন শুরু করা উচিত তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে অবহিতকরণের এক জাতীয় পর্যায়ের অভিযান।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments