শিক্ষা ঋণ বদলে দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা by পিয়াস সরকার
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা এহসানুল হক মিলন বলেন, বিনা পয়সায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন। তারা বিনামূল্যেই পড়ুক কিন্তু একটু টাকাটা ঘুরিয়ে দেয়া যায়। ধরেন একজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিবছর সরকার এক লাখ টাকা খরচ করছে। এই শিক্ষার্থীকে প্রথম বর্ষের পর সার্টিফিকেট দেয়া হলো- ‘তিনি ভালো করেছেন এবং গ্রেড পয়েন্ট এত’। এরপর সরকার ওই শিক্ষার্থীকে এক লাখ টাকা শিক্ষা ঋণ দেবে অর্থাৎ পরবর্তী বছরের জন্য এক লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা হবে। এর সঙ্গে এর ৩০ শতাংশ শিক্ষার খরচ দেবে শিক্ষার্থীর হাতে। পাঁচ বছরে সরকার থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা পাবে ওই শিক্ষার্থী। গ্যারান্টার হবে শিক্ষক, চেয়ারম্যান। সার্টিফিকেটের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রতিটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে। সাড়ে ৬ লাখ টাকার মধ্যে শিক্ষার্থী দেড় লাখ টাকা হাতে পাবে। যার কারণে শিক্ষার্থীর কোনো চিন্তা থাকবে না। পড়ালেখার বাইরে টাকার সন্ধান করতে হবে না। তবে এটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কার্যকর ‘বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ’ খুবই জরুরি। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু কেউ যদি পড়ালেখা না করে সরকারের তো কোনো সমস্যা নাই। চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট দেবে না। ওই শিক্ষার্থী তার বাবার টাকায় পড়ুক, ৫০ বছর থাকুক। ওই শিক্ষার্থী এই অর্থ ব্যয় করে নিজের জীবন প্রতিষ্ঠিত করবে। এরপর নির্দিষ্ট সময় পরপর ব্যাংক ম্যাসেজ দেবে- ‘পে ব্যাক ইউর লোন।’ এই লোন পরিশোধের জন্য কোনো চাপ বা শাস্তি দেয়া হবে না। ধরে নিলাম ওই শিক্ষার্থী সিনিয়র সচিব থেকে পদত্যাগ করছেন। এক কোটি টাকা পেনশন পাচ্ছেন। সেখান থেকে টাকাটা কেটে নেয়ার অনুমতি চাওয়া হবে। কারণ তার টাকা পরিশোধের যোগ্যতা আছে। এরপরও যদি না দিতে চান সেটাও সমস্যা নাই। সরকার জোর করবে না। ধরে নেই আরেক শিক্ষার্থী সিআইপি কার্ড চায়। ওখানে তথ্যে উল্লেখ থাকবে যে স্টুডেন্ট লোন পরিশোধ করেনি। আশা করি শিক্ষার্থীদের পিছনে ব্যয় করা ৫০ শতাংশ অর্থ ফেরত আসবে। বাকি টাকাটা পরিশোধ হলো না সমস্যা নাই। এখন তো বিনামূলেই পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি’র এই নেতা বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন ‘বাই দ্য স্টুডেন্ট, ফর দ্য স্টুডেন্ট, ফর দ্য এডুকেশন’। এরপর আমরা অনেক ভাগ্যবান একজন কনক্রিট শিক্ষাবিদকে দেশের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন আন্দোলনরত নন-পলিটিক্যাল শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতি হয় মূল দলের প্রতি বায়াস্ড হয়ে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বার্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নন-পলিটিক্যাল শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন করলেন। রক্ত দিলেন।
শিক্ষার সংস্কারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষার সংস্কার কাজ এখনো শুরুই হয়নি। এরজন্য সময় দিতে হবে। শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতো একজন গুণী মানুষ পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনে আগে যারা দায়িত্ব পালন করছিলেন তারা কিন্তু এখনো সেখানেই আছেন। যদিও কিছু লোককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা স্যাডো মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন যে সরকার রয়েছে তারা পলিটিক্যালি এত স্ট্রং নয়। কোর কমিটিতে যেমন এনসিটিবি’তে (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) আওয়ামী লীগের লোকেরা রয়ে গেছেন। এনসিটিবি’র টেন্ডার হয় জুন-জুলাইয়ে। কিন্তু তারা দায়িত্বই নিয়েছেন আগস্টে। পরিমার্জনই এখনি হয়নি। এই কাজটা এত সহজ নয়। কারণ গত ১৫ বছরে তারা এতটা ধ্বংস করেছেন যে বলা যায় বইগুলোকে- ‘শরীফ থেকে শরীফা বানিয়ে ফেলেছে’। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে- ‘পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হবে’। এটার জন্য অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন।
সমালোচনার জেরে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটি বাতিলের বিষয়টি তিনি সমর্থন করেন না উল্লেখ করে বলেন, সমালোচনা তো হবেই। উনি দায়িত্ব দেয়ার পর সমালোচকরা যা বলছেন সেটার কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা এটা দেখতে হবে। ইসলাম ফোবিয়া নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। বইগুলো তো ধর্ম ছিল না। তবে আমি বলতে চাই, ধর্মীয়-নৈতিকতার বিষয়টি থাকতে হবে। প্রত্যেকটি ধর্মের ভালো কথা, নৈতিকতা, আদর্শের কথা উল্লেখ থাকতে হবে।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সাবেক এই সংসদ সদস্য কারিগরি শিক্ষা সেক্টরের বিষয়ে বলেন, শিক্ষায় দেশে ৭১ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করে পরিবার। বাকিটা সরকারসহ অন্যরা ব্যয় বহন করে। তবে কারিগরি শিক্ষা পুরোপুরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এটার খরচ সরকার দিচ্ছে। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ২১টি মন্ত্রণালয় কারিগরি শিক্ষার উপর প্রজেক্ট করে। এই অর্থগুলো নষ্ট করছে। এই বিষয়গুলো একখানে এনে একটা কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় করা যেতে পারে। অতিদরিদ্র পরিবারের মানুষগুলো মাদ্রাসায় যায়। কারণ সেখানে কোনো খরচ হচ্ছে না। সেজন্য এই সেক্টরের লোকজন মূলধারায় আসছে না। আমরা ক্ষমতায় আসার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ করেছিলাম। এরপর বোর্ডগুলোকে এক্সটেন্ড করি। কিন্তু মাদ্রাসায় যারা আছেন তারা তো উচ্চ শিক্ষার মূল্যায়ন করার মতো না। এরপর ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় করে তাদের দায়িত্ব দিলাম। কিন্তু আমরা শিক্ষায় যেটুকু অগ্রগতি করেছিলাম বিগত সরকার শিক্ষার গাড়িকে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা পিছিয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম মাদ্রাসা শিক্ষায় কর্মমুখী করতে। আমরা কারিগরি মাদ্রাসার উদ্যোগ নেই। ইংরেজি মিডিয়ামে ইংরেজিতে গুরুত্ব দেয়া হয় তেমন মাদ্রাসায় আরবিকে প্রাধান্য দেয়া হবে। যাতে তারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সহজে কাজ করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কাজের একটা বড় সুযোগ আছে কিন্তু যোগাযোগ দক্ষতাটা নেই।
এহসানুল হক মিলন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এতটাই শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছিল যে, তারা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বোর্ড পরীক্ষা আনলো। তারা শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানালো। পৃথিবীতে এখন আর গিনিপিগ বানানোর প্রয়োজন নাই। এখন গ্লোবাল ভিলেজ সবই আমরা জানি। আমরা পঞ্চম জেনারেশন কম্পিউটার ব্যবহার করছি। আমরা এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করছি। এডুকেশনেও আমাদের লেটেস্টটা ব্যবহার করতে হবে। বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, পরীক্ষা কমিয়ে দিচ্ছে সেখানে আওয়ামী লীগ পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষার আয়োজন করলো। এরপর তারা বললো, পরীক্ষার প্রয়োজন নাই, এরপর বললো, কোনো পরীক্ষাই নাই। মানে যখন যা মন চেয়েছে করেছে। আমেরিকায় আমি দেখেছিলাম সেখানে যে পেশাতেই যাই না কেন লাইসেন্স লাগবে। এজন্য আমি শিক্ষকদের লাইসেন্স দেয়ার জন্য এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) তৈরি করলাম। কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে চায় সেটাকে অনেক সময় করা যায় না, আবার প্রয়োজনও আছে। এজন্য শিক্ষার মান রক্ষায় শিক্ষকদের যোগ্যতা ধরে রাখার জন্যই তাদের লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা। এনটিআরসিএ’র ড্রাফট আমিই প্রথমে করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এটাকে দুর্নীতির রাজ্য বানালো। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয় কসাই বা গ্রামের প্রতিপত্তিওয়ালা লোক। তিনি শিক্ষকদের উপর খবরদারি করেন। এরপর ক্রাইটেরিয়া ঠিক করা হলো এই যোগ্যতাগুলো থাকলে সভাপতি হতে পারবেন। এরপর আমরা বদলির ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়নের কাজ করার সময় পাইনি। এরপর আওয়ামী লীগ এটাকে এমনভাবে রাজনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেললো যে কোনো উপকারই এখন মিলছে না।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)’র বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে (২০০১ সালের আগে) বিসিএস ভাইভাতে ২০০ নম্বর ছিল। আমরা এটাতে কমিয়ে ১০০ নম্বর করেছি। অন্যান্য পরীক্ষাসহ বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার নম্বর আরও কমানো যেতে পারে। ভাইভাতে স্বজনপ্রীতি করা সহজ। কারণ এটার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই। কারচুপি করলে ধরাও খুব কঠিন। আবার এই ভাইভাতেও কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করে নম্বর বণ্টন করা যেতে পারে। পিএসসি সদস্যদের খুঁজে বের করতে হবে যারা স্বজনপ্রীতিতে যুক্ত নন। ধরেন একজন শিক্ষক ৩০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাদের চরিত্র তো একদিনে ফুটে ওঠে না। চরিত্র বুঝে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পিএসসি পরিচালনার জন্য সদস্যরা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বিশ্ববরেণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিয়েছেন। বিশ্বের কোনো দেশের সরকার প্রধান হয়তো এত গ্রহণযোগ্য নন। আর উনি যদি একটা শিক্ষা কমিশন না করেন তাহলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে। এই সরকারের কাছে চাওয়া এমন একটা শিক্ষা কমিশন করতে হবে প্রয়োজনে সংবিধানের সঙ্গে সন্নিবেশিত করতে হবে যাতে পরবর্তী সরকার পাল্টাতে না পারে। সেখানে বেসিক কিছু ধারা থাকবে যেগুলো পরিবর্তন করা যাবে না। বিগত সরকার জাতির ভবিষ্যত নিয়ে খেলাধুলা করেছে। জাতির সঙ্গে এর থেকে বড় অন্যায় কোনো সরকার কোনোদিন করেনি।
No comments